#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২।
মেহতাব অন্দরে প্রবেশ করে দেখল, তনুকা বসার ঘরেই বসে আছে। তার পাশেই বসা রেনু। গল্প জুড়েছে দুজন। মেহতাব ব্যস্ত ভঙিতে সিঁড়িতে পা রেখে বলে,
‘বিবিজান, এক কাপ গরম চা নিয়ে এসো তো, মাথা ধরেছে খুব।’
তনুকা বলল,
‘আচ্ছা আপনি যান, আমি আনছি।’
মেহতাব ছোট পায়ে হেঁটে উপরে নিজের কক্ষে গেল। তনুকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুমি বরং এখন পড়তে যাও, আমি চা বানিয়ে তোমার ভাইজানকে দিয়ে আসি।’
রেনু মাথা কাঁত করে বলল,
‘আচ্ছা।’
রেনু নিজের কক্ষের দিকে গেল। আর তনুকা গেল রান্নাঘরের দিকে। কড়া লিকারে দুই কাপ চা বানাল। অতঃপর নিয়ে গেল নিজ কক্ষে।
মেহতাব বিছানায় শোয়া। এক হাত ঠেকানো কপালে। চোখের পাতা নিমীলিত। তাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তনুকা চায়ের কাপ রেখে আস্তে করে ডাকে,
‘শুনছেন, চা নিয়ে এসেছি।’
মেহতাব কপাল থেকে হাত সরায়। তার দিকে চেয়ে বলে,
‘রাখো।’
তনুকা খাটের সাথে লাগানো টেবিলে চায়ের কাপ দুটো রাখে। মেহতাবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
মেহতাব উঠে বসে। চোখ মুখ থমথমে তার। গম্ভীর সুরে বলে,
‘না, মন খারাপ লাগছে।’
‘কেন?’
‘ঘরের শত্রু যদি বিভীষণ হয়, তবে মন আর কী করে ভালো থাকবে বলো?’
তনুকা বিস্মিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, বলুন আমায়। আবার কেউ কিছু করেছে?’
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,
‘চেষ্টা করেছিল কিন্তু, মেহতাব মজুমদারকে হারানো এতটাও সহজ নয়।’
তনুকা অবাক চোখে চেয়ে থাকে। সহজ মানুষটাকে বড্ড জটিল মনে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বলে,
‘চা’টা খান, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
তনুকার কথা শুনে মেহতাব চায়ের কাপে চুমুক বসায়। অশান্ত অন্তর তৃপ্ত হয় তার। বলে,
‘চা খুব দারুণ বানাও তুমি।’
‘আমি অনেক রকমের চা পারি। আপনাকে একদিন আমার হাতের সবথেকে স্পেশাল চা’টা করে খাওয়াব।’
মেহতাব অতি উৎসাহ সমেত বলে,
‘কবে?’
‘কোনো এক স্পেশাল দিনে।’
‘ঠিক আছে, অপেক্ষায় রইলাম তবে।’
কাপের চা প্রায় শেষের দিকে। নীরবে চা পান করেছে দুজন। এত কাছাকাছি থেকেও এই নীরবতা মেহতাবের নিকট অসহ্যকর। তাও সহ্য করতে হয়, তনুকাকে যে সে কষ্ট দিতে চায় না।
তনুকা পুরো চা শেষ করে একটু রয়েসয়ে বলে,
‘আপনার যে এত বিশাল একটা লাইব্রেরী আছে, আগে বলেননি তো।’
মেহতাব তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘তো এখন কে বলল?’
‘রেনু বলেছে। নিয়েও গিয়েছিল। তিন তালার পুরোটা লাইব্রেরী। এত বই পড়েন আপনি?’
মেহতাব হেসে বলে,
‘শুধু আমি না, রেনু বাদে আমি, মা, বাবা আর রাদাভ আমরা সকলেই খুব বই পড়তে পছন্দ করি। যদিও আরেকজনও
আছে আমাদের দলে। আগে বই পড়তাম খুব, এখন ব্যস্ততার কারণে আর পড়া হয় না।’
‘একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘আপনার লাইব্রেরীতে এত বই থাকতে মা ঐসব খু’ন-খারাবি নিয়ে বই কেন পড়েন?’
‘সেটা উনার ব্যক্তিগত পছন্দ। এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।’
তনুকার আর কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট করে বলল,
‘ওহহ।’
তারপর ফের কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মেহতাব বলল,
‘সামনের শুক্রবার একটা আয়োজন করব ভাবছি।’
‘কীসের?’
