প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৩।

0
90

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

‘বিবিজান, এক গ্লাস শরবত করে নিয়া আসো তো।’

তনুকা কাপড় ভাঁজে ব্যস্ত ছিল, মেহতাবের গলার স্বর পেয়ে সেদিকেই তাকায়। অস্থির দেখায় তাকে। কাপড় রেখে তাই সে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু হয়েছে?’

‘না। গরমে অস্থির লাগছে। শরবত নিয়ে এসো।’

তনুকা কথা বাড়াল না। শরবত আনতে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, লতা কাজ করছে। তনুকার উপস্থিতি খেয়াল করেই লতা প্রশ্ন করল,

‘কিছু লাগব, বউমনি?’

‘না না, একটু শরবত বানাতে এসেছি।’

‘আমি বানাই দিমু?’

‘না, আমি পারব।’

শরবত বানাচ্ছে তনুকা। লতা দুপুরের রান্নার সব আয়োজন করছে। সেই সময় রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দন্ডায়মান হন রাহীলা। পান খাওয়া রক্তিম ঠোঁট নাড়িয়ে রষিয়ে রষিয়ে বলেন,

‘খালি স্বামীর সেবা যত্ন করলেই চলবে, একটু তো শাশুড়িদের প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়।’

তনুকা ফিরে চাইল। রাহীলার উপস্থিতি ঠিক পছন্দ হলো না তার। তাও অগত্যাই হাসল। বলল,

‘বলুন, কী সেবা করতে হবে?’

‘শরবত বানাচ্ছো না কি?’

‘জি, মেহতাব চেয়েছেন।’

‘এক গ্লাস শরবত বানিয়ে আমার রুমেও পাঠিয়ে দিও। তোমার কাকার মেজাজও ঠিক নেই। আর শোনো, স্বামীকে একটু বুঝিও, বড়োদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই জ্ঞানও তো তার নেই।’

মুখ বাঁকিয়ে জায়গা ছাড়লেন তিনি। তনুকা বুঝল না কিছু। কাকী ক্ষেপলেন কেন? আর মেহতাব’ই বা কী করেছে? সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে লতার দিকে চাইল। দেখল, লতাও তার দিকে একই দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তনুকার ভ্রু কুঁচকাল। লতাকে বলল,

‘আমি শরবত বানিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটু কষ্ট করে কাকীর রুমে দিয়ে আসবেন।’

লতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে।’

শরবত নিয়ে তনুকা নিজ কক্ষে ফিরে এল। বিছানায় মেহতাবকে দেখল, উদম গায়ে শুয়ে আছে। একপলক তাকে দেখেই দৃষ্টি নিমজ্জিত করে বলল,

‘আপনার শরবত।’

চিন্তায় ভগ্ন ঘটিয়ে মেহতাব বলল,

‘রাখো।’

তনুকা সাইড টেবিলে রাখল। বলল,

‘ছোট কাকার সাথে কি আপনার কিছু হয়েছে?’

মেহতাব উঠে বসল। শরবতের গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল,

‘কেন, তোমায় কেউ কিছু বলেছে না কি?’

‘কাকী বললেন।’

‘কী বললেন?’

তনুকা রয়েসয়ে বলল,

‘আপনার নাকি বড়োদের সাথে কথা বলার জ্ঞান নেই।’

শরবতের গ্লাসে চুমুক দিল মেহতাব। ঠান্ডা ঠান্ডা শরবতে অন্তর জুড়াল তার। তনুকার দিকে চেয়ে বলল,

‘এদিকে এসে বসো।’

তনুকা বসল। দূরত্ব রাখল মাঝে কিছু। চোখ তার মাটিতেই নিমজ্জিত। মেহতাব পরপর দুবার শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,

‘খালি গায়ে আমি আর লজ্জা পাচ্ছো তুমি? ব্যাপারটা কেমন হলো?’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কে বলল আমি লজ্জা পাচ্ছি?’

‘তবে তাকাচ্ছো না কেন?’

‘এমনি?’

‘আমাকে উদম গায়ে দেখে কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে?’

