#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
‘আজকাল বউয়ের কথাতেই উঠ বস করছো দেখছি।’
মায়ের এমন বিদ্রুপাত্মক বাক্যবাণের বিপরীতে স্মিত হাসল মেহতাব। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘মেহতাব মজুমদার কারোর কথায় উঠ বস করে না, সেটা নিশ্চয়ই আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না, আম্মা।’
আম্বিরা বেগম বিরক্ত হলেন। বললেন,
‘তবে অর্পিত আদেশ আবার ফিরিয়ে নিলে কেন? কেন ছেলের আঙ্গুল কাটলে না?’
‘প্রয়োজন বোধ করিনি।’
‘প্রয়োজন বোধ করোনি, না কি তোমার বউ চায়নি বলে?’
‘আপনি যা ভাববেন তাই।’
মেহতাব পা বাড়ায়। আম্বিরা বেগম পেছন ডেকে বলেন,
‘মেয়েটাকে বেশি প্রশ্রয় দিও না, শেষে না তোমাকেই ব’লির পাঁঠা মানায়।’
মেহতাব ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। ঘাড় কাত করে বলে,
‘আমার বিবিজানের তরে বলি হতে আমি এক পায়ে রাজি।’
‘তুমি অন্ধ হয়ে গিয়েছ, মেহতাব। এখন আমার ভয় হচ্ছে।’
মেহতাব হাসে। বলে,
‘ভয় পাবেন না, আম্মাজান। আপনার ছেলের শক্তির সামনে কেউ টিকতে পারবে না।’
মেহতাব চলে যায়। আম্বিরা বেগম অসহায় সুরে বলে উঠেন,
‘কিন্তু তোমাকে যে এক নারী দূর্বল করে তুলছে, তা কি তুমি বুঝতে পারছ না?’
______
মেহতাব কক্ষে প্রবেশ করে। তনুকা যেন তারই অপেক্ষাতে ছিল। তাই তার আগমনে মুখের হাসি চওড়া হয় বেশ। হেসে বলে,
‘আমি আজ খুব খুশি, মেহতাব।’
মেহতাব হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন?’
‘আপনি আমার কথা রেখেছেন, তাই।’
মেহতাব একপলক দেখে তাকে। মেয়েটার উচ্ছ্বেসিত চোখ মুখ দেখে তারও ভালো লাগে। তবে জবাবে কিছু বলে না। তনুকা নিজ থেকেই বলে,
‘আরেকটা কারণেও খুশি।’
‘কী সেটা?’
মেহতাবের প্রশ্ন। তনুকা জবাবে বলে,
‘বাবার মেসেজ এসেছে। বলেছেন, ভালো আছেন আর খুব শীঘ্রই ফিরবেন।’
‘বলেছিলাম না, তুমি অযথাই চিন্তা করছো।’
‘না জানিয়ে যাওয়াতে একটু চিন্তা হচ্ছিল আরকি।’
মেহতাব গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে ফেলে। তনুকা অস্বস্তিতে পড়ে যায় যেন। ইতস্তত স্বরে বলে উঠে,
‘আপনি জামা পাল্টাবেন? আমি বাইরে যাব?’
‘না, প্রয়োজন নেই। আমি গোসল করব এখন। আলমারি খুলে সবুজ রঙের পান্জাবীটা গোসলখানায় রেখে এসো।’
তনুকা তাই করল। মেহতাব চলে গেল গোসল করতে। তনুকা দাঁড়িয়ে থেকে আর কী করবে, সে তাই যায় রান্নাঘরে। দুপুরের রান্না শেষ। লতা রান্নাঘর পরিষ্কার করছে। তনুকা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘বাবাকে পরে কে খাবার দিয়েছিলেন?’
‘বড়ো আম্মা গিয়া খাওয়াইয়া আইছেন।’
তনুকা ছোট্ট করে বলল,
‘ওহ।’
লতা মিনমিনিয়ে বলল,
‘একটা কথা কমু, বউমনি?’
‘হ্যাঁ, বলুন না।’
‘আপনি কিন্তু জাদু জানেন। কেমনে আমাগো ভাইজানরে বদলায় ফেলাইছেন।’
তনুকা অবাক হয়ে কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘মানে? বদলে ফেলেছি মানে?’
