প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৮।

0
201

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৮।

রুমে ফিরে আসে তনুকা। উদ্দেশ্য তার, এক্ষুনি মেহতাবের সাথে কথা বলা। কিন্তু রুমে এসেই দেখল, রুম শূণ্য। মেহতাব নেই। তনুকার এই মুহুর্তে মেহতাবের অনুপস্থিতিটা ঠিক মনঃপূত হলো না। এই সময় আবার কোথায় গেল লোকটা? তনুকা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার বারান্দা থেকে মহলের প্রধান ফটক দৃশ্যমান। সেখানেই মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে; এক লোকের সাথে কথা বলছে সে। লোকটা মেহতাবের সাথে কথা বলার মুহূর্তেই একবার চাইল সেইদিকে। বারান্দায় দাঁড়ানো তনুকাকে ততক্ষণাৎ চোখে পড়ল তার। হেসে বলল,

‘ভাইজান, ভাবি সাহেবা নাকি?’

লোকটার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বারন্দায় তনুকাকে পরখ করল মেহতাব। তনুকা সেইদিকেই চেয়ে ছিল বলে চোখে চোখ পড়ল। মেহতাব দৃষ্টি অতিশয় গম্ভীর। তনুকা কী ভেবে যেন ভেতরে চলে আসে। বসে থাকে বিছানায়।

কিছুক্ষণ পর সেই কক্ষে এসে উপস্থিত হয় মেহতাব। তনুকা গভীর চিন্তায় মগ্ন। মেহতাবের উপস্থিতি তাই প্রথমে টের পায়নি। মেহতাব তার পাশে বসতেই সম্বিৎ ফেরে তার। মেহতাবের দিকে দৃষ্টি নিমজ্জিত করে। তবে মেহতাবের চোখের দৃষ্টি মেঝেতে। কী যেন ভাবছে সে। দু জোড়া ভ্রু’র মাঝে ভাঁজ পড়েছে তিনখানা। তনুকা তাই রয়ে সয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু কি হয়েছে?’

মেহতাব চাইল। বলল,

‘না।’

‘আপনাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে।’

মেহতাব একটু সময় নিয়ে বলল,

‘কালকে বারান্দায় থাই গ্লাস লাগাতে হবে।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকাল খানিক। জিজ্ঞেস করল,

‘কেন?’

মেহতাব চাইল কিয়ৎক্ষণ, তবে জবাব দিল না। তনুকা ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহতাব বলল,

‘প্রশ্ন করো না। এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।’

তনুকা নিমিষ চেয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করল লোকটার ভাবমূর্তি। কিন্তু পরাস্ত হলো সে। এই লোকটাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তনুকা নিশ্বাস নিল। বলল,

‘আপনি নাকি আমায় ভালোবাসেন?’

মেহতাব কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘কে বলল?’

‘রেনু বলেছে। কথাটা সত্যি?’

মেহতাব মৃদু হাসল। হাসির রেশ এতই ক্ষীণ যে গালের একটা অংশেও ভাঁজ পড়ল না। বলল,

‘প্রত্যেক স্বামীই তার স্ত্রীকে ভালোবাসে, এটাই স্বাভাবিক।’

‘কিন্তু, বিয়ের আগেই কোনো মেয়ের জন্য এত উতলা হয়ে উঠা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আপনি তো আমাকে চিনতেনও না। আর আমিও তো আপনাকে বাসর রাতেই প্রথম দেখেছি, তবে বিয়ের আগেই এত দূর্বলতায় কীভাবে পড়লেন?’

মেহতাব ভ্রু যুগল কুঁচকে চাইল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘এসব তোমায় কে বলেছে?’

‘রেনু বলেছে। আপনার আমার বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই নাকি ও আপনার মধ্যে এক অন্যরকম বদল দেখেছে। আমার প্রতি দূর্বলতা দেখেছে, যেটা আগে কখনো অন্য মেয়ের প্রতি দেখেনি সে।’

মেহতাব হাসল। হাসিতে শব্দ হলো। তনুকা বিমোহিত হলো যেন সেই শব্দ। মেহতাব বলল,

‘ঐটুকু একটা মেয়ে এতকিছু বুঝে? ও তো তাহলে খুব পেঁকে গিয়েছে, বিয়ে দিয়ে দিতে হবে দেখছি।’

‘কী বলেন? বিয়ে কেন দিবেন? সবে তো ওর ষোল বছর, এইটুকু মেয়ের আবার বিয়ে হয় নাকি?’

‘হয় হয়, আমার আম্মার তো ঐটুকু বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। তারপর দু বছরের মধ্যে আমি হয়েছি। এখন দেখো, আমার ত্রিশ চলছে, অথচ আমার আম্মা কত যুবতী। কম বয়সে বিয়ে হলেই ভালো, সময় থাকতেই সব মুহূর্ত উপভোগ করে যাওয়া যায়।’

তনুকার ভ্রু যুগলের কুঁচকানো ভাব আরো দৃঢ় হলো। সে প্রশ্ন করল,

‘আপনি কতটুক পড়াশোনা করেছেন?’

মেহতাব চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। জিজ্ঞেস করল,

‘হঠাৎ এর মাঝে আমার পড়াশোনার কথা আসল কোথ থেকে?’

