প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪।

0
218

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪।

মেহতাবের হুংকারে বিচারমহল যেন কেঁপে ওঠে। বাড়ির বাকি দুই কর্তাও এখানে। তাঁরাও যেন সিঁটিয়ে আছেন ভয়ে। ইশফাক বিলম্ব করল না। মেহতাবের সবথেকে ধারাল তলোয়ারটা এনে এগিয়ে দিল তার দিকে। মেহতাব হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করল সেটা। তার নিগূঢ়, কঠিন দৃষ্টি এখনও তনুকার উপরেই নিবদ্ধ। তনুকা নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে কেবল। কালকের রাতের সেই মেহতাবের সাথে এই মেহতাবের মিল পাচ্ছে না সে। দুজন যেন দুই ভিন্ন সত্তা।

হাতে ধারাল তলোয়ার আকড়ে ধরে সেই অপরাধী লোকটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল মেহতাব। অপরাধী অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার পায়ের কাছে। ক্ষমা চাইল অনেক। কিন্তু, কঠিন হৃদয়ের মেহতাবের মন গলল না। সে ততক্ষণাৎ তার ধারাল তলোয়ার দিয়ে চির বসাল সেই অপরাধীর পিঠে। সঙ্গে সঙ্গেই গগনবিদারি চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। উপস্থিত জনতা এসবে অভ্যস্ত। তাই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তবে তনুকার শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে ওঠল। লোকটার একেকটা চিৎকারে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তার। দোরের বাইরে রেনু দু হাতে কান চেপে দাঁড়িয়ে আছে। তনুকা নিষ্পলক চেয়ে মেহতাবকে দেখছে কেবল। মেহতাব স্বাভাবিক, অত্যন্ত নির্লিপ্ত তার ভাবমূর্তি; যেন কিছুই হয়নি। অথচ মাটিতে পড়া লোকটি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মেহতাব তলোয়ারটি ইশফাকের হাতে তুলে দেয়। আদেশের সুরে বলে উঠে,

‘তাকে এখন ভেতরে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখবে। আমার বিবিজান তাকে অন্যভাবে শাস্তি দিতে বলেছেন, তাই ওর দম যতক্ষণ না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে ওভাবেই ঝুলিয়ে রাখবে। আর পিঠের আঘাতে লবণ মরিচ দিতে ভুলো না, তাহলে মৃত্যু’টা একটু তাড়াতাড়ি আসবে।’

তনুকার মাথা ঝিমঝিম করছে। তরতর করে ঘামছে সে। এই লোকটা মানুষ না অন্যকিছু? সে জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। ঢুলছে শুধু। মেহতাব একপলক তনুকাকে পরখ করে নিয়ে গলা উঁচিয়ে ঘোষণা দেয়,

‘বিচার কার্য আজ এখানেই শেষ। আপনারা আসতে পারেন।’

সবাই জায়গা ছেড়ে যার যার গন্তব্যের দিকে ছুটল। বাড়ির দুই কর্তা তখন এগিয়ে এলেন। মেহতাবের মেঝো কাকা চিন্তিত সুরে বলে উঠলেন,

‘মা, তুমি এখানে কেন এসেছ?’

তনুকা ভীত চোখে তাকায়। এই সবগুলো মানুষকেই এখন তার ভয় করছে। মেঝো কাকা ফের প্রশ্ন করেন,

‘তোমাকে কেউ এই বাড়ির নিয়ম কানুনগুলো বলেনি। এই রেনু কই? ও তোমাকে কিছু বলেনি।’

এমনিতেই ভয়ে বেচারি রেনুর মরমর অবস্থা, এখন আবার কাকার ক্রোধে আরো বেশি কুন্ঠিত সে। মেহতাব এগিয়ে এল। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ধীর আওয়াজে বলল,

‘আপনারা যান, কাকা। আমি তনুকে নিয়ে আসছি।’