‘জানেন, এমন কোনোদিন হয় নাই যে ভাইজান একটা হুকুম দিয়া আবার ফিরাইয়া নিছেন, আজ পত্থমবার এমন হইছে; তাও শুধুমাত্র আপনার কথাতেই। আপনি সত্যিই জাদু জানেন।’
তনুকা মুচকি হাসল। বলল,
‘এই কথা আপনিও জানেন?’
‘খালি আমি না, পুরা গ্রাম জানে। সবাই তো কানাঘুষা করতেছে যে, জমিদার বউ আউয়ার পর বদলায় গেছেন; এহন তিনি বউয়ের কথাত চলেন। নাইলে জীবনেও যেই কাজ হয় নাই আইজ সেই কাজ কেমনে হইল।’
তনুকা বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘সেখানে অনেক মানুষ ছিল, অথচ কেউ এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে কিছুই বলল না। সবাই কী করে একটা মানুষের আঙ্গুল কাটা দেখতে পারতো? উনাদের খারাপ লাগত না? এখন আমার কথায় জমিদার তাঁর ভুল শুধরে ফেলাতে এত কথা? আশ্চর্য! উনারা কী করে এমন একটা অন্যায়কে সমর্থন করছেন? নূন্যতম বিবেকও কি নেই?’
লতা হাসে। বলে,
‘আপনি নতুন আইছেন তো, বউমনি; তাই কিছু জানেন না। জমিদার বাবুর বিচার অনেক কঠিন। এমন বিচার করেন যে, দেখলেই গায়ে কাটা দিয়া ওঠে। দ্বিতীয়বার কেউ এই ভুল করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এমন ভয়ংকর উনার বিচার।’
‘অন্যায় করলে শাস্তি দেওয়াটা স্বাভাবিক। তবে কারোর ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ আঙ্গুল চাওয়াটা অন্যায়। আর কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি মোটেও আপোষ করব না।’
লতা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠে,
‘আপনি খুব সাহসী।’
তনুকা ম্লান হেসে বলে,
‘আপনি কবে থেকে এখানে কাজ করছেন?’
‘পাঁচ বছর হইব বোধ হয়।’
তনুকা ছোট্ট করে বলল,
‘ওহ।’
__________
শ্বশুরমশাইকে খাইয়ে দিয়ে তনুকা নিজ ঘরে ফিরে। মেহতাব তখন তৈরি হচ্ছিল। তনুকা তাই জিজ্ঞেস করল,
‘কোথাও বেরুবেন?’
‘হ্যাঁ, গ্রাম পর্যবেক্ষণে।’
তনুকা ততক্ষণাৎ আবদার করে বসল,
‘আমাকে নিবেন সাথে?’
মেহতাব তাকায় তার দিকে। বলে,
‘যাবে তুমি?’
‘হ্যাঁ, যদি আপনি চান।’
‘ঠিক আছে, তৈরি হও।’
তনুকা খুশি হলো। চট করে কামিজ পাল্টে শাড়ি পরল। মাথায় ঘোমটা টানল বড়ো করে। আয়নায় নিজের শূণ্য মুখটা একবার পরখ করে বলল,
‘তৈরি আমি।’
মেহতাব তার সম্মুখে দাঁড়াল এসে। বলল,
‘কাজল দাও, এমন শূণ্য চোখ আমার পছন্দ না।’
তনুকা চট করে কাজল টানল চোখের নিচে। গাঢ় দেখাল সেই রেখা। চোখগুলো ভরাট হয়ে উঠল তাতে। মেহতাব আপ্লুত সুরে বলে উঠল,
‘আমার কাজল রাঙা, বিবিজান।’
ক্ষীণ ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হয়ে তনুকা বলল,
‘চলুন এবার।’
তনুকাকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি করে গ্রাম দেখবে মেহতাব। তার আদেশ মতো ইশফাক সবকিছুর আয়োজন করে। ঘোড়ার গাড়ি চালানো দায়িত্বটাও নেয় সে।
মেহতাব আর তনুকা পেছনে বসে আছে। ইশফাক ঘাড় কাত করে একবার জিজ্ঞেস করে,
‘ভাইজান, ছাড়ব।’
‘হ্যাঁ।’
মেহতাবের অনুমতি পেয়ে ইশফাক ঘোড়ার গলার কাছের দড়ি টেনে ধরে। তাতেই শব্দ করে নড়ে উঠে ঘোড়াগুলো। আচমকা নড়ে উঠায় ভয় পেয়ে যায় তনুকা। মেহতাব তার হাত চেপে বলে,
‘ভয় পেও না। পড়বে না, আমি আছি।’
জবাবে আলতো হাসে তনুকা। গেইটের সামনে ঘোড়ার গাড়ি পৌঁছাতেই সেটা থেমে যায়। মেহতাব জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, ইশফাক? থেমে গেলে যে?’
