প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৯।

0
87

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৯।

সন্ধ্যার হালকা নাস্তার পাঠ চুকিয়ে বাড়ির মহিলারা সব যার যার মতো কক্ষে ফিরে আসে। পুরুষরা সব বেরিয়ে যায় বাইরে। তাদের যাওয়ার গন্তব্য সম্পর্কে তনুকা অবগত নয়। তবে রেনুর মুখে শুনেছে, এই সময় পুরুষরা সবাই গ্রাম পর্যবেক্ষণে বের হয়। তনুকাও তাই নিজের কক্ষে চলে আসে। রেনু পড়তে বসে গিয়ে, সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা।

কক্ষে ফিরেই বাবার সাথে কথা বলতে মন উতলা হয়ে ওঠল তনুকার। তাই আর বিলম্ব না করে সাথে সাথেই কল দিল বাবার নাম্বারে। প্রথমে কল না ধরলেও দু’বারের মাথায় সেটা গ্রহণ হলো। তনুকা আবেগাপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন আছো, বাবা?’

ওপাশ থেকে থমথমে গলার স্বরে কেউ একজন উত্তর দিল,

‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, মামনি?’

‘আছি ভালো। যেমনটা তুমি চেয়েছিলে তেমনই আছি।’

লোকটি হয়তো ব্যথিত হলেন তার এহেন বার্তাবাণে। তিনি ভগ্নসুরে বললেন,

‘বাবার উপর কি এখনও রেগে আছো?’

তনুকা খানিক চুপ রইল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিঃশব্দে। বলল,

‘না, রেগে নেই। নিজের ভাগ্যকে কে’ই বা বদলাতে পারে, বলো?’

‘ওখানের সবাই খুব ভালো, তাও একটু মানিয়ে নিও, মা।’

‘আচ্ছা, মানিয়ে নিব। একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল?’

‘হ্যাঁ, বলো।’

‘তুমি কি আমার শাশুড়ি মা’কে আমার ছোটবেলার ছবি দিয়েছিলে?’

প্রশ্ন শুনে কয়েক ক্ষণ নীরবতা পালন করলেন ভদ্রলোক। কিছু হয়তো ভাবলেন। অতঃপর গম্ভীর সুরে উত্তরে বললেন,

‘না তো, কেন?’

তনুকা নিশ্চিত হলো, তারমানে তার শাশুড়ি সত্যিই মিথ্যে বলছিলেন। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল সে। এই বাড়ির সবাই এত মিথ্যে কী করে বলে? তনুকা বলল,

‘না বাবা, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম।’

তারপর বাবার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা জারি রেখে ফোন কাটল সে। ফোনটা সাইড টেবিলে রেখে পা নাড়াতে আরম্ভ করল। সাথে মনোযোগ দিল ঠোঁট কামড়াতেও। মিথ্যে, কেন মিথ্যে বলছেন উনারা? কী লুকাতে চাইছেন? এমন ছোট্ট একটা ব্যাপারেও মিথ্যে বলার কী আছে? যদি ছবিটা বাবার কাছ থেকে না’ই নিয়ে থাকেন, তবে এই ছবি তাঁরা কোথায় পেলেন? আর প্রশ্ন করলেই সহসা মিথ্যে ছুড়েন কেন?
এত প্রশ্নের উত্তর তনুকার মস্তিষ্ক দিতে পারল না। জবাব মেলাতে না পেরে মনটাও অশান্ত হলো তার। উদ্বিগ্নে কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ল। মানুষগুলো যতটা সহজভাবে নিজেদের প্রকাশ করছেন, তাঁরা অতটাও সহজ না; বরং বড্ড বেশি জটিল।

তনুকা নিজের রুমের দরজার কাছে আসতেই সিঁড়ির নিকট মেহতাবকে দেখল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে উপরেই আসছে সে। সিঁড়ির শেষ মাথায় তনুকাকে দেখেই বিস্তর হাসল। এগিয়ে এসে সম্মুখে দাঁড়াল। মৃদু আওয়াজে শুধাল,

‘আমার অপেক্ষায় ছিলে বুঝি, বিবিজান?’