মেহতাবের মেঝো কাকা, রমেজ মজুমদার বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে রইলেন এক পল। ছেলেটাকে চেনেন তিনি। তাই ঠিক ভরসা করতে পারলেন না। বললেন,

‘নতুন এসেছে তাই অত কিছু বোঝেনি। তুমি আর কিছু বলো না।’

মাথা নাড়িয়ে মেহতাব বলল,

‘কিছু বলব না, আপনারা নিশ্চিন্তে অন্দরে যান। আর যাওয়ার সময় বাইরে থেকে রেনুকেও নিয়ে যাবেন।’

সবাই চলে গেল। একা দাঁড়িয়ে রইল কেবল তনুকা। মেহতাব এগিয়ে এল তার দিকে। তনুকার নাকের ডগায় প্রস্ফুটিত বিন্দু বিন্দু ঘামের কণাগুলো বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে শুধাল,

‘ভয় পাচ্ছো?’

তনুকা ঢোক গিলল। এরপর মাথা নাড়াল। মানে, ভয় পাচ্ছে না সে। মেহতাব হাসল। শ্যামবর্ণ পুরুষের এই হাসি অতিশয় চমৎকার ঠেকল তার নিকট। মেহতাব তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,

‘সাহস ভালো, তবে অতিরিক্ত সাহস ভালো না। চলো, একটু ঘাটের কাছে গিয়ে বসি।’

দুদিন ধরে আকাশটা যেমন থেকে থেকে আচমকা রং পাল্টাচ্ছে, ঠিক তেমনি এখন মেহতাবও রং পাল্টাচ্ছে। কয়েক ক্ষণ পূর্বের সেই ভয়ংকর মেহতাব মজুমদার এখন পাল্টে গিয়ে হয়ে পড়েছেন নিত্যান্তই এক রসিক পুরুষ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা ঐ হাসি দেখলে কেউ জীবনেও ঠাহর করতে পারবে না, এই মানুষটা যে এত ভয়ংকর।

তনুকার নীরবতা দেখে মেহতাব ফের প্রশ্ন করল,

‘ঘাটে যাইবা, বিবিজান?’

তনুকা কেবল মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল। হাসল মেহতাব।মেয়েটা যতই বলুক, ভয় পাচ্ছে না; চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ভয়ে ঠিক কতটা সংকুচিত সে।

বিচারমহলের পাশেই এক বিশাল পদ্ম ঝিল। দুধারে ঘাট বাঁধানো তার। ঝিলের চারিধারে আবার সারি সারি নারকেল গাছ। পানি পরিষ্কার। জায়গাটাও বেশ পরিপাটি। বিকেলে বসে চায়ের আড্ডা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত এক জায়গা।
তনুকাকে নিয়ে মেহতাব ঝিলের পানিতে পা ভিজিয়ে বসল। ঝিলে এখন খুব একটা পদ্ম নেই। যেই কয়টা আছে, সব মজে গিয়েছে। এই তপ্ত দুপুরে বাতাসও নেই তেমন। তাও যেন তনুকার বেশ শান্তি পাচ্ছে জায়গাটাতে বসে। অন্তত একটু আগের বিদঘুটে সেই দৃশ্যগুলো যে চোখের সামনে ভাসা বন্ধ হয়েছে, সে’ই ঢের।

মেহতাব অনেকক্ষণ নীরবে বসে ঝিলের পানি দেখল। তনুকার দৃষ্টিও সেইদিকেই। মুখে যতই বলুক না কেন, লোকটাকে সে ঠিকই ভয় পাচ্ছে। কী নির্দয় লোকটা! একটা মানুষকে মা’রতে একটুও বুক কাঁপে না। অথচ, তনুকা একটা পিপড়া মারতেও হাজারবার ভাবে।
দীর্ঘক্ষণের নীরবতার পর এবার মেহতাবের গলার স্বর পাওয়ার গেল। সে খানিক রয়েসয়ে গম্ভীর সুরে বলল,