তনুকা ভড়কাল ভীষণ। চটে গিয়ে বলল,

‘পাগল হয়েছেন? কী বলছেন?’

তনুকার বিভ্রান্তিকর অবস্থা দেখে সশব্দে হাসল মেহতাব। বলল,

‘থাক, আর কিছু বলতে হবে না। আমি সব বুঝি।’

‘কিছুই বুঝেন না আপনি। এখন এসব বাদ দিয়ে কাকার সাথে কী হয়েছে সেটা বলুন।’

‘ঐসব আমাদের ব্যক্তিগত ঝামেলা, তুমি বুঝবে না।’

এহেন জবাবে তনুকার মনঃক্ষুন্ন হলো যেন। সে কি তবে মেহতাবের ব্যক্তিগত কেউ না? তার কাছে কি সব বলা যায় না? তনুকা উঠে দাঁড়াল। মেহতাব কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

জবাব না দিয়েই তনুকা পা বাড়াতে চাইল। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত চেপে ধরল মেহতাব। হেয়ালির সুরে বলল,

‘এইটুকুতেই এত অভিমান?’

ফিরে চাইল তনুকা। বলল,

‘আমি মোটেও অভিমান করিনি।’

মেহতাব হাতে টান দিয়ে বসাল তাকে। বলল,

‘সময় হলে সব বলব তোমায়, আপাতত তোমায় কোনো দুশ্চিন্তা দিতে চাই না।’

পুরোটা কথা বলার সময় তনুকার পূর্ণ দৃষ্টি মেহতাবের উন্মুক্ত বক্ষেই ছিল। কিছু একটাতে নজর আটকেছে তার। তাই প্রশ্ন করল,

‘বুকের ঐ কাটা দাগটা কীসের?’

মেহতাব একপলক চাইল সেই কাটা দাগের দিকে। যেটা তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ঠিক বুকের বামদিকে। সে মৃদু হাসল। বলল,

‘ভালো মানুষের শত্রুর অভাব নেই। হয়তো শত্রুতা মেটাতেই কেউ একজন আঘাত করেছিল।’

তনুকা বিস্মিত হলো। জিজ্ঞেস করল,

‘কে সে? আপনি চেনেন না?’

ফিচেল হাসল মেহতাব। বলল,

‘চিনি তো।’

‘তাকে কোনো শাস্তি দেননি।’

‘সময় হলে অবশ্যই দিব। এখনো সময় হয়নি।’

‘কে সে?’

‘তুমি জেনে কী করবে?’

এমন প্রশ্নে বিরক্ত হলো তনুকা। তার স্বামীর শত্রুকে সে চিনবে না? তার তো চেনা উচিত, জানা উচিত সেই শত্রু সম্পর্কে। তাই বলল,

‘আপনার শত্রু তো আমারও শত্রু। আমার তো জানা উচিত তাই না?’

মেহতাব গম্ভীর সুরে বলল,

‘সময় এলে বলব।’

ভ্রু কুঁচকাল তনুকা। বিরক্তির মাত্রাও তড়ান্নিত হলো। কথা বাড়াতে আর ইচ্ছে হলো না। তাই উঠে চলে গেল গোসলখানায়, গোসল করতে।

মেহতাব শরবত শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সহসাই হাত রাখল বুকের সেই কাটা দাগে। চোয়াল দৃঢ় হলো সঙ্গে সঙ্গেই। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘আমার বুকের প্রতিটা রক্তের ফোটার দাম তোমাকে দিতেই হবে মতিব মজুমদার। তোমার গায়ের চামড়া বেঁচে আমি সেই দাম মেটাব।’

_______

গোসল সেরে এসে দেখল, মেহতাব কক্ষে নেই। তনুকা শ্বাস ফেলল। মাথার ভেতর প্রশ্নের জট আরো গভীর হলো যেন। মেহতাবের চরিত্র বেজায় রহস্যময়। লোকটাকে ঠিকঠাক ধরা যাচ্ছে না। তাকে ধরতে হলে তীক্ষ্ণ মেধা প্রয়োজন। এত চিন্তাই যতটুকু মেধা ছিল তাও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে যে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

