#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।
‘আমি আপনার সাথে আর ঘুরতে পারব না; পায়ে ব্যথা ধরেছে আমার। এবার যেকোনো একটা ড্রেস কিনুন তো।’
‘এইটুকু হেঁটেই পায়ে ব্যথা ধরেছে, আশ্চর্য! আপনি তো দেখছি ভীষণ দূর্বল। রোজ দুই গ্লাস করে দুধ খাবেন, তাহলে গায়ে অনেক বল পাবেন।’
তেতিয়ে উঠল ইশফাক। বলল,
‘ঠাট্টা করছেন আমার সাথে?’
‘না। ঠাট্টা কেন করব? ভালো কথা বলেছি; শুনলে শুনবেন, না শুনলে নাই।’
‘আপনি আর কিছু না বলে দয়া করে এবার কিছু একটা কিনুন, আমার পক্ষে আর ঘোরা সম্ভব না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, চলুন না ঐ দোকানটাতে যাই। এটাই লাস্ট, আর ঘুরব না।’
ইশফাক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গত দু ঘন্টা যাবত মেয়েটা একই কথা বলে যাচ্ছে। তাই বিরক্ত হয়ে সে বলে,
‘চলুন।’
অনেক দেখে এবার গিয়ে একটা জামা মনে ধরে তার। লাল রঙের গাউন একটা। ইশফাকেরও পছন্দ হয়, তবে রেনুর সামনে সেটা প্রকাশ করে না। রেনু দামাদামি করে দাম দেয়। খুশি মনে ইশফাককে বলে,
‘এবার চলুন, অল্প কিছু জুয়েলারি কিনে চলে যাব।’
ইশফাক বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘আবার জুয়েলারি?’
‘ওমা, ম্যাচিং জুয়েলারি পরতে হবে না?’
বেচারা, তার আর কিছু করার নেই। অগত্যাই পিছু যায় তার। জুয়েলারি দোকানে গিয়েও একই অবস্থা; পুরো দোকান এক করে ফেলেও কিছু পছন্দ করতে পারছে না সে। ইশফাক একপাশে মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে পণ করেছে, জীবনেও সে বিয়ে করবে না। এই মেয়ে জাতির কেনাকাটা নিয়ে বিদঘুটে এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আজ তার। বিয়ে করলে আজীবন এই কষ্ট সহ্য করতে হবে।
ইশফাক নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ কী দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। তাদের বরাবর আরেক দোকান থেকে এইদিকেই একটা ছেলে চেয়ে আছে। যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেনুতে স্থির। ইশফাক অনেকক্ষণ খেয়াল করে সেটা। ছেলেটা চোখ নাড়িয়ে চাড়িয়ে যেন রেনুর পুরো শরীর মুখস্থ করছে। আচমকা তীব্র রাগে গর্জে উঠে ইশফাক। ছেলেটার দৃষ্টি ভীষণ কুৎসিত, বুঝতে তার বেশি বিলম্ব হয়নি। চোয়াল শক্ত হয় তাতে। বড়ো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ছেলেটার মুখ বরাবর। ইশফাকের অকস্মাৎ আগমনে ছেলেটা ভড়কে যায়। পরে বিরক্ত হয়ে বলে,
‘কী ভাই, এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন?’
ইশফাক চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘ঐদিকে কী দেখছিস?’
ছেলেটা আমতা আমতা করে বলে,
‘ক-কোন দিকে? আমি তো এমনিই এদিক ওদিক দেখছি।’
ইশফাক গর্জে উঠে বলে,
‘এদিক ওদিক দেখছিস, না কি মেয়েদের শরীর মুখস্থ করছিস?’
‘এই এই, একদম বাজে কথা বলবেন না।’
‘বাজে কথা না কেবল, বাজে কাজ করে দেখাব। চোখ তুলে মাটিতে পুঁতে দেব, শালা। ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ের দিকে এভাবে তাকাবি না, সাবধান করছি।’
ছেলেটাও আর চুপ থাকে না। ক্রোধ নিয়ে বলে,
‘কেন রে, তাকালে কী করবি শুনি?’
