প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২১।

0
80

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।

মনোহর নদীর উত্তর পাড়ে রয়েছে এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছটি ভরে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন, এক টুকরো রক্তের খ’ন্ড সেটা। তনুকা সেদিকেই তাকিয়ে আছে। মেহতাব তার পাশেই। এক পল পরে তনুকা মনোযোগ ভেঙে মেহতাবকে দেখে। বলে,

‘আমাকে একদিন নদীর ওপারে নিয়ে যাবেন?’

‘কেন? ওপারে কী?’

‘ঐ যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখে সামনে থেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’

কিঞ্চিৎ হেসে মেহতাব বলে,

‘ঠিক আছে, নিয়ে যাব।’

তনুকা খুশি হয়। আবার তাকায় সামনের দিকে। মনোহর নদীতে শান্ত স্রোত। বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের আলো ঝলমল করছে সেখানে। একপাশটা সোনালী লাগছে তাই। মেহতাব তখন বলে,

‘জানো, এই সুন্দর চমৎকার নদীটা মানুষের সব কলুষিত কাজের স্বাক্ষী।’

তনুকা চকিতে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কীভাবে?’

‘এই নদী থেকে বেশ কয়েকটা লা’শ উদ্ধার করেছে পুলিশ। যাদের খুব কুৎসিত ভাবে খু’ন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো খুনীকে আজও ধরা যায়নি।’

‘খুনী বোধ হয় খুব চালাক ব্যক্তি। প্রমাণ রাখে না কোনো।’

মেহতাব হাসে। বলে,

‘কতদিন আর চালাকি করবে? ধরা তো একদিন না একদিন তাকে পড়তেই হবে।’

‘তা অবশ্য ঠিক। অন্যায়কারী বেশিদিন টিকতে পারে না, কোনো না কোনো ভাবে ধরা ঠিকই পড়ে যায়।’

মেহতাব জবাবে আর কিছু বলে না। ঘাটের দুদিকে দুজন বসা। দৃষ্টি দুজনেরই নদীর স্রোতে। তনুকা হঠাৎ বলে,

‘অনেকক্ষণ যাবত রেনুকে দেখছি না, ও কোথায়?’

‘আছে হয়তো আশেপাশে। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না, ওর এসব জায়গা মুখস্থ।’

আরেকটু সময় নীরবে অতিবাহিত হবার পর মেহতাবের ফোনে কল আসে। তনুকা চেয়ে বলে,

‘আপনি কথা বলুন, আমি বরং রেনুকে খুঁজে নিয়ে আসি।’

মেহতাব ফোন বের করতে করতে বলে,

‘দূরে কোথাও যেও না কিন্তু।’

‘না, যাব না।’

তনুকা উঠে আসে। রেনুকে আশেপাশে পায় না সে। হাঁটতে হাঁটতে সামনে আসে বেশ কয়েক পা। এখানে বেশ কিছু গাছ সারিবদ্ধ ভাবে লাগান। এক গাছের আড়ালে রেনুর সবুজ রঙের স্কুল ড্রেসটা দেখা যাচ্ছে। তনুকা তাকে ডাকতে নিয়ে আচমকা থেমে যায়। মনে হয়, রেনু একা নয়, পাশে আরো একজন আছে। তাই আঁড়াল হয়ে দাঁড়ায় সে। কিন্তু অপর পাশের ব্যাক্তির মুখটা গাছের জন্য দেখতে সক্ষম হয় না। তনুকা ভাবে, সরাসরি গিয়ে চমকে দিবে। তবে সে গাছের আঁড়াল থেকে বের হবার আগেই সামনে থেকে রেনু উধাও। ভড়কে যায় তনুকা। এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে মেয়েটা উধাও হয়ে গেল কী করে? তনুকা খুঁজতে আরম্ভ করে তবে, এইদিকে পায়না কোথায়। তনুকা ফিরে আসতে নিলেই পুনরায় রেনুকে দেখে, গাছের সাথে হেলান দিয়ে বিস্কুট খাচ্ছে। অকস্মাৎ তাকে দেখে ফের চমকায় তনুকা। জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে কী করে?’

রেনু হাসে। বলে,

‘আমি উধাও হব কেন? আমি তো এখানেই ছিলাম, তুমি এতক্ষণ কী খুঁজছিলি বলোতো?’

‘তোমাকেই খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলে তুমি?’

‘কিছুটা সামনে একটা দোকান আছে, সেখানেই গিয়েছিলাম। এই যে এই চিপস বিস্কুট কিনতে।’

তনুকা তার হাতে দেখে একটা বড়ো শুকনো খাবারের প্যাকেট। কিন্তু তাও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না সে। তবে কি তখন ভুল দেখেছিল? ঐটা রেনু ছিল না? না, ড্রেসটা তো স্কুল ড্রেস’ই ছিল। আর ঐ লোকটার পোশাক…অল্প ভেবেই তনুকার মনে এল, ঐ লোকটার পোশাক তো ইশফাকের মতো ছিল। কালো রঙের পাঞ্জাবী। এত বড়ো ভুল নিশ্চয়ই তার হবে না। মেয়েটা মিথ্যে বলছে তাকে, কিছু লুকাতে চাইছে।

তাও তনুকা আর ঘাটাল না। বলল,

‘চলো, তোমার ভাইজান বাসায় ফিরবেন বললেন।’

‘ওমা, গ্রাম পর্যবেক্ষণ শেষ?’

