প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৪।

0
185

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।

মধ্যাহ্নভোজ করতে বসেছে সবাই। সকলের দৃষ্টি তাই খাবারের প্লেটে। তনুকা ধীরে ধীরে খাচ্ছে। তার উল্টো দিকের এক চেয়ারে মতিব মজুমদার বসা। তিনিও খাচ্ছেন। বরাবরের মতোই বড়ো চেয়ারে বসেছে মেহতাব। খাবার খাওয়ার মাঝেই একবার মতিব মজুমদারের দিকে চেয়েছে সে। তখনই মনে হয়েছে, মতিব মজুমদারের গুপ্ত দৃষ্টি তনুকার উপর। সে রা করল না কোনো। খাবার খেয়ে নিল নিঃশব্দে। তনুকা খুব বেশি খেল না। অল্প খাবার খেয়েই জিজ্ঞেস করল,

‘মা, বাবাকে খাবার দিয়ে আসব?’

আম্বিরা বেগম চাইলেন তার দিকে। বললেন,

‘লতা রান্নাঘরে খাবার রেখে দিয়েছে, দিয়ে এসো।’

তনুকা উঠে চলে গেল। মেহতাব মুখের খাবারটা হজম করে গম্ভীর সুরে বলল,

‘আজ রাত থেকে ছোট কাকা নিজ কক্ষে খাবেন, এটা আমার আদেশ।’

মেহতাবের কথা শুনে খাবারের ছন্দ পতন হলো সকলের। সবাই ড্যাবড্যাব করে চাইল। আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকে চেয়ে বললেন,

‘কী হয়েছে, মেহতাব? হঠাৎ এই আদেশ?’

‘আম্মা, আপাতত আমি কোনো কৈফিয়ত দিতে চাইছি না। যা বলেছি তাই যেন হয়। ছোট কাকাকে যেন আর খাবার ঘরে টেবিলে বসে খেতে না দেখি।’

মতিব মজুমদারের চোয়াল শক্ত হয়ে এলেও মুখে শব্দ করলেন না। তবে গর্জে উঠলেন তাঁর স্ত্রী, রাহীলা। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন,

‘কী শুরু করেছ তুমি? আর কত অত্যাচার করবে আমাদের উপর? ভাইজান অসুস্থ হবার পর থেকেই শুরু করেছ, কেন করছো এমন? কী করেছি আমরা?’

তিনি রাগে এমন ভাবে ফোঁস ফোঁস করছেন যেন, সাপ হলে এক্ষুনি মেহতাবকে ছোবল দিয়ে বসতেন। মেহতাবের মাঝে কোনো ভাবান্তর আসে না। সে বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। খেয়ে যাচ্ছে চুপচাপ। রাহীলা আরো জ্বলে উঠলেন তাতে। কর্কশ সুরে বললেন,

‘এমন করলে আমরা এই মহল ছাড়তে বাধ্য হব কিন্তু।’

‘আহ রাহীলা, কী শুরু করলে?’

মতিব মজুমদার ধমকে ওঠলেন। তাঁর স্ত্রী মূর্খ বড্ড। এই মহলকে হাত করার এত ফন্দি আঁটছেন তিনি, অথচ এই বোকা মহিলা কথায় কথায় মহল ছাড়ার হুমকি দেয়। মনে হয় যেন, তাঁর হুমকিতে সকলে ভয়ে কুপোকাত হয়ে যাচ্ছে।

মেহতাব উল্টো মৃদু হেসে বলল,

‘আপনাদের বিদায়ের জন্য আমরা সবসময় প্রস্তুত।’

অপমানে শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠল ততক্ষণাৎ। রাহীলা দাঁতে দাঁত চেপে চাইলেন মতিব মজুমদারের দিকে। মতিব মজুমদার ইশারায় শান্ত হতে বললেন তাঁকে। রাহীলাও উপায়ান্তর না পেয়ে অগত্যাই নিজেকে কোনোরকমে গুটালেন। মতিব মজুমদার হেসে বললেন,

‘কাকার উপর এত রাগ কেন জানতে পারি?’

‘যে জেনেও না জানার ভান করে, তাকে আর নতুন করে কী জানাব বলুনতো?’

মেহতাব উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে আরেকবার বলল,

‘আমার আদেশের যেন কোনোপ্রকার হেরফের না হয়।’

মেহতাব চলে যেতেই আম্বিরা বেগম প্রশ্ন করলেন,

‘মতিব ভাই, কী হয়েছে বলবেন আমায়?’