আজ গোসল সেরে তনুকা কামিজ পরেছে। মাথায় ওড়না টেনে গিয়েছে ছাদে। ভেজা কাপড় এখানেই মেলবে। মাথার ওপর তখন কড়া রোদ। বাতাসের কোনো নাম গন্ধও নেই। ছাদ থেকে মহলের পেছন দিকের রাস্তা স্পষ্ট। ঘাট বাঁধানো পুকুরের পাশ ঘেষে গিয়েছে রাস্তাটা। পিচ ঢালা সরু রাস্তা। সেই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে কথা বলছেন দুজন মানুষ। দূর থেকে তাদের মুখ অস্পষ্ট। তনুকার দৃষ্টি সেদিকেই। তার মধ্যে একজনকে তার পরিচিত মনে হলো। চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করল তাই। চিনতে সময়ও নিল না খুব। লোকটা ছোট কাকা, মতিব মজুমদার। তবে পাশের জন পরিচিত নয়। তাকিয়ে রইল তনুকা। হঠাৎ দেখল, ঐ দুজনও যেন তাকেই দেখছে। আকস্মিক এমন দৃষ্টিতে খাটিকটা বিব্রত বোধ করল সে। দ্রুত ছাদ থেকে নিচে নেমে গেল। দ্রুত নামতে গিয়েই ধাক্কা গেল কারোর সাথে। খানিকটা ভীত হয়ে চাইল তনুকা। রেনুকে দেখে ভয় কমল। হেসে বলল,

‘স্কুল ছুটি?’

‘হ্যাঁ, বউমনি। কিন্তু তুমি এমন ছুটে আসছো কোথ থেকে?’

‘না মানে, একটু ছাদে গিয়েছিলাম।’

‘এই সময়, এত রোদে ছাদে কেন?’

‘কাপড় মেলতে।’

রেনু এতক্ষণে খেয়াল করে দেখল, তনুকার এক হাতে একটা বালতি। সে বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,

‘জমিদার বউ কাপড় ধৌয়? তাহলে বাড়িতে আর এত কাজের লোক রেখে কী লাভ? ভাইজান আর আম্মা শুনলে খুব রাগ করবেন কিন্তু। এসব কাজ বাড়ির কাজের লোকেরাই করে, ওদের দিয়েই করাবে।’

‘নিজের পরনের দুটো কাপড় আবার কাজের লোকদের দিয়ে ধুয়াতে হয় না কি? এইটুকু কাজ তো নিজেই করা যায়।’

‘কিন্তু, এই বাড়ির মেয়ে বউরা এইটুকু কাজও করে না। তাই তোমারও উচিত নয়, বুঝলে?’

তনুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ঠিক আছে। তুমি গিয়ে এখন ফ্রেশ হয়ে নাও।’

_____________

‘আমাগো জমিদার ভাবিজান দেখি খুব মারাত্মক, কাকা।’

মতিব মজুমদার কপাল কুঁচকে বললেন,

‘ভাইয়ের মতো জান দেওয়ার ইচ্ছে আছে না কি?’

হাসল করিমুল্লাহ। বলল,

‘আমার ভাই তো বেকুব আছিল। বাঘের সামনে বাঘিনীর রূপের প্রশংসা করলে বাঘ তো ক্ষেপবই। আমি কি আর তার মতো বেকুব? আমি চালাক, কার সামনে কী কইতে হয় তা আমি জানি।’

মতিব মজুমদার বিরক্ত গলায় বললেন,

‘হয়েছে থাম। কাজ যা দিয়েছি সেটা মন দিয়ে করো আগে।’

‘কাজে সফল হইলে কী দিবেন?’

‘যা চাইবে তাই।’

করিমুল্লাহ দাঁত বের করে বিশ্রী হাসল। বলল,

‘জমিদার ভাবিজানরে এক রাইতের জন্য দিয়েন খালি।’

মতিব মজুমদার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইলেন। তারপর দাঁত খিঁচে বললেন,

‘আস্তে বল, শা’লা; নিজে তো মরবি মরবি, সাথে আমাকেও মারবি দেখছি।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here