ইশফাকের রাগ আকাশ ছুঁলো। সে সজোরে ঠা’স করে এক চ’ড় বসাল ছেলেটার গালে। সঙ্গে সঙ্গেই ঝিনঝিন করে শব্দ হতে লাগল তার কানের ভেতর। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে বধির মনে হলো যেন। গালে হাত দিয়ে ঢোক গিলল। এক চ’ড়েই কুপোকাত, ব্যাপারটা তাই আরকি। চ’ড়েরও শব্দ হলো খুব। আশেপাশের মানুষ তাই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। দোকানদার বেরিয়ে এসে বলল,
‘কোনো সমস্যা, সাহেব?’
ইশফাক তার দিকে চেয়ে বলল,
‘এই ছেলে কে?’
‘আমার দোকানের কর্মচারী। অন্য গ্রাম থেইকা আইজই প্রথম আইছে। ও কি কিছু করছে, সাহেব?’
‘জমিদার বাবুর বোনের দিকে নজর দিয়েছিল; কপাল ভালো যে, এখানে জমিদার বাবু নেই, থাকলে আর এই চোখ দিয়ে অন্যকিছু দেখা আর হয়ে উঠত না।’
দোকানদার ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। হাত জোড় করে বলল,
‘মাফ করবেন, সাহেব। নতুন তো বুঝে নাই। বাবুরে কিছু জানাইয়েন না, তাইলে মার্কেটে আর দোকনডা থাকত না আমার।’
‘ঠিক আছে, জানাব না। এই ছেলেকে সাবধান করবেন, ভবিষ্যতে যেন আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে না তাকায়।’
‘জি জি, আমি কইয়া দিমু।’
ইশফাক ফিরে এসে ফের রেনুর পাশে দাঁড়ায়। রেনুর হাতে একটা সুন্দর নেকলেস। ভারি পছন্দ হয়েছে তার। সে নেকলেসে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ছেলেটাকে মারলেন কেন?’
ইশফাক ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ঐদিকেও মনোযোগ ছিল?’
রেনু মৃদু হেসে বলে,
‘তার আমাকে ভালো লাগছিল বলে তাকিয়ে ছিল, তাই বলে এভাবে মা’রবেন তাকে। সবাই কি আর আপনার মতো নির্দয় যে, সুন্দর জিনিস কাছে পেয়েও ধরে রাখতে চাইবে না।’
ইশফাক কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘ছেলেটা যে তাকিয়ে ছিল সেটা বুঝেও আগে বলেননি কেন?’
‘এই কাজটা করবেন বলেই বলিনি।’
‘ভবিষ্যতে আর এমন কিছু করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করবেন।’
‘আপনি আছেন তো প্রতিবাদ করার জন্য।’
‘সবসময় থাকব না।’
‘জোর করে রেখে দিব।’
‘সম্ভব না। কেনাকাটা হলে চলুন।’
রেনুর মনঃক্ষুন্ন হলো খুব। পছন্দ হওয়া নেকলেসটা দোকানদারের হাতে দিয়ে বলল,
‘এটা রেখে দিন।’
দোকানদার বলল,
‘আপনার না এটা খুব পছন্দ হয়েছিল, নিবেন না?’
‘না, এখন আর পছন্দ হচ্ছে না। চলুন।’
রেনু দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার যাওয়ার পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইশফাক, অতঃপর দোকানদারকে বলল,
‘এটা প্যাক করে দিন।’
________
‘যদি তোমাদের কারোর সাথে না’ই গিয়ে থাকে, তবে কার সাথে গিয়েছে মেয়েটা?’
