#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।
মায়ের সিদ্ধান্তে মেহতাব ভীষণ সন্তুষ্ট। সন্তুষ্ট মেঝ কাকা আর মেঝ কাকীও। তবে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন রাহীলা। মুখ দেখে সহসাই অনুমান করা যাচ্ছে তা। মেহতাবের আদেশ মতো ছোট কাকা, মতিব মজুমদার সেখানে অনুপস্থিত। থাকলে হয়তো কিছু তীক্ষ্ণ বাণী ছুড়তে তিনি আর বিলম্ব করতেন না।
সবার সম্মতি পেয়ে তনুকা কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করল। আর তাছাড়া মনে হলো, মেহতাবের কাছ থেকেও বড়ো রকমের সাহায্য সে পাবে, তাই আর সে এসব নিয়ে চিন্তা করল না।
নিজের খাওয়া শেষ করে খাবার নিয়ে গেল শ্বশুরের কক্ষে। এবার দরজায় দাঁড়ান প্রহরী দুজন অপরিচিত ঠেকল তার। প্রহরী দুজন তনুকাকে দেখেই মাথা নত করল। তনুকা জিজ্ঞেস করল,
‘আপনারা কারা?’
‘জমিদার বাবু আজই আমাদের কাজে রাখলেন।’
তনুকার তখন মনে পড়ল, সে মেহতাবকে সেবক বদলানোর কথা বলেছিল। তার কথার বিপরীতে মেহতাবের এত দ্রুত পদক্ষেপ দেখে খুশি না হয়ে পারল না সে। বলল,
‘ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি।’
তনুকা ভেতরে চলে আসে। বিছানার পাশের টেবিলে খাবার রেখে নিজে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। তারপর আস্তে করে ডাকে,
‘বাবা।’
মোহন লাল মজুমদার চোখ মেলে চাইলেন। মুখে কিছু না বললেও চোখ দেখে বোঝা গেল, তিনি তনুকাকে দেখে তৃপ্ত হয়েছেন। তনুকা মৃদু হেসে বলল,
‘আপনার খাবার নিয়ে এসেছি, বাবা।’
তনুকা যত্ন সমেত খাইয়ে দিল তাঁকে। খাবার শেষ করে বলল,
‘খাবারের পর ঔষধ আছে নিশ্চয়ই? আপনার ঔষধগুলো কোথায় রাখা?’
প্রশ্ন করে নিজেই খুঁজতে আরম্ভ করল। কিন্তু রুমে কোথাও পেল না ঔষধ। তাই হাঁক ছাড়ল,
‘শুনছেন, একজন ভেতরে আসুন।’
তড়ঘড়ি করে তখন একজন প্রহরী ভেতরে আসে। মাথা নত অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু লাগবে, ছোট মাতা?’
“ছোট মাতা” সম্বোধনে অবাক হলো তনুকা কিন্তু, বলল না কিছু। শুধু বলল,
‘মেহতাবকে একটু ডেকে নিয়ে আসুন।’
প্রহরী মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে সেদিকেই ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহতাবকে নিয়ে হাজির হলো সে। মেহতাব জিজ্ঞেস করল,
‘কোনো সমস্যা, বিবিজান?’
