প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫।

0
201

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫।

অন্দরমহলের পরিবেশ থমথমে। তনুকাকে নিয়ে মেহতাব ভেতরে এসে দাঁড়াতেই কয়েক জোড়া চোখ বিস্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তাদের উপর। বাড়ির কর্তী আম্বিরা বেগম দ্রুত এগিয়ে এলেন। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘বৌমা, তুমি আমাকে না বলে বিচারমহলে কেন গেলে?’

তনুকা চোখ নামায়। দৃষ্টি তার মাটিতেই নিমজ্জিত। অস্বস্তি আর ভয় হচ্ছে তার। এতগুলো মানুষও কি এখন তাকে কথা শোনাবে?
মেহতাব তনুকাকে খেয়াল করল। অতঃপর চাইল মায়ের দিকে। বলল,

‘আম্মা, এই নিয়ে আমার তনুর সাথে কথা হয়েছে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’

আম্বিরা বেগম ক্ষান্ত হলেন। ছেলের মুখের উপর কথা তিনি বলেন না। পেছন থেকে তার ছোট কাকী রাহীলা, বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন,

‘নিজের বউ বলে জমিদার সাহেব মাফ দিয়েছেন, এখন আমাদের মধ্যে কেউ হলে তো গর্দান নিতেন।’

আম্বিরা বেগম চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,

‘আহ ছোটো, চুপ কর না।’

রাহীলা আঁচল চেপে মুখ ভেংচালেন। মেহতাব বিরক্ত হলেও কথা বাড়াল না। বলল,

‘আম্মা, আজ দুপুরে তো তনুর রান্নার কথা?’

‘হ্যাঁ, এটাই তো বাড়ির নিয়ম।’

‘তবে, আজ থেকে নিয়মে কিছু বদল আসুক। তনুর সাথে আজ আমিও রাঁধব।’

মেহতাব কথাখানা পাড়তে দেরি হয় আর উপস্থিত জনতার মাঝে হৈ চৈ বাঁধতে দেরি হয় না। সকলে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। আম্বিরা বেগম অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠেন,

‘এটা কেমন কথা, বাবা? মহলের ছেলেরা রান্নাঘরে যায় না।’

‘আমি যাই, আম্মা। এই মহলের বর্তমান জমিদার আমি, তাই আমার কথাতেই সব হবে। তুমি লতাকে খবর দিয়ে সব বাজার রান্নাঘরে পাঠাতে বলো।’

আম্বিরা বেগমসহ সকলের মুখের রা বন্ধ। বউয়ের প্রেমে কি ছেলেটা অন্ধ হয়ে গিয়েছে? নাকি মেয়েটা কোনো যাদুটোনা করেছে?

মেহতাব তনুকার একহাত আঁকড়ে ধরল। হেসে বলল,

‘চলো বিবিজান, আইজ আমরা এক লগে রান্ধুম।’

সবাইকে বিশাল বিস্ময়ের সাগরে রেখেই মেহতাব তার বিবিকে নিয়ে ছুটল রান্নাঘরে। তনু নির্বাক চেয়ে আছে। এই লোক তো কেবল ক্ষণে ক্ষণে রূপ’ই বদলিয়ে যাচ্ছেন। কোনটা আসল, কোনটা নকল এখন কেমন করে বুঝবে সে?

___________

বিশাল রান্নাঘর। একপাশে সাজানো হরেক রকম তৈজসপত্র। অন্য এক পাশ পুরোটা জুড়ে নানানরকম বাজার। রান্নাঘরের সামনের ফটকের বাইরে দেখা যায় প্রকান্ড এক বাগান। ফুলের নয়, শাক সবজির বাগান।
তনু এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লতা সবগুলো সবজি খুলে খুলে মেহতাবের পায়ের সামনে রেখেছে। মেহতাব ভালোমতো সব পরখ করে বলল,

‘এবার তুই যা। বাইরে গিয়ে জানিয়ে দে, আগামী দুই ঘন্টার ভেতর যেন এই রান্নাঘরে কেউ প্রবেশ না করে।’

লতা মাথা হেলিয়ে প্রস্থান ঘটাল। মেহতাব চাইল তনুকার দিকে। আদর করে ডাকল,

‘বিবিজান।’

তনুকা পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেহতাবের উপর। মেহতাবের চোখ মুখ উচ্ছ্বেসিত। সে এগিয়ে এল তনুকার দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘কও, কী রানবা?’

