প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৭।

0
211

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।

‘আপনি তখন কাকীকে ওভাবে বললেন কেন?’

মেহতাব চোখ বোজে শুয়েছিল। তনুকার গলা পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কীভাবে?’

তনুকা এগিয়ে এসে খাটের অপর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে। তারপর মাথাটা কাত করে মেহতাবের দিকে চেয়ে বলে,

‘আপনার কথা শুনে মনে হলো আপনি কাকীকে হুমকি দিচ্ছেন। সামান্য শাড়ির সাথে কি কারোর জানের তুলনা হয়? তাহলে আপনি কাকীকে ওভাবে কেন বলছিলেন?’

মেহতাব পুনরায় তার ঘন পল্লবে বেষ্টিত চোখের পাতা নিমীলিত করল। বলল,

‘তুমি না বড্ড বেশি প্রশ্ন করো, বিবিজান। এত প্রশ্ন আমার ভাল লাগে না। মাথাডা ধরছে, একটু টিইপা দাও তো।’

তনুকা বিরক্তিতে নাক মুখ সংকুচিত করে। ক্ষিপ্ত সুরে বলে,

‘সবার সাথে তো বেশ সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, আমার সাথে কথা বলতে গেলে এমন শুদ্ধ অশুদ্ধ সব মিলিয়ে ফেলেন কেন?’

‘আবার প্রশ্ন করো? আমার মনে যা চাই আমি তাই করি; এহন এত প্রশ্ন না কইরা আমার কাছে আইয়ো তো। অত দূরে বইসা থাকলে কি আর স্বামীর আদর সোহাগ পাওয়া যাইব?’

তনুকার বিরক্তির মাত্রা তড়ান্নিত হলো। উঠে দাঁড়াল সে। বলল,

‘না, আপনার আদর সোহাগের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি রেনুর ঘরে যাচ্ছি।’

মেহতাব কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। তনুকা বেরিয়ে গেল সেই কক্ষ ছেড়ে। মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসল। মনে মনে আওড়াল,
‘আমার এত দিনের জমানো আদর, সোহাগ, ভালোবাসা সব তো কেবল তোমার জন্যই, বিবিজান। তুমি না চাইলেও এগুলো এখন তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে।’

_________

রেনুর দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হয়। ভেতর থেকে সে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কে?’

তনুকা মৃদু আওয়াজে বলে,

‘আমি রেনু, আসব?’

‘কে, বউমনি?’

‘হ্যাঁ।’

‘এসো এসো।’

তনুকা ভেতরে প্রবেশ করে। রেনু শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। তনুকা জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? আমি কি বিরক্ত করলাম?’

রেনু হেসে বলল,

‘আরে না না, ঘুমাচ্ছিলাম না। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম। ঐ দেখো, আমার বিছানা থেকে কী সুন্দর আকাশ দেখা যায়।’

তনুকা মৃদু হাসল। বলল,

‘বসব?’

রেনু চকিত স্বরে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বসোনা; অনুমতি নিচ্ছ কেন?’

তনুকা বসল। রেনু জিজ্ঞেস করল,

‘আমাদের এখানে তোমার ভালো লাগছে তো?’

তনুকা ম্লান হেসে বলল,

‘হ্যাঁ, জমিদার বাড়ি, ভালো না লেগে উপায় আছে।’

‘আর আমার জমিদার ভাইজানকে কেমন লাগছে?’

তনুকা প্রশ্ন শুনে চাইল। রেনুর চোখে মুখে দুষ্টুমির রেশ। হাসল তনুকা। বলল,

‘তোমার ভাইজানকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি।’

রেনুর মুখ চুপসে গেল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কেন কেন, আমার অমন সুন্দর ভাইকে তোমার কেন পছন্দ হয়নি? আমার ভাইজানের গায়ের রং একটু চাপা বলে?’

