প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৭।

0
77

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।

জুম্মার নামাজ শেষ হতে না হতেই মহলের বাইরে গ্রামবাসীর ভিড় নামে। পুরুষেরা খেয়ে চলে গেলেও, নারী জাতির আবদার, তারা নতুন বউ দেখবে। তনুকা মহলের ভেতর। বসার ঘরে বড়ো কেদারা এনে তার আসন করা হয়েছে। সেই আসনে বসার পর থেকেই, নিজেকে কোনো অংশে কোনো রাজ্যের রাণীর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না যেন। মহিলারা আসছে, একে একে দেখছে। প্রশংসায় ভাসছে সকলে। নতুন বউ তাদের কাছে কোনো হুরের চেয়েও কম কিছু না।

মেহতাব খাবারের আয়োজন দেখছে। গ্রামবাসী সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি। বিরিয়ানির গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। সকলে পেট পুরে খাচ্ছে। এই বিরিয়ানির মাংসের স্বাদ যেন অমৃতের ন্যায়। সকলের ভাবমূর্তি দেখে খুশি হয় মেহতাব। গ্রামের মানুষদের চোখে মুখে খুশি দেখলে, খুশি আসে তার বক্ষঃস্থলেও।

_______

বড্ড শখের এই লাল জামা। উচ্চতায় তার থেকেও দুই তিন ইঞ্চি বেশি। যার দরুন এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রেনু হাঁটুর কাছের অংশটা দুহাতে চেপে ধরে অল্প উপরে তুলে। তারপর ছোট ছোট পায়ে বেরিয়ে আসে মহল ছেড়ে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ইশফাককে একবারও দেখা হয়নি তার। জরুরি তলপে এখন তাকে দেখা প্রয়োজন। সে ধীর পায়ে বাগানের পেছনে আসে। সামনে সামিয়ানার ভেতর পুরুষ মানুষের ঢল। সেখানে সে কোনোভাবেই যেতে পারবে না। ভাইজান দেখলে তার জান নিবে। সে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। হঠাৎ ভেতর থেকে একটি ছেলেকে বেরিয়ে আসতে দেখে খুশি হয়; তাকে হাত উঠিয়ে ডাকে। ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে,

‘কিছু লাগব, আপা?’

‘ভেতরে ইশফাক ভাই আছেন?’

‘জি, আছেন তো।’

‘উনাকে গিয়ে বলুন, কেউ একজন বাইরে ডাকছেন উনাকে। খুবই জরুরি। আর শুনুন, কানে কানে বলবেন, কেউ যেন টের না পায়।’

‘জি, আইচ্ছা।’

ছেলেটা ভেতরে যায়। রেনু দাঁড়িয়ে রয় ঠাই। সময় বয়ে যায় কয়েক ক্ষণ। ইশফাকের দেখা মেলে না। সে ক্ষিপ্ত হয়। ভাবে, একবার দেখা দিলে কী হয়? এত পাষাণ কেন উনি?

তার কষ্ট প্রশমিত করতেই সেখানে ততক্ষণাৎ আগমন ঘটে ইশফাকের। লাল রঙের পান্জাবীতে চমৎকার লাগছে তাকে। রেনু বিস্ময় নিয়ে চেয়ে বলে,

‘আপনি আমার সাথে মিলিয়ে পরেছেন?’

ইশফাক নিজেকে একবার খেয়াল করে বলে,

‘মোটেও না। ভাইজান কাল শপিং করার সময় আমার জন্য এই পাঞ্জাবীটা কিনেছিলেন। বলেছিলেন, আজকে পরার জন্য; তাই পরেছি।’

রেনুর মুখে স্বচ্ছল হাসি উবে যায়। মনঃক্ষুন্ন হলো তার। বলল,

‘আমাকে কেমন লাগছে?’

‘ভালো।’

‘শুধু ভালো?’

‘এর থেকে বেশি প্রশংসা করতে আমি পারি না।’

রেনু বিরক্ত গলায় বলল,

‘পারেনটা কী আপনি?’