তনুকা তাকে পরখ করে বলল,

‘ক্লান্ত লাগছে আপনাকে।’

কিঞ্চিৎ হাসল মেহতাব। বলল,

‘জরুরি এক কাজ সেরে এলাম তো, তাই।’

‘ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হোন। আমি রেনুর রুমে যাচ্ছি।’

‘উঁহু। রেনু এই সময় পড়াশোনা করে, ওকে বিরক্ত করার কী দরকার? তুমিও রুমে আসো।’

মেহতাবের পেছন পেছন তনুকাও ফের এল কক্ষে। মেহতাব সোজা গোসলখানা থেকে গোসল করে বের হলো। তার গাঢ় কৃষ্ণাভ চুল থেকে তাই পানি পড়ছে টপটপ করে। তনুকা জিজ্ঞেস করল,

‘এই সময় গোসল করলেন যে?’

‘খুব ক্লান্ত লাগছিল। গোসল না করলেই না, তাই সেরে ফেললাম।’

‘কাকারা ফিরেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

মেহতাব চুল মোছার তোলায়েটা বারান্দায় মেলে এসে তনুকার পার্শ্বে বসল। জিজ্ঞেস করল,

‘মন খারাপ?’

তনুকা চাইল তার দিকে। গোসল করার পর যেন লোকটার চোখ মুখ আরো স্নিগ্ধ লাগছে। ভেজা চুলে আকর্ষণীয়ও লাগছে বোধ হয়। শ্যামলা রঙের এই নিখুঁত চেহারার লোকটি নির্দ্বিধায় যেকোনো নারীর হৃদয় হরণের একমাত্র কারণ হতে পারে। তনুকা নিমিষ চেয়ে থেকে ঢোক গিলল। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না।’

‘কেন?’

মেহতাব চোখের দৃষ্টি সরু করে জিজ্ঞেস করল। তনুকা মুখ ঘুরিয়ে বলল,

‘এমনি।’

উত্তরে ফিচেল হাসল মেহতাব। বলল,

‘সবাই বলে আমার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি থেকে নাকি কিছুই আড়াল করা যায় না; সব এখানেই ধরা পড়ে। তবে কি তুমিও কিছু ধরা পড়ার ভয় পাচ্ছো নাকি?’

তনুকা বিরক্ত চোখে চাইল। বলল,

‘জি না, আমার কোনো কিছুতেই কোনো ভয় নেই। এমনিতেই বলছিলাম। যাকগে সেসব, আপনার যদি এখন কোনো কাজ না থাকে তবে আমার একটা কথা রাখুন।’

‘বলো।’

‘আমাকে একবার আপনার বাবার সাথে দেখা করান। উনার সাথে আমার এখনও পরিচয় হয়নি। মা বলেছেন, আপনি নাকি দেখা করাবেন।’

‘এখনই দেখা করবে?’

‘জি।’

‘ঠিক আছে, চলো।’

মেহতাব উঠে দাঁড়াল। গায়ে জড়াল একটা সাদা রঙের মোটা শাল। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পেছন পেছন এগোল তনুকা। তিন তলায় উঠল তারা। এইদিকে তনুকার আসা হয়নি। এই তলায় উঠতেই এক বড়ো বারান্দা, যার চারদিকে চারখানা কক্ষ। সবগুলোতে তালা মারা, কেবল একটা ব্যতিত। সেই কক্ষের সামনেই এসে দাঁড়াল মেহতাব। তার পেছনেই তনুকা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সবকিছু। মেহতাব দরজাটা আস্তে করে খুলল। ভেতরে প্রবেশ করল। তনুকাও এল তার পেছন। ভেতরে যেতেই অবাক হলো সে। মনে হলো যেন, পুরো জমিদার বাড়ি একদিকে আর এই কক্ষ আরেকদিকে। এত চমৎকার ভাবে সাজানো সবকিছু! জমিদার বংশের সমস্ত গৌরব যেন এই রুমেতেই বন্দি। আশপাশের নজর সরিয়ে দৃষ্টি গিয়ে থামল বিশাল পালংকে শায়িত এক বৃদ্ধের উপর। তনুকা বিস্মিত হলো। এই বৃদ্ধ’ই কি মেহতাবের বাবা? মেহতাব তনুকার দিকে চাইল। বলল,