তনুকা অস্বস্তির সুরে বলল,

‘না না, কী বলছো? আমি গায়ের রং দেখে মানুষ বিচার করি না। আমার কাছে মনুষ্যত্ব আগে তারপর সব। আচ্ছা, তোমার ভাইজান কি খুব বদমেজাজি মানুষ বা অহংকারী?’

রেনু একটু নড়ে চড়ে বসল। তারপর আমোদ গলায় বলল,

‘তুমি ভাইজান সম্পর্কে কিছু জানো না তো, তাই এমন ভাবছ। তুমি জানো, এই গ্রামের মানুষের কাছে আমার ভাইজান একজন ফেরেশতা সমতুল্য। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ ভাইজানকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর ভাইজানের কাছেও এই গ্রাম তাঁর একটা পরিবার। এই গ্রামের এইটুকু ক্ষতিও তিনি বরদাস্ত করেন না।’

তনুকা এক পল ভেবে বলল,

‘তবে, তখন ঐ মানুষটাকে এভাবে কেন শাস্তি দিচ্ছেলেন? এমন কী অন্যায় করেছিলেন উনি?’

রেনু ভরাট গলায় বলল,

‘তুমি জানো না বউমনি, ঐ লোকটা কত জঘন্য। ও একটা মেয়েকে ধ’র্ষণরত অবস্থায় গ্রামের লোকদের কাছে ধরা পড়ে। গ্রামের লোকরাই তো তাকে ধরে ভাইজানের কাছে নিয়ে আসে। এখন তুমি বলো, একজন ধর্ষকের ঠিক কী শাস্তি হওয়া প্রয়োজন? ভাইজান কি ভুল কিছু করেছেন?’

তনুকার মুখে রা নেই। না জেনে, না বুঝে ভুল করে ফেলেছে সে। একজন ধর্ষককে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিল? ছি!

তনুকার এবার নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে। সে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আমি আগে জানলে কখনোই এমন করতাম না। একজন ধর্ষকের শাস্তি সবথেকে জঘন্যতম হওয়া উচিত।’

‘ভাইজান তুমি বলে কিছু বলেননি; অন্যকেউ হলে আজ মেরেই ফেলতেন।’

‘কেন? উনার বিচারমহলে মহিলাদের যাওয়া নিষেধ কেন?’

রেনু দুই কাঁধ উঁচিয়ে বলল,

‘কী জানি? আমি তো জানি না। তবে ভাইজান বিচারমহলে বসার পর থেকেই এই নিয়ম দেখে আসছি। এর কারণ ভাইজান’ই ভালো বলতে পারবেন।’

তনুকা ভাবল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর বলল,

‘আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো তো, জমিদারী প্রথা তো এখন বিলুপ্ত; গ্রামে এখন নির্বাচন হয়, চেয়ারম্যান হয়, গ্রাম পরিচালিত হয় তাঁর দ্বারা। সেখানে তোমাদের গ্রামে এখনও এই জমিদারী প্রথা কেন চলছে? গ্রামের কেউ কিছু এই নিয়ে বলে না?’