‘হ্যাঁ, উনি তো তাই বললেন।’

______

ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মহলে ফিরে সবাই। তনুকার যদিও আরেকটু ঘোরার শখ ছিল তবে, মেহতাব জানায় তাদের নামিয়ে দিয়ে তাকে না কি আবার কোন জরুরি কাজে বেরুতে হবে। সেজন্য তনুকাও আর দ্বিমত করেনি।

সন্ধ্যার নামাজ শেষ করে ঊর্মি তনুকার কক্ষে আসেন। দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

‘আসব?’

তনুকা গলার স্বর ধরতে পেরে বলে,

‘হ্যাঁ, আসুন।’

ঊর্মি ভেতরে প্রবেশ করেন। তনুকা শুয়ে ছিল। তাকে দেখে উঠে বসে। বলে,

‘বসুন না।’

তিনি তনুকার পাশে বসলেন। তনুকার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো, মা?’

তনুকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘অসুবিধা হলে কি চলে যেতে পারব? পারব না তো। সুবিধা অসুবিধা নিয়েই থাকতে হবে, তাই এতকিছু ধরে লাভ নেই।’

ঊর্মি হতাশ চোখে চাইলেন। বললেন,

‘মেহতাব কি যত্ন করছে না তোমার?’

তনুকার হেসে বলে,

‘উনার চেয়ে ভালো এই বাড়ির কেউই আমাকে বাসেন না বোধ হয়।’

‘এভাবে বলছো কেন, মা? আমরাও তো তোমায় ভালোবাসি।’

তনুকা জোরে নিশ্বাস ফেলে। বলে,

‘যাক, এইটুকু শুনে ভালো লাগল।’

ঊর্মি এরপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,

‘একটা কথা বলব?’

‘না।’

তনুকার কাছ থেকে সরাসরি নাকচ শুনে মনঃক্ষুন্ন হয় ঊর্মির। তনুকা বলে উঠে,

‘আপনার কোনো কথা শুনতে এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে না।’

ঊর্মি দুঃখী চিত্তে উঠে দাঁড়ান। আর কিছু বলার ইচ্ছে হয়না তাঁর। ঘরে থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর রান্নাঘরে চলে যান সকলের জন্য চা বানাতে।

________

‘তুমি এখানে বসে বসে খালি ঠোঁটে রং ঘঁষো। আর ঐদিকে এইটুকু একটা মেয়ে আমাদের সবার নাকে দড়ি দিয়ে এই জমিদারী নিয়ে যাচ্ছে বলে।’

রাহীলা কপাল কুঁচকালেন। হাতের লিপস্টিকটা শব্দ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বলে উঠলেন,

‘তো এখন আমি কী করব? তুমি নিজেও তো তোমার ভাতিজার মুখের উপর কিছু বলতে পারো না, আবার এসেছো আমাকে বলতে।’

‘দেখো, এমনিতেই মাথা গরম। এসব উল্টা পাল্টা কথা বলে আর মাথা গরম করো না। তুমি কী বোঝবে আমার কষ্ট! আমি যে তলে তলে কী করছি তা কেবল আমি জানি।’

রাহীলা ঘুরে বসলেন। অধিক আগ্রহ সমেত বললেন,

‘এই এই, কী করছো তুমি?’

‘বাঘের কাছ থেকে বাঘিনীকে সরিয়ে নিলে বাঘ এমনিতেই দূর্বল হয়ে যাবে। তখন শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আর থাকবে না। আপাতত আমি সেই ব্যবস্থাই করছি।’

রাহীলা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললেন,

‘শুনো, সাবধানে করবে সব। বাঘ কিন্তু শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত।’

মতিব মজুমদার দাঁত বের করে হাসলেন। বিশ্রী দেখাল সেই হাসি। তবে রাহীলার চোখে তাই যেন স্বর্গ সুখ। তিনি বললেন,

‘ভয় নেই। এবার আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছি।’

___________

‘এই ছুড়িতে ধার নেই কেন? ধার করে রাখোনি?’

‘জি, সকালেও তো ধার ছিল। এখন কী হলো, বুঝতে পারছি না।’

ছুড়িটা দূরে ফেলে সে বলল,

‘বাদ দাও, চাপাতি’টা নিয়ে এসো।’

তার কথা মতো চাপাতি হাজির করা হলো। চাপাতি হাতে তুলে হাসল সে। দায়ের আগায় আঙ্গুল টেনে ধার পরীক্ষা করে বলল,

‘বাহ, এতে বেশ ধার।’

অতঃপর সে প্রথম কো’প বসাল হাতের কব্জি বরাবর। সঙ্গে সঙ্গেই কব্জি খুলে হাত আলাদা হয়ে এল। তারপরের কো’পটা বসাল কনুই বরাবর। ঐটুকু অংশও আলাদা হতে সময় নিল না। র’ক্তের স্রোতে টেবিল ভেসে যাচ্ছে যেন। টপটপ করে শব্দ হচ্ছে নিচে পড়ন্ত র’ক্তের। লোকটার পরনে সাদা পরিচ্চদ-রক্ষক বহিরাবরণটা র’ক্তে রক্তিম হয়ে ওঠল। হাত ভিজে গেল তাজা লাল র’ক্তে। চোখে মুখেও বিন্দু বিন্দু তারই অস্তিত্ব। একটা শরীরের অনেকগুলো টুকরো যত্ন করে একটা পলিথিনে ঢুকানো হলো। তারপর সামনে চেয়ে লোকটি হেসে বলল,

‘ফ্রিজে রেখে দাও তো।’

কথা মতো পলিথিনগুলো সব ফ্রিজে রাখা হলো। কাজ শেষে গা থেকে পরিচ্চদ-রক্ষক বহিরাবরণটা খুলে ফেলল সে। বিরক্ত গলায় বলল,

‘গোসল করতে হবে। গিজারটা অন করে এসো।’

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here