‘বাবার ঔষধ পাচ্ছি না।’
‘ঔষধ আম্মার কাছে। আম্মা একটু পর এসে ঔষধ দিয়ে যাবেন।’
তনুকা এক পল ভেবে বলল,
‘ঠিক আছে তবে, আমি বরং মা’কে ডেকে নিয়ে আসি।’
‘আম্মা সময় হলে চলে আসবে, তনু। তুমি এখন ঘরে চলো। আর আব্বারও বিশ্রামের প্রয়োজন।’
তনুকা শ্বশুরের মুখপানে চাইল। তিনি চোখ পিটপিট করে কথা বলতে চাইছেন যেন। চোখের অস্থিরতা যেন অন্য কিছু বলতে চাইছে কিন্তু, মূর্খ মানুষ কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। তনুকা বলল,
‘আচ্ছা, চলুন।’
তনুকা বাইরে যাওয়ার আগে দক্ষিণের জানলাটা আটকে দিয়ে গেল। রুমে এসে কাপড় ভাঁজে মনোযোগ দিল সে। ছাদের কাপড় লতা নিয়ে এলেও তনুকা তাকে আর ভাঁজ করতে দেয়নি। কিছু কাজ অন্যকে দিয়ে করালে ঠিক মনঃপূত হয় না, এই যেমন এই কাজটাও।
কাপড় ভাঁজ করে আলমারির সামনে দাঁড়াল তনুকা। আলমারির পাশেই রুমের বড়ো জানলাটা। যেখান দিয়ে প্রত্যহ বাতাস আসে খুব। এখনও তাই। আলমারিতে কাপড় তুলে জানলার মুখে দাঁড়ায়। মেহতাব ফোনে কী যেন করছে। তনুকা বিভ্রান্তের মতো আকাশ পানে চায়। একটা চ্যাপ্টা রূপালি চাঁদের অংশ সেখানে প্রতীয়মান। তাতেই আকাশতল ঝলমল করছে যেন। তনুকা বিভোর চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ বলে উঠে,
‘অপনার প্রতি মনে এত দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও কেন যেন আপনাকেই বড্ড ভরসা করতে ইচ্ছে করছে। কী অদ্ভুত অনুভূতি! দ্বিধা কাটাতে পারছি না, এইদিকে মন সব আশা ভরসা আপনার উপরেই বর্তাতে চাইছে। কী করি বলুন তো? যদি বিশ্বাস করে ঠকে যাই, ভয় হয় তো।’
মেহতাব বিমূঢ় চেয়ে রয় কতক্ষণ। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে,
‘এত অবিশ্বাস তোমার? তাহলে আজীবন থাকবে কী করে?’
‘অবিশ্বাস না করে কি আর কোনো উপায় আছে? আমার বিয়েটাই আমার জীবনে এক চরম অবিশ্বাস্য মুহুর্ত। হুট করেই নিজেকে অচেনা অজানা একজন মানুষের সাথে জড়িয়ে ফেলাটা কি অবিশ্বাস্য কিছু না? আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না।’
মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জিজ্ঞেস করল,
‘তবে কী চাও তুমি? ছেড়ে দেই তোমায়? মুক্ত হতে চাও?’
অকস্মাৎ বক্ষঃস্থলের কম্পন বাড়ে তনুকার। অস্থির গলায় বলে,
‘না না, আমি তা কখন বললাম। আপনি আমার বিশাল দ্বন্দ্ব হলেও আমি আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাই না, মেহতাব।’
ব্যস এইটুকুই। আর কিছু শোনায প্রয়োজন নেই মেহতাবের। মনের সমস্ত সংশয় নিমিষেই উবে যায়। প্রকান্ড সাহস ঝলমলিয়ে ওঠে। মনে হয়, এই তো এই কথাগুলো শুনতেই তো এত প্রতীক্ষা তার। অবশেষে সে সফল।
বাইরের বাতাসে তনুকার ওড়না উড়ছে। উড়ছে খোঁপা ভাঙা নিকষ কালো চুলও। তাকে পেছন থেকে দেখেও মন বড্ড আশকারা পেতে চাইছে মেহতাবের। সে উঠে এগিয়ে এল। পেছনে না ফিরেও মেহতাবের উপস্থিতি ঠিকই টের পেল তনুকা। মেহতাবের হাতের বাঁধন সহসাই জড়িয়ে নিল তাকে। তার চিবুক নিয়ে ঠেকাল ঘাড়ের উপর। প্রশ্বাসের উষ্ণ ছোঁয়ায় তনুকার শরীরে জাগল শিহরণ। মেহতাব বিলম্ব করে না আর। চুল সরিয়ে ওষ্ঠ ছোঁয়াল ঘাড়ে। কেঁপে উঠে তনুকা। নিজেকে পরক্ষণেই শক্ত করে ফেলে। না, ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি তার নেই। স্বামী তার, অধিকার আছে। তনুকা চোখ বুজে। মেহতাব তার খোলা চুলে চুম্বন করে। তারপর সরে এসে সাথে দাঁড়ায়।