রেনু হেসে বলল,

‘সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার পেলেই সন্তুষ্ট। সেখানে এই গ্রামের মানুষদের আমার আব্বা আর ভাইজান তার থেকেও বেশি দিয়ে এসেছেন। আব্বাও উনার বিচার আমলে একজন সত্যবান, নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। এই গ্রামের এত উন্নয়ন সব উনার হাত ধরেই। তুমি জানো, করোনার সময় যখন কোনো গ্রামে ঠিক মতো ভ্যাকসিন পাঠানো হচ্ছিল না, তখন আমাদের গ্রামে সর্বপ্রথম ভ্যাকাসিন আনা হয়। গ্রামের অসুস্থ মানুষদের সেবার জন্য ভাইজান নিজ উদ্যোগে শহর থেকে ডাক্তার আনেন। যেখানে নিজের প্রিয় জনেরা মৃত্যুর পর একে অন্যের জানাযা পর্যন্ত পড়তে আসছিল না, সেখানে ভাইয়া নিজের দাঁড়িয়ে থেকে সবার জানাযা পড়েছেন, কবর দিয়েছেন। গ্রামের প্রতিটা বিপদে আমাদের পরিবার সকলের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও তোমার মনে হয়, এই গ্রামের মানুষ এই জমিদারী প্রথা চাইবে না? সবাই নিজ খুশিতে এই জমিদারী চায়। ভাইজান যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন বলেছিলেন, গ্রামবাসী যদি কোনোদিন বলে এই জমিদারী তারা চায় না, তবে সাথে সাথেই এই জমিদারী বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা মুখেও আনেনি। তাদের কাছে আমাদের পরিবার এক সম্মানজনক ভরসা। যাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।’

থামল রেনু। তনুকা নিমিষ চেয়ে শুনল সব। অতঃপর বলল,

‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কি কোনো বাঁধা আসে না। সরকারী ভাবে তো এই জমিদারী তুলে দেওয়া হয়েছে, তবে তোমরা কী করে অনুমতি পাচ্ছো?’

রেনু ঠোঁট উল্টে ভেবে বলল,

‘আব্বাজান আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আর এই গ্রামেও নির্বাচন হয়, চেয়ারম্যান ও আছে; তবে নামমাত্র। সব তো আমার আমার আব্বাজান’ই করে এসেছেন আর এখন ভাইজান করছেন। গ্রামের মানুষের কোনো বাঁধা নেই বলে, বাইরে থেকেও তেমন কোনো বাঁধা আসে না।’

তনুকা সব শুনে তপ্ত শ্বাস ফেলে। মনে প্রশ্নের পাল্লা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। রেনু হঠাৎ প্রশ্ন করে,

‘তোমার কি ভাইজানকে পছন্দ হয়নি? ভাইজান কিন্তু খুব ভালো মানুষ, আর তোমাকেও খুব ভালোবাসেন।’

তনুকা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘ভালোবাসেন?’

‘হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসেন। তোমার আর ভাইজানের বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই আমি ভাইজানের আরেক রূপ দেখেছিলাম। আমার বুঝ হবার পর থেকে আমি ভাইজানকে কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাতে দেখিনি। প্রথম সেই আগ্রহ আমি তোমার জন্যই দেখেছিলাম। জানো, গ্রামের কত মেয়ে ভাইজানের প্রেমে দিশেহারা। আমার বান্ধবী নিলুও ভাইজানের উপর চরম পরিমাণে দূর্বল। তোমার তো নিজেকে নিয়ে গর্ব করা উচিত যে, তুমি আমার সুদর্শন ভাইজানকে তোমার স্বামী হিসেবে পেয়েছ।’

তনুকা হাসে। বলে,

‘তা যা বলেছ, তোমার ভাইজান সুদর্শন বটে। তবে ভালোবাসা কি এত সোজা? উনি আমাকে এক দেখাতেই কী করে ভালোবেসে ফেললেন? ব্যাপারটা কিন্তু খুব চিন্তার। তোমার ভাইজানের সাথে কথা বলতে হবে।’

রেনু বেশ আগ্রহ সমেত বলে উঠে,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই একবার গিয়ে এই কথাটা জিজ্ঞেস করে এসো না।’

তনুকা সায় দিল। উত্তর তার এখনই চায়। মেহতাব মজুমদারের মতো এমন একজন সুদর্শন, বিত্তবান জমিদার ছেলে হঠাৎ এত মেয়ে রেখে তাকেই কেন পছন্দ করল? আবার বিয়ের আগেই তার প্রতি এত দূর্বলতা? এটা কি নিত্যান্তই স্বাভাবিক কিছু, নাকি এর পেছনের গল্পেও রয়েছে বিশাল গভীরতা?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here