‘এই বাড়ির কেউ আমার কথা অমান্য করেন না। আমার আম্মাও না। আব্বাজান অসুস্থ হবার পর থেকেই তাঁর জমিদারী আমি সামলাচ্ছি। আমার কাকারা আর ছোট ভাই হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন এই সিদ্ধান্ত। যদিও ভেতরের কথা আমি জানি না। আর এই বিচারমহল আমার দালান, আমার গোপন মহল; এখানে বাড়ির মহিলাদের আসা নিষেধ। আম্মা ব্যতিত কারোর অনুমতি নেই, এমনকি তোমারও না। তুমি নতুন বলে মাফ পেয়েছ। পরবর্তীতে এমন কিছু করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আর আমার শাস্তি ঠিক কতটা কঠোর, তা তো দেখেছ’ই।’

সব শুনে তনুকার কেবল একটা কথা’ই মনে হলো, বাবা তার শেয়ালের ঘরে মুরগী দিয়েছে; হয়তো প্রাণ নিয়ে আর ফেরা হবে না।

তনুকা নিশ্চুপ রইল। শব্দবহল হারিয়েছে যেন। কী বলবে সে? কী বলা উচিত? নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কেবল ঝিলের ঢেউ খেলিত পানির দিকে।
অনেকক্ষণ সময় কাটল এহেন নীরবতায়। একপর্যায়ে মেহতাব উঠে দাঁড়াল। তনুকার উদ্দেশ্যে বলল,

‘উঠে পড়ো, বিবিজান। আইজ তো দুপুরে আবার তোমার রান্ধার কথা, তা রানতে পারো তুমি?’

তনুকা হাত ঝেরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর একপলক মেহতাবকে দেখে চোখ নামায়। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে,

‘না।’

মেহতাব ঈষৎ হাসল। বলল,

‘হায় হায়, বিবির রান্ধা খাওয়ার সৌভাগ্যও আমার হইল না। কিন্তু, আম্মাজানরে কী কইবা? আম্মাজান তো অধির আগ্রহে তাঁর পুত্রবধূর হাতে রান্ধা খাওয়ার জন্যে বইসা আছেন।’

তনুকা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার। কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। এই মানুষটাকেও পছন্দ হচ্ছে না। এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কেমন যেন দম বন্ধ একটা পরিবেশ। অদ্ভুত এই মহল আর এই মহলের মানুষ। তনুকার চিন্তাধারার সাথে এই মানুষগুলোর মিল নেই। এখানে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে।
তনুকার চিন্তিত, ভয়ার্ত চোখ মুখ দেখে তার মাথায় হাত ঠেকায় মেহতাব। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘এখনো ভয় পাচ্ছো, তনু?’

তনুকা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। লোকটা কী নিদারুণ মায়া নিয়ে “তনু” বলে ডাকে তাকে। শুনলে যেন চিত্তপটে প্রশান্তির স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু, পরক্ষণেই আবার লোকটার সেই বিদঘুটে রক্তিম অক্ষিযুগলের কথা স্মরণে আসলেই চিত্তপটের সেই প্রশান্তির স্রোত ততক্ষণাৎ মরুভূমির রূপ নেয়।

তনু রুদ্ধশ্বাস ফেলে। ক্ষীণ সুরে বলে,

‘আমি এই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না। আমি এইভাবে বড়ো হয়নি। আপনাদের সাথে মানিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।’

কথাগুলো বলে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়ায় সে। ভয় পায়, লোকটা পুনরায় অগ্নি মূর্তি ধারণ করবে না তো?

কিন্তু মেহতাব তেমন কিছুই করল না। নির্নিমেষ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তনুকার সুশ্রী মুখশ্রীর পানে। অতঃপর স্মিত সুরে বলল,

‘পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই, তনু। মানুষ চাইলেই সব পারে। আর তুমি না চাইলেও এইখানে থাকতে বাধ্য। মেহতাব মজুমদারের অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছ তুমি; মৃত্যু ব্যতিত এই অস্তিত্ব আর কেউ মুছতে পারবে না।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here