‘তোমার আমার বিয়ের রিসিপশন তো এখনো হয়নি। সেটাই করব।’
‘বাবা তো এখন নেই এখানে।’
‘সমস্যা নেই। গ্রামের মানুষদের খাওয়ানো হবে। তোমার বাবা আসলে না হয় পরে উনাকে আলাদা ভাবে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো যাবে। এখন আপাতত এই রিসিপশনটা করে ফেলি, গ্রামের মানুষেরা তোমাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে ওঠেছেন।’
তনুকা জবাবে ধীর গলায় বলল,
‘ঠিক আছে, আপনার যেভাবে সুবিধা মনে হয়।’
মেহতাব খুশি হয়ে বলে,
‘আমার লক্ষী বিবিজান।’
_______
তনুকা রাতে কোনোভাবেই শ্বশুরকে খাবার খাওয়াতে পারেনি। তিনি খাবেন না মানে খাবেন’ই না। অনেক জোর করে দুই চামচ মুখে পুরা গেলেও আর পারেনি। তাই কোনোরকমে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে চলে এসেছে সে। ইদানিং এমন হচ্ছে, মানুষটা খেতেই যাচ্ছে না কিছু। এমন করলে তো তাঁকে আর সুস্থ করা যাবে না। মেহতাব আর শাশুড়িকে জানিয়েছে এই কথা। অথচ উনারা এমন একটা ব্যবহার করছেন যেন, এটা কিছুই না। তনুকা তাই ঠিক করে, তার নিজের পরিচিত ডাক্তারকে আনবে। তনুকার জোরাজুরিতে রাজি হতে হলো মেহতাবকেও। ডাক্তার আসবেন তাদের রিসিপশনের পর থেকেই।
________
আজ বুধবার। আগামী পরশু’ই শুক্রবার। রিসিপশনের কথা বাড়ির সকলে জানে। রেনু আগ্রহ দেখাচ্ছে একটু বেশিই। তার এখন না কি আবার নতুন জামা জুতাও লাগবে। মা’কে বলেছে এই কথা; মা টাকা দিয়ে বলেছেন, কোনো এক কাকীর সাথে গিয়ে কিনে নিয়ে আসতে। কিন্তু দস্যি মেয়ে কি আর কথা শোনার পাত্রী! সে কাউকেই সাথে নিবে না। নাচতে নাচতে গিয়ে দাঁড়াল বিচার মহলের পেছনের কক্ষের সামনে। গলা ছেড়ে ডাকল,
‘ইশফাক, ইশফাকুর রহমান, শুনছেন?’
সাড়া নেই কোনো। রেনু ফের ডাকে,
‘ইশফাক, আমি ডাকছি আপনাকে। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
তাও রা হীন নীরব পরিবেশ। রেনু এবার বিরক্ত হলো। বলল,
‘আপনি বের হয়ে না আসলে আমি কিন্তু এবার ভেতরে চলে আসব।’
ভেতরের মানুষটি তার এহেন হুমকিতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয়ও পেল না বোধ হয়। তাই দেখা মেলল না তার। রেনু নিজের কথা রাখল, আদ্যোপান্ত না ভেবেই ঢুকে পড়ল সেই কক্ষে। কক্ষ খালি। বদ লোকটা কোথায় কে জানে? রেনু আরাম করে তার বিছানায় বসল। গোসলখানা থেকে আওয়াজ আসছে, সে নিশ্চয়ই সেখানে। কিছুক্ষণ বসল রেনু। হুট করেই শব্দ করে গোসলখানার দরজাটা খুলল, বেরিয়ে এল তার কাঙ্খিত পুরুষ। আচমকা তাকে দেখে স্তব্ধ হলো রেনু। উদম গায়ে আধভেজা শরীরের পুরুষকে দেখে কিশোরী মন উদাসীন হয়ে পড়ল। ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখা মাত্রই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিল ইশফাক। চট করে গায়ে গামছা জড়িয়ে বলল,
‘অনুমতি ছাড়া আপনি আমার রুমে কেন এলেন?’
রেনু ভড়কে যায়। অস্বস্তিতে পড়ে ভীষণ। আমতা আমতা করে বলে,
‘ন-না মানে ডাকছিলাম আপনাকে, শুনেননি বলে ভেতরে চলে এসেছি।’
‘আপনি তো দেখছি আমার জীবন নেওয়া না অবধি ক্ষান্ত হবেন না।’
কথা বলতে বলতে ইশফাক আলমারি খুলে একটা পাঞ্জাবী বের করল। রেনু নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। ইশফাক তার দিকে ফিরে বলল,
‘আমার জামা পাল্টানোটাও কি দেখতে চান?’
রেনু চকিতে তাকায়। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ছি, কী বলছেন! আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, আপনি দ্রুত জামা পরে বাইরে আসুন।’
রেনু বের হয়ে গেল। বাইরে এসে বুকে হাত দিতেই মনে হলো, হৃদকম্পন কয়েক মুহূর্তের ভেতরে যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠেছে। দৃষ্টিপটে ইশফাকের উদম বক্ষঃস্থল ভেসে উঠতেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল সে। মনে মনে কিছু বেহায়া চিন্তা ভাবনা করে বসল। নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জায় কুন্ঠিত হলো, এভাবে ফের ভাবল, ফের লজ্জা পেল।
ইশফাক বাইরে এসে দাঁড়ায়। রেনুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সামনে পা বাড়াতেই ক্ষিপ্ত হয় রেনু। কোমরে হাত দিয়ে বলে উঠে,
‘এই যে, কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কাজ আছে আমার।’
‘এই মুহূর্তে আপনার অন্য কোনো কাজ করা নিষেধ। আম্মাজানের হুকুম, আমাকে নিয়ে আপনি এখন মার্কেটে যাবেন; ভাইজানের রিসিপশনের জন্য জামা কিনব আমি।’
ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,
‘আশ্চর্য, আমি কেন?’
‘তো, আর কে যাবে? আম্মাজানের হুকুম, অগ্রাহ্য করবেন না নিশ্চয়ই।’
ইশফাক সরু চোখে তাকায়। মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। রেনু তাড়া দিয়ে বলে,
‘আরে চলুন না। তাড়াতাড়ি গেলে তাড়াতাড়িই ফেরা যাবে।’
‘আপনি কি আমার সাথে একা যাবেন?’
রেনু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘জি জি।’
ইশফাকের মুখটা ছোট হয়। এই মেয়েকে একা সামলাবে কী করে? সারাক্ষণ যা চোটপাট করে। আজকে তার সাথে একা গেলে যে আবার কী কী করে বসে, কে জানে।
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️