প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৮।

0
84

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।

রাতে ঠিকঠাক মতো ঘুম হয়নি তনুকার। মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল বিচরণ করে চলছিল ঐ ছায়াযুগল। কারা ছিল ঐ দুজন মানুষ? মেহতাব আসার সঙ্গে সঙ্গে কেনই বা তারা মিলিয়ে গেল? এই সবটাই কি তার একটা ভ্রম? এত বিরাট একটা ব্যাপার কি সত্যিই সামন্য একটা ভ্রম হতে পারে? না কি এর পেছনেও রয়েছে কোনো রহস্য?

অন্যদিন সকালের নাস্তাটা সবার আগেই সেরে মেহতাব বিচার মহলে চলে যায়। তবে আজ আর তেমন কিছু হয়নি, সকলের সাথেই টেবিলে নাস্তা করতে বসেছে সে। টেবিলে সাজানো নাস্তার পদের শেষ নেই। সবাই গভীর মনোযোগে খেলেও, তনুকার মনোযোগ সেদিকে নেই। সে এখনো রাতের প্রত্যক্ষকৃত ঘটনায় বিভোর। খাবার মাঝেই মেহতাব তাকে এক দুবার পরখ করে। হুট করেই তাই রাহীলাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে বসে,

‘কাকী, রাতে কাকা কোথায় ছিলেন?’

খাবারের মাঝে আচমকা এমন প্রশ্নে প্রথমে খাটিকটা ভড়কে যান রাহীলা। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলে বলেন,

‘তোমার কাকা তো রুমেই ছিল, কেন?’

‘পুরো রাতে কি একবারও রুম থেকে বের হননি?’

কাকী কপাল কুঁচকে বললেন,

‘না তো, কী হয়েছে বলবে?’

‘কিছু না।’

মেহতাবের “কিছু না” শুনে কাকী ক্ষুব্ধ হলেন বেশ। হুট করেই এসব প্রশ্ন করে তাকে চিন্তায় ফেলে, এখন বলছে কিছু না; তবে এত প্রশ্ন করার কী প্রয়োজন ছিল? মেহতাব না চাইলে জবাব তিনি জীবনেও পাবেন না বলে বৃথা চেষ্টা আর করলেন না। ক্ষিপ্ত হয়ে মনোযোগ দিলেন খাবারে। খাবার টেবিলের বাকি মানুষজন কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাদের দেখে আবার নিজেদের খাবারে মনোযোগ দেয়। তনুকা এক পল অবাক হয়ে ভাবে, “মেহতাব কি এসবের জন্য কাকাকে সন্দেহ করছেন? কিন্তু কাকা এমন কিছু কেন করবেন?”

_____________

শ্বশুরমশাইয়ের রুমে গিয়ে দেখল, তিনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তনুকা বেশ কিছুক্ষণ ডেকেও তাঁকে জাগাতে পারল না। তাই বাইরের প্রহরীদের বলে এল, তিনি উঠলে যেন তাকে জানানো হয়।

,

চুলে ফিতা বাঁধছে রেনু। আয়নায় অমনোযোগী দৃষ্টি তার। নাক মুখ শুষ্ক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়ের ভারি মন খারাপ। তাই তনুকার উপস্থিতিটাও ধরতে পারল না সে। তনুকা বেশ কিছুক্ষণ তাকে পরখ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার পিচ্চি ননদিনীর কি আজ মন খারাপ?’

চকিতে ফেরে রেনু। তনুকাকে দেখে কিঞ্চিৎ হাসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হাসিটা ভীষণ মেকি। তনুকা ফের জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?’

রেনু সামনে ফিরে চাইল। আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,

‘আমি কি সত্যিই খুব পিচ্চি, বউমনি?’