মেঝ, ছোট দুই জা’য়ের উপর খুব চেঁচাচ্ছেন আম্বিরা বেগম। কথামতো, তাঁদের কারোর সাথে রেনুর মার্কেটে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ তাঁরা কেউ যায়নি কিন্তু, মেয়েটা ঠিকই গিয়েছে। কার সাথে গিয়েছে সেই চিন্তায় বর্তমানে অস্থির আম্বিরা বেগম। মেহতাবও ঘরে নেই। সেই সকালে বেরিয়েছিল, এখনো ফেরেনি। সকালে নাস্তার টেবিলে তনুকাকে একবার দেখা গিয়েছিল, এরপর তাকেও আর দেখা যায়নি। মেঝ কাকী ঊর্মি বলে উঠলেন,
‘তনুকার সাথে যায়নি তো আবার?’
‘বাড়ির বউ, আমাকে না বলে কয়ে কেনাকাটা করতে চলে যাবে? এইটুকু জ্ঞানবোধ নিশ্চয়ই ওর আছে?’
ঊর্মি মাথা নোয়ালেন। এমনটা তো তারও মনে হচ্ছে না। মেয়েটা এমন দায়িত্ব কর্তব্যহীন না। এইটুকু বোঝ ওর আছে।
একজন ভৃত্য সেই মুহুর্তে কক্ষে এসে বলে,
‘ইশফাক সাহেব তার কক্ষে নেই, বড়োমাতা।’
‘সে আবার কোথায় গেল?’
আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন। ভৃত্য বললেন,
‘পাহারাদার বলেছে, উনাকে গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখেছে। কোথায় গিয়েছে, জানে না।’
‘সাথে আর কেউ ছিল?’
‘সেটা ওরা দেখেনি।’
রাহীলা তখন চট করে বলে উঠলেন,
‘রেনু আবার তার সাথে যায়নি তো?’
আম্বিরা বেগম ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দিলেন,
‘আমার মেয়ে একজন সহকারীর সাথে একা কেনাকাটা করতে চলে যাবে? এই চিন্তা তোর মাথায় এল কী করে, ছোটো?’
রাহীলা বোকা বোকা হেসে বললেন,
‘না না, এমনিতেই বললাম আরকি।’
‘আন্দাজে কথা না বলে চুপ থাক, এমনিতেই মাথা গরম আমার।’
রাহীলা সবার চক্ষু আঁড়ালে মুখ ভেংচি দিয়ে চুপ হলো।
হাতে ব্যাগ চেপে ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকছিল রেনু। ভয় পাচ্ছে এখন, ভেতরে গিয়ে কী জবাব দিবে তাই ভেবে। আচমকা তখন পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডেকে উঠে,
‘রেনু, কোথ থেকে এলে?’
ভয়ে কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে উঠে পেছন ফেরে সে। তনুকাকে দেখে বুকে ফুঁ দেয়। হেসে বলে,
‘তোমাদের রিসিপশনের জন্য জামা কিনতে গিয়েছিলাম।’
তনুকা হেসে বলে,
‘তাই? কার সাথে গিয়েছিলে?’
রেনু ইতস্তত সুরে বলে,
‘ইশফাক ভাইয়ের সাথে।’
‘একা?’
রেনু উপর নিচ মাথা নাড়ায়। তনুকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘বাড়িতে বলে গিয়েছিলে?’
রেনু অসহায় ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বলে। তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘এখন শুনলে মা রাগ করবেন না?’
রেনু বিষন্ন সুরে বলল,
‘খালি রাগ? তুলকালাম কান্ড বাঁধাবেন।’
তনুকা মুচকি হেসে রেনুর গালে হাত রাখে। বলে,
‘চলো, আমিও একটু দেখে আসি সেই তুলকালাম কান্ড।’
রেনু অসহায় সুরে বলে উঠল,
‘বউমনি!’
তনুকা হাসল। বলল,
‘বউমনির কাছে সবকিছু শেয়ার না করলে, বউমনি মোটেও তোমাকে সাহায্য করবে না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। সব শেয়ার করব, তুমি শুধু আজকের মতো আমাকে বাঁচিয়ে দাও।’
‘ঠিক আছে। ভেবে নাও, আজ তুমি একদম সেইফ।’
চলবে…..