তনুকা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘শুদ্ধ জানলে অশুদ্ধ ভাষা বলার কী দরকার? একেকবার একেক ভাষা ব্যবহার করছেন, শুনতে বিরক্ত লাগে।’

ঈষৎ হাসল মেহতাব। বলল,

‘তোমার বিরক্তিতে আমার কিছু যায় আসে না; এখন এত কথা না কইয়া, যা জিগাইছি তার উত্তর দাও। কী রানবা?’

তনুকা অন্যদিকে ফিরল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আমি কিছু রাঁধতে পারি না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘তা আমি জানি কিন্তু, পছন্দের খাওনের নাম তো কইতেই পারো। তোমার পছন্দের সব খাওন রান্ধুম, কও কী কী খাইবা?’

তনুকা মৃদু আওয়াজে বলল,

‘আপনার যা খুশি তাই রান্না করুন, আমি সব খাই।’

হাসল মেহতাব। নিচ থেকে মুরগীর ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কখনও মানুষের মাংস খেয়েছ?’

ভড়কে যায় তনুকা। এটা কেমন প্রশ্ন? ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সে। তার তাকানো দেখে মেহতাব এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে মেহতাবের এই চমৎকার হাসি যেন রান্নাঘরের প্রতিটি দেয়ালে গিয়ে বারি খাচ্ছে। অদ্ভুত এক সুর আছে এই হাসির। হাসি থামাল মেহতাব। তনুকা এখনও আগের মতোই চেয়ে আছে। মেহতাব এগিয়ে আসে তার দিকে। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘জানো বিবিজান, মানুষের মাংসের খুব স্বাদ। একবার যে এই মাংসের স্বাদ নিয়ে ফেলে, সে আর কখনোই অন্য কোনো মাংস খেতে পারে না।’

তনুকার কেমন যেন করে। আকস্মিক গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এক কদম পিছিয়ে যায়। মেহতাব তার আপাদমস্তক পরখ করে। ক্রূর হেসে বলে,

‘ডরাইতেছ কেন, বিবিজান? আমি মানুষের মাংস খাই নাই, একটা আর্টিকেলে পড়ছিলাম। তুমি আমারে যেমনে ডরাইতেছ, মনে হয়তেছে আমিই মানুষের মাংস খাইছি।’

ফের হাসল মেহতাব। তনুকার হাত টেনে বলল,

‘এহানে আইয়ো, তোমারে রান্ধা শিখাই। পরের বার তুমি রানবা।’

তনুকা এক পা এগুল। কেন যেন ভয় কমছে না তার। কীসের একটা শঙ্কা যেন বক্ষঃস্থলে চেপে বসেছে। কিছুতেই কমছে না। মেহতাবের এহেন আচরণও তার সেই ভয় আর শঙ্কাকে আরো তড়ান্নিত করছে।

তনুকা দাঁড়িয়ে রইল। মেহতাবের গায়ে পরিচ্ছদ-রক্ষক বহিরাবরণ (এপ্রোন)। সে খুব যত্ন সহকারে একটা চাপাতি দিয়ে মুরগীটাকে টুকরো টুকরো করছে। তনুকা মনোযোগের সহিত দেখছে সেটা। এসব কাজ সে পারে না। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় বাড়ির ভৃত্যরাই এসব করেছে; আর বিদেশে তো তৈয়ারি’ই পাওয়া যেত। তাই এসবে খুব একটা ধারণা তার নেই। মুরগীর টুকরোগুলো কেটে একটা বাটিতে নিয়ে তনুকার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর বলল,

‘নেও, এবার এগুলা পরিষ্কার করে ধৌও।’

তনুকা ইতস্তত ভঙিতে কোনোরকমে সেগুলো পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করল। মেহতাবকে দিতেই সে বলল,

‘হয় নাই, বিবিজান। আবার ধৌও।’

তনুকা আবার ধু’লো। তাও মেহতাবের পছন্দ হলো না। বলল,

‘উঁহু, আবার ধৌও।’

তনুকা দাঁতে দাঁত চেপে ফের পরিষ্কার করল। মেহতাবকে দেখাল। মেহতাব হেসে বলল,

‘এবার হইছে।’

জিজ্ঞেস করল,

‘পেঁয়াজ কাটতে পারো?’