এমন প্রশ্নে খানিকটা অবাক হলেও তনুকা হেসে জবাবে বলল,

‘পিচ্চিই তো। সবে ক্লাস টেনে পড়ো, এইটুকু একটা মেয়ে।’

‘অথচ আমার ক্লাসের বেশ কিছু মেয়ের বিয়েও হয়ে গিয়েছে, দুইজনের তো আবার বাচ্চাও আছে। আর তোমরা আমাকে পিচ্চি বলো।’

অভিমানী শুনালো তার সুর। তনুকা হাসল। বলল,

‘আর কে পিচ্চি বলে তোমায়?’

‘ঐ বদ লোকটাও, উনি তো…’

থেমে গেল রেনু। টনক নড়ল আচমকা। ইশ, কী বলে ফেলছিল সে? জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠে,

‘কিছু না।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘এই বদ লোকটা আবার কে?’

‘কেউ না কেউ না, বউমনি। আমি এমনিই বলছিলাম। আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে, নয়তো ক্লাস ধরতে পারব না। যাচ্ছি আমি।’

বলেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুট লাগাল সে। এমন ভাবে ছুটল যেন, পুলিশের কাছ থেকে চোর পালাচ্ছে। তনুকা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। মনে মনে আওড়ায়, “মেয়েটা কি প্রেম করছে?”

__________

‘আমার মাইয়াডার কোনো দোষ নাই, বাবু। সব দোষ এই হারাম’জাদার।’

লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলল। তার শিউরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি গর্জে উঠল ততক্ষণাৎ। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘আমরা একজন অন্যজনরে ভালোবাসি। আপনি কেন মানতে চাইতেছেন না?’

‘তোর মতো ফহি’ন্নির পুতের ভালোবাসা আমার মাইয়াই লাগত না।’

ছেলেটি ব্যঙ্গ করে হাসল। বলল,

‘এ্যাঁ, কোথ তে আইছে রাজা বাদশা। নিজেরই কোনো চাল চুলা নাই, আবার আইছে আমারে ফহিন্নি কইতো।’

বৃদ্ধ লোকটি তেড়ে গেলেন। আজ এই ছেলের একটা হেস্তনেস্ত তিনি করেই ছাড়বেন। ছেলেটিও কম যায় না; নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,

‘আমি কাউরে ভয় পাই না, আমার কাছে ভালোবাসাই সব। ভালোবাসার জন্য আমি নিজের জীবন দিতেও এক পায়ে খাড়া।’

বৃদ্ধ লোকটি ছেলেটির গায়ে ঠাস করে চ’ড় বসালেন। তাতে সেই ছেলের বাবা ক্ষেপে উঠলেন খুব। তেড়ে এসে বললেন,

‘এই বুইড়া, তুই আমার পোলার গায়ের হাত তুলছোস কোন সাহসে? দোষ কি আমার পোলার একার? তোর মাইয়া নিজ ইচ্ছাতেই আমার পোলার হাত ধইরা পলায়ছিল, দোষ তোর মাইয়ারও কম না।’

বৃদ্ধ লোক তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘চুপ কর, বেটা। আমার মাইয়ার কোনো দোষ নাই। তোর পোলা যাদু টোনা কইরা আমার মাইয়ারে নিয়া ভাগছিল। সব দোষ তোর পোলার।’

‘খবরদার, আর একটাও বাজে কথা কইলে। শাক দিয়া মাছ ডাকন যায় না। মাইয়ার দোষ স্বীকার কর, বুইড়া।’

বৃদ্ধ আবারও তেড়ে যেতে চাইলেন। এর মাঝেই আওয়াজ তুলল মেহতাব। কর্কশ সুরে বলল,

‘কী শুরু করেছেন আপনারা? এখানে বিচার করার জন্য তো আমি আছি, তাই না? নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা বন্ধ করুন।’

‘বাবু, আপনি কিছু করেন। এই লোকটা আমার ভালোবাসারে আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিতে চাইতেছে।’

‘পালালে কেন তোমরা?’

মেহতাব প্রশ্ন করল। ছেলেটা কাচুমাচু করে বলল,

‘নাহলে ঐ লোক একটা বুইড়া বেটার সাথে মাইয়ার বিয়া দিয়া দিতেন।’

‘মেয়ে কী চায়? তোমার সাথে থাকবে ও?’