মতিব মজুমদারও দাঁড়িয়ে পড়লেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

‘সেটা আপনার ছেলের কাছ থেকে জেনে নিবেন, ভাবিজান।’

চলে গেলেন তিনিও। রাহীলা খাওয়া রেখে এবার মরা কান্না জুড়ে বসল। তাতে প্রচন্ড বিরক্ত হলো, উপস্থিত বাকি সব মানুষ। তাঁরা যে মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার না সেটা আম্বিরা বেগম প্রথম থেকেই জানেন। আর যায় হোক, লোভ তাঁদের শিরায় শিরায় মিশে গিয়েছে। আর সেই নিয়েই হয়তো চাচা ভাতিজার মাঝে এত দ্বন্দ্ব, তাই ব্যাপারটাও কারোর আন্দাজের বাইরে নয়।

__________

‘বাবা, খাচ্ছেন না কেন? এমন করলে সুস্থ হবেন কী করে?’

কোনোরকমে দুই চামচ নরম ভাত শ্বশুরকে খাওয়াতে পেরেছে তনুকা। কিন্তু তার পর থেকেই মানুষটা আর খাচ্ছে না। ঠোঁট চেপে ঝিম মেরে শুয়ে আছে। তনুকা চেয়েও হা করাতে পারছে না। সে হতাশ গলায় বলল,

‘আপনার কি খাবার পছন্দ হয়নি? অন্য কিছু বানিয়ে আনব?’

লোকটি তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। তনুকার নিকট এই দৃষ্টির অর্থ বোধগম্য নয়, তাই বুঝতে পারছে না কী করবে। সে খাবারটা নাকের কাছে নিয়ে একবার শুঁকল। ততক্ষণাৎ একটা তীব্র ঘ্রাণ গিয়ে ঠেকল নাকে। কীসের ঘ্রাণ আচমকা ধরতে পারল না। লাউয়ের ঝোল দিয়ে নরম ভাত। এই ঘ্রাণ কোনো তরকারির না। কেমন একটা যেন ঔষধ ঔষধ গন্ধ। তনুকা অল্প একটু খাবার মুখে নিল। খাবারটা গলাধঃকরন করতেই ভীষণ বিদঘুটে ঠেকল তার। এত বিশ্রী স্বাদ কেন এই খাবারের? সে চাইল তার শ্বশুরের মুখ পানে। মনে হলো যেন, ঐ ঘোলাটে চোখ যুগল কিছু বলছে তাকে। তনুকা চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,

‘আমি আবার খাবার বানিয়ে নিয়ে আসছি, বাবা। একটু অপেক্ষা করুন।’

তনুকা দ্রুত বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে আবার ভাত বসাল। তরকারি পাতিল থেকে খেয়ে দেখল, সেখানে ঐ গন্ধটা আর করছে না। নরম ভাতের সাথে লাউয়ের ঝোল ভালোমতো মেখে আবার ছুটল শ্বশুরের রুমে। তবে এখন যেতেই দরজার দুই সেবক প্রহরী পথ আটকাল তার। তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কী ব্যাপার, পথ আটকাচ্ছেন কেন?’

‘সাড়ে তিনটার ভেতরে জমিদার সাহেবকে খাবার দিতে হয়, এরপরে আর কাউকে অনুমতি দেওয়া হয় না।’

তনুকা ক্ষিপ্ত হলো ভীষণ। তেতে উঠে বলল,

‘এই অদ্ভুত নিয়ম কার?’

‘বড়ো মাতা’র।’

‘বড়ো মাতা কে?’

‘মেহতাব বাবুর আম্মাজান।’

তনুকা অবাক হলো। এটা কেমন অদ্ভুত নিয়ম। সাড়ে তিনটার পর খাবার কেন দেওয়া যাবে না? তনুকা বলল,

‘সমস্যা নেই। মা কিছু বলবেন না। দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।’

প্রহরী দুজন মাথা নুইয়ে বলল,

‘ক্ষমা করবেন।’

‘আশ্চর্য, বাবা কি এখন না খেয়ে থাকবেন? সরে দাঁড়ান, বললাম তো।’

‘মাতার হুকুম অমান্য করতে পারব না।’

‘মা নিশ্চয়ই চাইবেন না, উনার অসুস্থ স্বামী না খেয়ে থাকুক? অযথা কথা না বাড়িয়ে যা বলছি তাই করুন। সরুন।’

ছেলে দুজন সরল না। তনুকা আকস্মিক ক্ষিপ্ত হলো অনেক। রাগে আওয়াজ করে বলল,

‘আমার হুকুম অমান্য করার সাহস হয় কী করে আপনাদের? সরে দাঁড়াতে বলছি, নয়তো মেহতাবকে বলে আমি আপনাদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করব।’

এবার হয়তো ভয় পেল দুজন। ঢোক গিলে একে অন্যকে দেখল তারা। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় মেহতাব। তাকে দেখা মাত্রই ছেলে দুজন দুদিকে সরে দাঁড়ায়। মেহতাব এসে প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কী হচ্ছে এখানে?’

