প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩।

0
93

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।

আম্বিরা বেগম অবাক হলেন। বিস্ময় নিয়ে একবার চাইলেন তাঁর মেঝো জা’য়ের দিকে। ব্যাপারটা বোধগম্য না হওয়ায় প্রশ্ন করলেন,

‘কী বলছো, মা? আমরা তোমায় ঠকিয়েছি?’

তনুকা কোনোপ্রকার জড়তা দেখাল না। কঠিন স্বরে বলল,

‘জি, ঠকিয়েছেন। আপনার ছেলে যে এর আগে আরো তিনটে বিয়ে করেছেন, সেটা আপনারা আমার আর আমার বাবার কাছ থেকে লুকিয়েছেন। এটাকে কি ঠকানো বলে না?’

আম্বিরাসহ উপস্থিত সকলের চোয়াল ঝুলল যেন। সবার মাঝ থেকেই বেশ শব্দ করে হেসে উঠল রেনু। তনুকা ভড়কে গেল তার হাসি দেখে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কেবল। রেনু হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে যেন। তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,

‘তুমি হাসছো কেন?’

হাসি থামাল রেনু। তনুকার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল,

‘বউমনি, তুমি না এত শিক্ষিত, বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসেছ; সামান্য একটা মজাও ধরতে পারলে না?’

‘মজা?’

এবার একসঙ্গে বাকি মহিলাগণও হেসে ফেলল। তবে খুব সাবধানে, আওয়াজহীন হাসি। তনুকা বোকার মতো চেয়ে আছে কেবল। আম্বিরা বেগম হাত দিয়ে তার চিবুক চেপে বললেন,

‘বোকা মেয়ে, স্বামীর মজাও বুঝো না?’

তনুকার টনক নড়ল। বলল,

‘কিন্তু, উনি তো খুব সিরিয়াস ভাবে বলছিলেন।’

‘ভাইজান এমনই। ভাইজানের মিথ্যে কেউ ধরতে পারে না।’

রেনু হেসে হেসে বলল। তনুকার মনঃক্ষুন্ন হলো যেন। ঐ লোকটার জন্য এতগুলো মানুষের সামনে বোকা হয়েছে সে। আম্বিরা বেগম বললেন,

‘হয়েছে হয়েছে, এবার যাও নতুন বউকে নিয়ে খেতে বসাও। আমি রান্নাঘরের অবস্থা দেখে আসছি।’

তিনি চলে গেলেন। রেনু সহ বাকি বউরা তনুকাকে নিয়ে খাবার ঘরে এল। বিশাল এক ডাইনিং সেখানে। খাবারের কমতি নেই। রেনু তনুকাকে এক চেয়ারে বসাল। তনুকা জিজ্ঞেস করল,

‘তোমরা কেউ বসবে না?’

‘না বউমনি, আমরা সবাই তোমার পরে খাব। নতুন বউয়ের আগে খেতে হয়, এটাই নিয়ম।’

তনুকার প্লেটে খাবার দেওয়া হলো। এত মানুষ সম্মুখে, খাবে কী করে? অস্বস্তিতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে যেন। এক চিমটি খাবার মুখে পুরে বসে আছে কেবল। বাড়ির মেঝো বউ তখন বলে উঠলেন,

‘কী ব্যাপার, নতুন বউ? কিছুই তো মুখে তুলছো না।’

তনুকা মেকি হাসে। বলে,

‘না না, খাচ্ছি তো। আপনারাও বসে পড়ুন।’

‘আমরা বসব। তুমি আগে খাওয়া শেষ করো।’

তনুকা অতি কষ্ট সমেত অল্প কিছু খাবার গলাধঃকরন করল। অতঃপর উঠে দাঁড়াল সে। বলল,

‘আমার খাওয়া শেষ।’

ছোট বউ আঁচলে মুখ ঢেকে হেসে বললেন,

‘এত অল্প খেলে গায়ে শক্তি হবে কী করে? আর শক্তি ব্যতিত স্বামীকে খুশি করবে কী করে?’