‘জি, বাবু। ও আমার সাথেই থাকতে চায়, কিন্তু বাপের জন্য পারে না।’

‘তুমি যে ওকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো তার কী প্রমাণ?’

ছেলেটি চোখ তুলে চেয়ে বলল,

‘কন বাবু, কেমনে প্রমাণ দিতাম? যা কইবেন তাই করমু।’

মেহতাব ক্রূর হাসল। তার পাশে দন্ডায়মান ইশফাকের দিকে চেয়ে বলল,

‘ছুড়ি নিয়ে এসো, ওর বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা কেটে নিবে; এটাই হবে ওর ভালোবাসার নিদর্শন।’

এমন আদেশ শুনে সকলের মাঝে চাপা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল। ছেলেটির বাবা কেঁদে বললেন,

‘বাবু, কী কন এডি? ভালোবাসার জন্য এহন আমার পোলার আঙ্গুল দিতে হইব?’

‘জীবন চাইনি না তো আর, সামান্য আঙ্গুলে আর কী’ই বা যায় আসে? এই ছেলে, আঙ্গুল দিতে পারবে না তুমি?’

ছেলেটি অকপটে বলে উঠল,

‘পারমু, বাবু।’

মেহতাবের মুখে চওড়া হাসি ফুটল। উঁচু গলায় বলল,

‘সাবাস বেটা, সব প্রেমিককে সর্বদা এমনই অকুতোভয় হতে হবে। আজকের পর থেকে কেউ আর তোমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আর হ্যাঁ, একজন কাজী ডেকে নিয়ে এসো; আঙ্গুল কাটার পর পরই ওদের বিয়ে দেওয়া হবে।’

ছেলেটি ভুলে যায় সব ভয়। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার আনন্দ সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার। সে হেসে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। শুধু একটা আঙ্গুল কেন, আজ একটা হাত চাইলেও পিছপা হবে না সে।

আঙ্গুল কাটার ঘটনা মেয়ের কান অবধি চলে যায়। যে মেয়েকে নিয়ে এত কাহিনী, সে মহলের বাইরে আলাদা নজরদারিতে ছিল। যখনই এমন আদেশ শুনেছে, কলিজা শুকিয়ে উঠেছে তার। ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আঙ্গুল চায় না সে। নিজের প্রিয় মানুষের ক্ষতি করে পাওয়া ভালোবাসায় কোনো সুখ নেই। এর জন্য সারাজীবন আফসোস করে মরতে হবে তার। সে ভেবে পাচ্ছে না কী করবে? থামাতে হবে এসব। অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখে। হঠাৎ তার মাথায় আসে, জমিদার বাবুর নববধূর কথা। শুনেছে সেই মেয়ে মারাত্মক সাহসী, জমিদার বাবুর মুখের উপর কথা বলার সাহস আছে তার। তাকে এই মুহুর্তে একমাত্র সে’ই সাহায্য করতে পারে। তার পাশেই প্রহরী দুজন। উপায়ান্তর না পেয়ে দিক বেদিক ভুলে মহলের দিকে ছুট লাগাল সে। প্রহরী প্রথমে বোকার মতো চেয়ে থাকলেও, পরে মেয়ের উদ্দেশ্য টের পেয়ে ছুট লাগায় তারাও। তবে তাকে ধরার আগেই সে সোজা অন্দরে চলে আসে। আর ভাগ্যক্রমে তনুকাকেও পেয়ে যায় একদম বসার ঘরে। তাকে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে, সে’ই জমিদারের নববধূ। তাই বিলম্ব করল না আর, ছুটে গিয়ে পায়ে পড়ল। এক শ্বাসে বলল,

‘আমার ভালোবাসারে বাঁচান, ভাবিজান। বাবু যে তার আঙ্গুল কাটার আদেশ দিছেন।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here