‘কোনো শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনা এমন হয় না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

হাসল মেহতাব। বলল,

‘তা যা বলেছ। আমার মতো এইট পাশ ছেলের চিন্তাভাবনা আর কতটুকুই বা উন্নতি হবে।’

তনুকা অবাক হলো ভীষণ। কেবল এইট পাশ? বাবা যে বললেন, ছেলে ভীষণ শিক্ষিত? তবে কি এটাও মিথ্যে? বুক চিরে বেরিয়ে এল গভীর এক দীর্ঘশ্বাসের স্রোত। মনটা ভীষণ ব্যথিত হলো তার। অন্তত, একটু শিক্ষিত ছেলে চেয়েছিল সে। অথচ অবশিষ্টে সে কিছুই পেল না। তনুকা মন খারাপ করে ফের জিজ্ঞেস করল,

‘বললেন না তো, আমাকে এত পছন্দ করার কারণ কী? মেয়ে তো নিশ্চয়ই অভাব পড়েছিল না আপনার; তবে আমিই কেন?’

মেহতাব মাথা নোয়াল। কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। অতঃপর গভীর চোখে চাইল তনুকার পানে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,

‘মেয়ের অভাব পড়েছিল না, তবে একটা তনুকার বড্ড অভাব ছিল। যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম, তখন আর তা হাতছাড়া করতে পারলাম না। তনুকাকে নিজের করে নিলাম, একান্তই নিজের। এখন আর চাইলেও সেই তনুকা আমার থেকে হারাতে পারবে না। সেই পথ বন্ধ তার; আর আজীবন বন্ধ’ই থাকবে।’

তনুকা কপালের ভাঁজ সোজা করে নিল। মেহতাব সহজ ভাষায় কথা বলতে জানে না হয়তো। আবার হতে পারে সেই আজকাল বড্ড মূর্খ হয়ে ওঠেছে। বাংলা কথারও ঠিকঠাক অর্থও সাজাতে পারছে না। মেহতাব বরাবরের ন্যায়’ই নির্লিপ্ত। সে একপলক তনুকাকে দেখে বলল,

‘সবকিছুর উত্তর পাইছো তো, বিবিজান? আর কোনো প্রশ্ন থাকলে এখনই কইরা ফেলাও, পরে আর উত্তর দিতে পারমু না কিন্তু।’

তনুকা উঠে অপর পাশে গিয়ে বসল। এরপর বলল,

‘না, আমার আপনার থেকে আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই।’

________

সন্ধ্যার পর রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয় তনুকা। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত, শাশুড়ি আম্বিরা বেগমকে পায়। আম্বিরা বেগম তাকে দেখে মৃদু হাসলেন। বললেন,

‘কিছু লাগবে, মা?’

তনুকা কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিল,

‘না মা, কিছু লাগবে না। চা নাস্তা আমাকে কিছু বানাতে হবে?’

‘চা বানাতে পারো?’

তনুকা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘জি, পারি।’

আম্বিরা বেগম একটু সরে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘ঠিক আছে তবে, বানাও দেখি।’

তনুকা এগিয়ে এল। একপাশে রাখা সবগুলো পাতিল নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বুঝতে পারল না, কোনটাতে পানি বসাবে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল শাশুড়ির দিকে। আম্বিরা বেগম সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন। বললেন,

‘ঐ যে ঐ পাতিলে পানি বসাও।’

উত্তর পেয়ে চট করে পাতিল নিয়ে পানি বসায় তনুকা। আম্বিরা বেগম বললেন,

‘মেহতাবকে চিনি ছাড়া চা দেবে, ও চিনি খায় না।’

‘একদমই চিনি দিব না?’

‘না।’

তনুকা অবাক হয়ে ভাবল, চিনি ছাড়া অমন বেস্বাদের চা কারোর মুখে জুটে কী করে?

_____

চায়ের পানি ফুটছে। আম্বিরা বেগম একপাশে দাঁড়িয়ে আটা মেজে কী যেন বানাচ্ছেন। তনুকা চায়ের পানিতে চা পাতা দিতে দিতে বলল,

‘মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

আম্বিরা বেগম একপলক তাকে দেখে বললেন,

‘করো।’

তনুকা চায়ের পাতা ঢেলে একটু সরে দাঁড়াল। আম্বিরা বেগমের শিউরে অবস্থান করল। জিজ্ঞেস করল,

‘আপনি আমার ছোট বেলার ছবি কোথায় পেলেন?’

আম্বিরা বেগম অবাক হয়ে চাইলেন। বললেন,

‘মানে?’

তনুকা এগিয়ে গিয়ে তার গলার লকেট মেলে ধরে। জিজ্ঞেস করে,

‘এই যে, এই ছবিটা আপনি কোথায় পেলেন?’

আম্বিরা বেগম বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। জিজ্ঞেস করলেন,

‘এটা যে আমি পেয়েছি, সেটা তোমাকে কে বলল?’

‘আপনার ছেলে।’

আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকালেন। কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তনুকা ধরতে পারল না ব্যাপারটা। সে নির্নিমেষ চেয়ে দেখল তাঁকে। আম্বিরা বেগম একটু সময় নিয়ে বললেন,

‘তোমার বাবার কাছ থেকে নিয়েছি। চা হয়েছে? তাড়াতাড়ি করো, আমার নাস্তা বানানো শেষ।’

অযথাই তাড়া দিলেন তিনি। তনুকার দৃষ্টির গভীরতা আরো প্রকট হলো। চট করেই মনে হলো, ভদ্রমহিলা মিথ্যে বলছেন, লুকাচ্ছেন কিছু। তনুকার যথেষ্ঠ সন্দেহ হলেও আপাতত ব্যাপারটা আর সে ঘাটাল না। এই বাড়ির সবগুলো মানুষ’ই বড্ড জটিল। এত সহজে তাদের ভাবমূর্তি ধরা যাবে না। সে তাই অতঃপর মনোযোগ দিল চা বানাতে।

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here