‘তনু, উনিই আমার আব্বা, মোহন লাল মজুমদার।’

তনুকা ভালোমতো দেখল। বার্ধক্যে জর্জরিত এক সংকুচিত প্রাণ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না তার। তবে কোথাও একটা যেন জমিদারের সেই জৌলুসটা রয়েই গিয়েছে। তনুকা আস্তে করে ডাকল,

‘বাবা!’

তবে সাড়া এল না কোনো। তনুকা মেহতাবের দিকে চাইল। জিজ্ঞেস করল,

‘বাবার কী হয়েছে?’

‘পক্ষাঘাতগ্রস্থ।’

তনুকা চিন্তিত চোখে চাইল। মনোযোগ দিল তার শ্বশুরের মুখপানে। জিজ্ঞেস করল,

‘এখন কি ঘুমাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা, উনি মা’র সাথে মায়ের রুমে কেন থাকেন না?’

‘এখানে উনার জন্য দুজন পুরুষ সেবক আছেন। মায়ের রুমে সর্বক্ষণ তো আর দুজন পুরুষ সেবক থাকতে পারবে না, তাই এখানেই রাখা হয়েছে।’

তনুকা ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ। উনি কি কথাও বলতে পারেন না?’

‘না।’

‘কী হয়েছিল উনার?’

‘ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন।’

‘ডাক্তার কী বলেছেন, সুস্থ হতে কতদিন লাগবে?’

‘ডাক্তার তেমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।’

তনুকা ফের চাইল মানুষটার মুখের দিকে। কেন যেন মায়া হলো তার। রেনু তো বলেছিল, তার বাবা ভীষণ ভালো মানুষ। যদিও ভালো মানুষের মুখে লেখা থাকে না যে, তিনি ভালো মানুষ; তাও এই মানুষটার মুখ দেখেই তাঁকে নির্দ্বিধায় ভালো মানুষের উপাদি দিতে ইচ্ছে করছে।

মেহতাব বলল,

‘চলো এবার।’

‘বাবাকে একবার ডেকে দিবেন?’

‘কেন?’

‘বাবা তো আমাকে দেখেননি। উনি উনার ছেলের বউ দেখবেন না?’

‘বাবাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে, এখন জাগালে আর ঘুমাবেন না। পরে আবার এসে দেখে যেও।’

তনুকা উঠে দাঁড়াল। বলল,

‘ঐ সেবকরা কোথায়?’

‘আছে বাইরে। আমরা আসব বলে বাইরে পাঠানো হয়েছে।’

‘বাবাকে আজ থেকে আমিই তিনবেলা খাবার দিব।’

মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘কেন?’

সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তনুকা উল্টো বলল,

‘বাবার খাবারের লিস্টটা আমাকে দিয়েন তো।’

‘তুমি পারবে না, তনু। এসব সেবকদের কাজ, ওরা ঠিক সামলে নিতে পারবে।’

‘বাড়িতে উনার এত আপনজন থাকতে, উনি বাইরের মানুষের কাছ থেকে সেবা নিবেন কেন?’

মেহতাব হয়তো বিরক্ত হলো। কপালের কুঁচকে যাওয়া অংশ তারই জানান দিচ্ছে। সে বলল,

‘ঠিক আছে, আমি মা’র সাথে আগে কথা বলে নেই।’

তনুকা অবাক হলো তাতে। ভাবল,

‘এই ছোট্ট একটা ব্যাপারেও মায়ের সাথে কথা বলতে হবে কেন?’

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here