তনুকার কথাখানা পছন্দ হলো না। তাও বলল না কিছু। মেঝো বউ ধমকে উঠলেন ততক্ষণাৎ। বললেন,

‘আহা ছোট, তুই না কাকি শাশুড়ি? তোর মুখে এসব মানায়?’

‘কী করব ভাবি, বেচারির তো আর বড়ো ভাবি নেই; তাই ভাবির হয়ে রসিকতাটা আমিই করে দিচ্ছি। তুমি আবার কিছু মনে করো না, বউ। আমি একটু এমনিই।’

তনুকা ফের হাসল। এখানে আসার পর থেকে কথায় কথায় হাসতে হচ্ছে তাকে। মুখে এবার ব্যথা ধরেছে যেন। ভদ্র সেজে থাকা যে কী কষ্টের!

তনুকা হেসে বলল,

‘না না, কাকি, আমি কিছু মনে করেনি।’

‘আর করলেও আমার কিছু যায় আসে না।’

তিনি দেমাগ দেখিয়ে বললেন যেন। তনুকা বিরক্ত হলো। এটাও হজম করে নিল সে। রেনু বলল,

‘হয়েছে তোমাদের? এবার বউমনিকে আমি আমার রুমে নিয়ে যাচ্ছি।’

মেঝো বউ বললেন,

‘নিয়ে যাও। তবে কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে আসতে হবে কিন্তু; আজ দুপুরের রান্না নতুন বউকেই রাঁধতে হবে।’

কথাটা শুনে ফাটা বেলুনের ন্যায় মুখটা চুপসে যায় তনুকার। দুপুরের রান্না সে রাঁধবে? এত মানুষের রান্না? কীভাবে?
কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে। আঁচলের কোণ দিয়ে সন্তর্পনে মুছে সেটা। ছোট বউ বিদ্রুপের সুরে বলে উঠেন,

‘রান্নার কথা শুনেই ঘাম পড়ছে, আর রান্নাঘরে গেলে কী হবে কে জানে?’

তনুকা তাঁর কথা আমলে নিল না; রেনুর হাত ধরে বলল,

‘চলো, যাই।’

রেনুর সাথে চলল সে। ছোট বউ মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলেন,

‘মেয়ের দেমাগ দেখেছো? বড়োলোকের শিক্ষিত মেয়ে বলে অহংকারে জমিনে পা পড়ছে না যেন, হু।’

‘অহংকার কোথায় দেখলি, ছোট? মেয়েটা তো ভালো।’

‘ঐসব তোমার চোখে পড়বে না, ভাবি। তুমি যদি এসব বুঝতে তাহলে তো চলতোই।’

বলেই মুখ বাঁকিয়ে ছুটলেন তিনি। বাড়ির এক নিরীহ প্রাণী, মেঝো বউ ঊর্মি তাঁর যাওয়ার দিকে চেয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

__________

রেনুর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তনুকার চোখে পড়ল অন্য এক দালান। বাড়ির ঠিক পেছনে। একটাই দরজা, কোনো জানলা নেই। তনুকা অবাক হয়ে রেনুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘এই দালান কার?’

রেনু একপলক দালানটা দেখে বলল,

‘এটা ভাইজানের বিচারমহল। ভাইজান এখানে তাঁর বিচার কার্য চালান।’

তনুকা হাসে। বলে,

‘তাই? তাহলে তো একবার দেখে আসতে হয়, তোমার ভাই কেমন বিচারক।’

রেনু আঁতকে ওঠে। বলে,

‘না না, অন্দরমহলের নারীদের ঐ মহলে যাওয়া নিষেধ। আম্মা ব্যতিত আর কেউই কোনোদিন ঐ মহলে প্রবেশ করতে পারেননি।’

তনুকা এক পল ভেবে বলল,

‘চলো, আজ আমরা যাব।’

রেনু বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,

‘অসম্ভব, ভাইজান আমাদের ঐখানে দেখলে খু’ন করবেন। উনার কথা আমি অমান্য করতে পারব না।’

‘আরে, কিছু হবে না। আমি আছি তো। সব রিস্ক আমার। চলো তুমি।’