মেহতাবের গলা পেয়ে ফিরে তাকায় তনুকা। রাগের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত করে বলে,

‘উনারা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।’

মেহতাব ছেলে দুটোর দিকে তাকাতেই তারা তরতর করে কেঁপে উঠল যেন। একজন কম্পিত সুরেই বলল,

‘এটা মাতা’র আদেশ ছিল।’

‘এই আদেশ আমার বিবিজানের জন্য কার্যকর নয়। আর যেন ভুলে এমন কিছু করতে না দেখি।’

ছেলেগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। মাথা নাড়াল দুই দিক ঝাঁকিয়ে। মেহতাব বলল,

‘এবার ভেতরে যাও, বিবিজান।’

তনুকা ভেতরে প্রবেশ করল। পেছন পেছন এল মেহতাবও। মোহন লাল মজুমদার তার দিকেই চেয়ে আছেন যেন, এতক্ষণ তার’ই অপেক্ষায় ছিলেন। তনুকা এবার খাবার তুলতেই সহসাই খেয়ে নিলেন তিনি। তাতে আরেকদফা অবাক হলো তনুকা। তবে কিছু বলল না। শ্বশুরকে ভালো মতো খাইয়ে দাইয়ে চলে এল নিজের কক্ষে। এসেই মেহতাবকে বলল,

‘ঐ ছেলে দুটোকে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না, ওদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিন।’

‘তাহলে আব্বাকে কে দেখবে?’

‘আমি দেখব।’

মেহতাব বিছানায় বসতে বসতে বলল,

‘আব্বা বিছানায় প্রসাব পায়খানা করেন, সেসব কি তুমি পরিষ্কার করতে পারবে?’

তনুকা থামল। ভাবল, স্বামীর এই কাজগুলো করা কি স্ত্রীর দায়িত্ব না? তবে মা কেন করছেন না? যদি নিজের খারাপ সময়ে প্রিয় মানুষকে কাছেই না পেলেন তবে, এই নাম মাত্র প্রিয় মানুষের আর কীসের প্রয়োজন? তনুকা ভেবে বলল,

‘ঐ ছেলেগুলোকে ছাড়িয়ে দিন, আমি নিজে অন্য দুজন সেবক খুঁজে নিয়ে আসব।’

‘ঠিক আছে, ছাড়িয়ে দেব।’

তনুকা বসল। রয়ে সয়ে বলল,

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘করো।’

‘বাবার খাবারে ঔষধের গন্ধ করছিল কেন?’

মেহতাব বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। পা লম্বা করে রাখল তনুকার কোলের উপর। তাতে কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়ল তনুকার। তার অমন ভাঁজ করা কপাল দেখলে মেহতাবের কেমন যেন সুখ সুখ লাগে। সে বলল,

‘ডাক্তার একটা ঔষধ খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে বলেছিলেন, হয়তো সেই ঔষধের গন্ধ’ই পাচ্ছিলে।’

তনুকা বিস্মিত হলো খানিক। বলল,

‘আমি তো সেই খাবার খাওয়াইনি। নতুন বানিয়ে নিয়েছি।’

‘কেন?’

‘মনে হচ্ছিল, নষ্ট খাবার। তাই…’

‘থাক, পরের বার খেয়াল রাখলেই হবে।’

‘আচ্ছা, আমাকে একবার বাবার ঔষধগুলোও দেখিয়ে দিয়েন, তখন আর ভুল হবে না।’

‘ঠিক আছে। এখন এদিকে এসো, তোমাকে একটা প্রেমের গল্প শোনাই।’

‘প্রেমের গল্প?’

তনুকা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। মেহতাব বলল,

‘হ্যাঁ, আমার আম্মা আর আব্বার প্রেমের গল্প। তুমি জানো, আমার আব্বা কিন্তু হিন্দু তবে আম্মা মুসলিম….’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here