তনুকা উপর নিচ মাথা নাড়াল। তারমানে পারে। মেহতাব বলল,

‘ঠিক আছে। বারো থেকে পনেরোটা পেয়াজ কাটো।’

তনুকা অবাক হয়ে বলল,

‘কেবল এক মুরগীর তরকারিতেই এত পেঁয়াজ।’

‘না, বাকি সব তরকারির জন্য।’

হতাশ হয়ে পেঁয়াজ কাটতে আরম্ভ করল তনুকা। দুইটা শেষ করতে না করতেই চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করল নাক টানতে। সাতটা পেঁয়াজ কোনোরকমে কেটে বলল,

‘আমি আর পারছি না।’

মেহতাব চেয়ে দেখল, বেচারি ইতিমধ্যেই নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। সে মাথা নাড়াল। আফসোসের সুরে বলল,

‘তোমারে দিয়া দেখি কিছুই হইব না, বিবিজান।’

তনুকা নাক টেনে বলল,

‘দেশী পেঁয়াজের ঝাঁঝ বেশি, তাই পারছি না।’

‘আচ্ছা আর পেঁয়াজ কাটতে হবে না। এই সবজি গুলো কেটে দাও, তাহলেই হবে।’

______

রান্না প্রায় শেষের দিকে। তনুকা পুরোটা সময় বিস্ময় নিয়ে মেহতাবকে দেখেছে। একজন পুরুষ এত নিঁখুত ভাবে রাঁধতে পারে, ব্যাপারটা ভীষণ আশ্চর্যের লেগেছে তার। মেহতাবের রান্না দেখে মনে হলো, এই কাজে সে ভীষণ পারদর্শী, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা আছে হয়তো। প্রতিটা রান্নার শেষে তনুকাকে একটু করে টেস্টও করিয়েছে। সবগুলো রান্নাই যেন অসাধারণ। তনুকা শিখে নিয়েছে সব। পরেরবার সে একাই রাঁধতে পারবে।

মেহতাব ভালোমতো হাত ধুয়ে তনুকার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তারপর এক হাত বাড়িয়ে তার শাড়ির আঁচল টেনে, হাত মুছল তা দিয়ে। তনুকা এতে বিরক্ত হলো খুব, কিন্তু কিছু বলল না। তার জন্য এতকিছু করেছে, সে না হয় এইটুকু একটা ব্যাপার মুখ বুজে সহ্য করে নিল।

এতসবের মাঝেই তনুকার হঠাৎই স্মরণে এল তার গলার চেইনের কথা। ততক্ষণাৎ বলে উঠল,

‘একটা প্রশ্ন করব?’

মেহতাব হাত মুছে সরে দাঁড়াল। বলল,

‘না করলে কি করবে না?’

‘তাও করব।’

‘তাহলে করে ফেল।’

হাতের স্পর্শে সেই লকেটটা ছুঁলো সে। জিজ্ঞেস করল,

‘এটা আপনি দিয়েছেন, তাই না?’

মেহতাব খেয়াল করে দেখল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

‘না তো।’

‘আবার মিথ্যে বলছেন। অবশ্য রেনু বলেছে, আপনি নাকি খুব সুন্দর মিথ্যে বলতে পারেন, কেউ নাকি ধরতে পারে না। তবে, আমাকে মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি ঠিক ধরতে পারব।’

ফিচেল হাসল মেহতাব। বলল,

‘শুনে খুশি হলাম; অবশেষে তো কেউ একজন এসেছে যে, আমার মিথ্যে ধরতে পারবে।’

‘হু। তাই এখন সত্যিটাই বলুন; এটা আপনি দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছি।’

‘এই লকেটে আমার বাচ্চাকালের ছবি আছে; এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন?’

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here