‘আপনার বোন পথ আটকিয়েছেন, ভাইজান।’
মেহতাব ঘাড় কাত করে বাইরের দিকে তাকায়। ঘোড়ার গাড়ির সামনে দাঁড়ান রেনুকে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘এই রেনু, তুই এভাবে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
রেনু ভাইয়ের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘কোথায় যাচ্ছো, ভাইজান?’
‘গ্রাম পর্যবেক্ষণে।’
‘বউমনিকেও নিয়ে যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ।’
রেনু সঙ্গে সঙ্গেই আবেদন করে বসে,
‘আমিও যাব।’
‘তুই সবে স্কুল থেকে এসেছিস, ভেতরে গিয়ে আগে ফ্রেশ হো, খাবার খা।’
‘না না, আমি যাব। অনুরোধ করছি, ভাইজান।’
তনুকা মেহতাবকে বলে,
‘এত করে বলছে যখন নিয়ে নিন না।’
মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অগত্যাই বলে,
‘আয়।’
রেনুর খুশি আর দেখে কে। সে দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তাকে দেখে তনুকাও খুশি হয় খুব। জিজ্ঞেস করে,
‘না খেয়ে থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না?’
‘উঁহু। একদমই না।’
_________
গ্রামের পিচ ঢালা পাঁকা রাস্তায় শো শো করে ঘোড়ার গাড়িটি ছুটে চলছে। সেই বাতাসের দাপটে ঘোমটা ধরে রাখতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তনুকাকে। রেনু চোখ বুজে বসে আছে। মেহতাবের চুল সব এলোমেলো। বাতাসের দাপটে চোখ খুলে রাখাও মুশকিল। মেহতাব তনুকার দিকে ফিরে। জিজ্ঞেস করে,
‘ভালো লাগছে, বিবিজান?’
তনুকা মুচকি হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, খুব।’
মেহতাবের খুব ইচ্ছে করছিল, সেই মুহূর্তে তনুকার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বসে থাকতে। কিন্তু সামনে ছোট বোন বলে পারছে না সে।
গাড়ি থেমে যায় একটি নদীর পাড়ে এসে। নদীর নাম মনোহর। মেহতাব গাড়ি থেকে নামে, একহাত বাড়িয়ে দেয়। তনুকাও নেমে পড়ে সেই হাত ধরে। মেহতাব আবার হাত বাড়িয়ে দেয় বোনের জন্য। রেনু তখন দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘ছোট বেলা থেকে যে গাড়ি চড়ে বড়ো হয়েছি, সেটা থেকে নামতে আমার সাহায্য লাগবে না। আমি এমনিই নামতে পারব, ভাইজান।’
মেহতাব হেসে বলে,
‘ঠিক আছে, নাম।’
বলেই মেহতাব হাঁটা ধরে। রেনু চঞ্চল ভীষণ। লাফালাফি ঝাপাঝাপিতে দারুণ আগ্রহী। তাই ঘোড়ার গাড়ির তিনটি সিঁড়ি একসাথে পাড় হতে লাফ দিয়ে বসে সে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও জমিতে পা পড়ার সাথে সাথে ভারসাম্য রাখতে পারে না ঠিক, পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু ভাগ্য ভালো, এর আগেই ইশফাক ধরে ফেলে তাকে। তাড়াতাড়ি সোজা করে দাঁড় করায়। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে উঠে,
‘লাফালাফি ছাড়া কি আর কিছু পারেন না আপনি?’
রেনু ফের দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
‘পারি তো। বলব কী পারি?’
ইশফাক ভ্রু কুঁচকে ফেলে। অযাচিত ভয় মনে এসে হানা দেয়। রেনু কিছু বলার আগেই সে বলে উঠে,
‘না, আপনার আর কিছু বলতে হবে না। আপনি যান।’
বলেই সে নিজেই দ্রুত সেখান থেকে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।
চলবে….