রেনু যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু, তনুকার ক্রমাগত জোরাজুরিতে আর নাকচ করেও থাকতে পারল না। লুকিয়ে লুকিয়ে গেল দুজন। দালানের ঠিক সম্মুখ দরজায় একটু আঁড়াল হয়ে দাঁড়াল। ভেতরে স্পষ্ট মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে। বিশাল এক সিংহাসনের ন্যায় কেদারাতে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে আছে। তার সামনেই এক লোক নতজানু হয়ে দন্ডায়মান। তনুকা একটু মনোযোগ দিল, ব্যাপারটা বুঝতে। রেনু এদিকে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে; ভাইজান দেখলে আজ খবর আছে যে।

মেহতাবের পাশে দাঁড়ানো এক যুবক তখন কর্কশ স্বরে বলে উঠল,

‘ছোটসাহেব, এই বদ’মাশ লোককে কী করব?’

মেহতাব চিবিয়ে চিবিয়ে জবাবে বলল,

‘কে’টে টুকরো টুকরো করে মনোহর নদীতে ভাসিয়ে দাও।’

যুবকটি মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল। সামনে দন্ডায়মান লোকটি হাজার আকুতি মিনতি করেও ছাড় পেল না। তনুকা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। একটা মানুষকে কে টে টুকরো টুকরো করে ফেলাটা কি খুব সহজ কাজ? উনি এত নির্লিপ্ত ভাবে এত ভয়ানক একটা কাজ করতে কী করে বলছেন? তনুকা রুদ্ধশ্বাস ফেলে। আদ্যোপান্ত না ভেবেই ছুটে চলে যায় কক্ষের ভেতর। তার আকস্মিক আগমনে ভেতরে উপস্থিত পুরুষগণ চমকে ওঠে। মেহতাবের চোয়াল শক্ত হয়। তনুকা এত পুরুষ দেখে চট করে আগে মাথায় কাপড় টানে। এরপর কিঞ্চিৎ আওয়াজ তুলে বলে,

‘আপনি এভাবে একটা মানুষকে কে’টে ফেলার আদেশ কী করে দিতে পারেন? অন্যায় করলে শাস্তির তো আরো ব্যবস্থা আছে।’

সকল পুরুষ স্তব্ধ। এই প্রথম জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের কোনো নারী এসে মেহতাম মজুমদারের মুখের উপর কথা বলছে। এ যেন এক ভয়ংকর দুঃসাহস। মেহতাব চোখের পল্লব নিমীলিত করল। শান্ত করল নিজেকে। তার জায়গা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়াল তনুকার ঠিক মুখের সামনে। এত নিকট হতে মেহতাবের রক্তিম অক্ষিযুগল দেখে খানিকটা ঘাবড়াল তনুকা। তাও সাহস নিয়ে বলল,

‘এত নির্দয় হওয়া উচিত নয়।’

মেহতাব একবার দরজার আঁড়ালে রেনুকে দেখে নিল। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে মেয়েটা। ফের চাইল তনুকার মুখ পানে। প্রগাঢ় এক নিশ্বাস নির্গত করে গম্ভীর সুরে বলল,

‘এখান থেকে যাও, তনু। আমার মহলের মেয়ে বউরা আমার বিচার মহলে আসেন না। এটা তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ। আর নিষিদ্ধ কাজ আমার মোটেও পছন্দ না।’

তনুকার কী হলো কে জানে। ঐটুকু দুই বাক্যেই বক্ষঃস্থলে কম্পন শুরু হলো তার। তাও একবার বলল,

‘উনাকে এত কঠিন শাস্তি দিবেন না। আর পারলে ক্ষমা করে দিন; ক্ষমা মহৎ গুণ।’

মেহতাব দাঁতে দাঁত চাপল। কপালের ঘাম বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঘষে মুছে নিল। তারপর গর্জে উঠে হুকুম দিল,

‘ইশফাক, এক্ষুনি আমার তলোয়ার নিয়ে এসো।’

চলবে…

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here