‘যেদিন তোমার মনে হবে, আমার ভালোবাসায় খাদ আছে সেদিন আমি নিজেই তোমাকে মুক্ত করে দিব। তবে তার আগ অবধি নিজের সবটুকু দিয়ে এইটুকু জাহির করে যাব যে, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা খাদহীন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই।’
তনুকা চেয়ে দেখল, লোকটার চোখগুলো চিকচিক করছে। সত্য বলছে, তা প্রমানিত। কারণ মানুষের হৃদয়ের সবচেয়ে বড়ো দর্পন তার চোখ। চোখ দেখলেই মন পড়া যায়।
প্রসন্ন হাসল তনুকা। সামনে চেয়ে বলল,
‘আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনার চোখ দেখে বিশ্বাস না করার উপায় নেই। তবে আপনি চাইলেই স্বামী অধিকার খাটাতে পারেন, আমি বাঁধা দিব না।’
কিঞ্চিৎ হাসল মেহতাব। বলল,
‘আমার সুখ হবে সেদিন, তুমি নিজ থেকে সন্নিধানে ডাকবে যেদিন। তার আগ অবধি, আমি তোমার নিকটস্থ কখনোই হব না।’
এই কথা শুনে তনুকা ফ্যালফ্যাল করে চাইল। পুরুষ মানুষ সম্পর্কে ধ্রুব ধারণার ব্যাঘাত ঘটল যেন। হুট করেই মনে হলো, সে পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার পুরুষের বিবি নয়তো? যাকে কাছে পেয়েও মর্ম দিচ্ছে না?
তনুকা চেয়ে রইল কেবল, কিছু বলল না। মেহতাব হাই তুলে বলল,
‘শু’তে আসো, বিবিজান। ঘুম পাইতেছে খুব।’
মেহতাব বিছানার দিকে পা বাড়ায়। তনুকা ফিরতে নিয়েও হঠাৎ কী দেখে যেন দাঁড়িয়ে যায়। ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখে, বেশ দূরে দুজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে। তনুকা অবাক হয়। এত রাতে এখানে দুজন মানুষ কী করছে? ছায়া দেখে মানুষ চেনার উপায় নেই। সে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও চিনতে পারল না। মেহতাব তনুকার মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপার, বিবিজান? আসো।’
তনুকা ফিরে চাইল। গম্ভীর সুরে বলল,
‘ঐখানে দুজন মানুষ।’
কপাল কুঁচকাল মেহতাব। জিজ্ঞেস করল,
‘কোনখানে?’
‘গেইটের সামনে বড়ো গাছের পেছনে।’
মেহতাব উঠে এল। তবে সে আসার আগেই ছায়াযুগল মিলিয়ে গেল যেন। মেহতাব ভালো মতো সব দেখে বলল,
‘কোথায় তনু? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’
তনুকাও চেয়ে দেখল, অদ্ভুত ভাবে সামনে কোনো ছায়া নেই। সে মেহতাবের দিকে চেয়ে অস্থির গলায় বলল,
‘আমি মাত্র দেখেছি, ঐ গাছের পেছনে দুজন মানুষের ছায়া ছিল।’
মেহতাব স্মিত সুরে বলল,
‘ভুল দেখেছ, বিবিজান। হয়তো ওটা কোনো গাছের ছায়া ছিল।’
‘না না। আমি স্পষ্ট দেখেছি, ওটা মানুষের ছায়া।’
‘কোথায় তবে? আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
‘এতক্ষণ তো ছিল, হুট করে কোথায় চলে গিয়েছে বুঝতে পারছি না তো।’
মেহতাব ছোট্ট শ্বাস ফেলে তনুকার গালে হাত রাখল। বলল,
‘এত ভেবো না। ভুল দেখেছ তুমি। আমার মহলে যথেষ্ঠ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই।’
‘কিন্তু…’
সঙ্গে সঙ্গেই তনুকার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে মেহতাব বলল,
‘আর কোনো কথা না, ঘুমাতে এসো। ঘুমালে মাথা থেকে এসব চলে যাবে।’
চলবে….
ছবি: রত্নাবু ❤️