‘আপনার ভাইজানের সব হুকুম মানতে।’

‘হ্যাঁ, ঐ একটা কাজ ছাড়া আপনার দ্বারা আর কিছুই সম্ভব না।’

‘এখানে আসাটা আপনার উচিত হয়নি। ভেতরে আপনার ভাইজানও আছেন।’

‘তাতে কী? আমি কাউকে ভয় পায় নাকি?’

ইশফাক ভ্রু উঁচিয়ে রগড় সুরে বলে,

‘তাই? কাউকে ভয় পান না? ভাইজানকে ডাকব?’

‘এই, একদম ভয় দেখাবেন না। আমার আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই এসেছি।’

‘সবসময় কেবল নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলে বিপদে পড়বেন।’

‘পড়লে পড়ব।’

‘আপনি বড্ড অবুঝ। অবশ্য আপনার যা বয়স, এই বয়সে এসব কিছু স্বাভাবিক।’

‘সবসময় বয়স নিয়ে কথা বলবেন না তো। আমার বয়সে আমার সহপাঠী কয়েকজন বিয়ে করে এক বাচ্চার মাও হয়ে গিয়েছে, আর আপনি এসেছেন বয়সের দোষ ধরতে।’

ইশফাক ক্ষীণ হাসে। এতই ক্ষীণ যে রেনু তার হাসিও ধরতে পারল না। ইশফাক বলল,

‘ভেতরে যান। আপনার জন্য আমি কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না।’

‘এত ভীতু কেন আপনি?’

‘এমনিতেই। ভেতরের যান।’

রেনুর মন খারাপ হয় ভীষণ। রাগও হয় কিঞ্চিৎ। কোথায় ভেবেছিল, তার এই লাল পরীর সাজ দেখিয়ে আজ ইশফাককে কুপোকাত করে দিবে, তা না লোকটা তাকে আমলেই নিল না। মাত্রাধিক বিষন্ন হলো সে। ফের জামা ধরে উপরে তুলে চলল মহলের দিকে। ইশফাক ডাকল তাকে। রেনু ভ্রু কুঁচকে ফিরে চাইল। বলল,

‘আর কোনো জ্ঞান দেওয়া বাকি আছে?’

জবাব না দিয়ে এগিয়ে আসে সে। পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়িয়ে বের করে আনে একটা পাথরের সেট। রেনুর চোখের সামনে তা ধরতেই সে চমকে যায়। এটা সেই নেকলেসটা যেটা রেনু দোকানে পছন্দ করেও আর কিনেনি। ইশফাক এটা তাকে দিয়ে বলে,

‘এটা আপনার জন্য।’

রেনুর চোখ মুখ খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। সে আপ্লুত সুরে বলে,

‘আমাকে পরিয়ে দিন।’

‘আমি?’

ইশফাক ইতস্তত বোধ করে। রেনু খুশি হয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, পরিয়ে দিন।’

সে ঘুরে দাঁড়ায়। এক হাতে ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে আনে এক পাশে। জামার গলা পেছনে বড়ো। উন্মুক্ত ফরসা পিঠ দৃশ্যমান। ইশফাক চোখ নামায়। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নেকলেসটা সামনে থেকে এনে পেছনে আটকে দেয়। তারপর বলে,

‘হয়ে গিয়েছে।’

চুল ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রেনু। নেকলেসটায় একবার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এবার কেমন লাগছে আমায়?’

‘ভালো।’

‘আবারও শুধু ভালো?’

‘হ্যাঁ।’

রেনু নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠে,

‘আপনি আসলে ভীষণ তিক্ত এক জীব। উপরওয়ালা জানেন, কী দেখে যে আপনার প্রেমে পড়েছিলাম।’

বলেই হাঁটা ধরে সে। আর দাঁড়াবে না। যদিও এখন আর মন খারাপ নেই। মানুষটা কত যত্ন করে তার জন্য এটা কিনেছেন, আবার পরিয়েও দিয়েছেন। ভালো না বাসলে এতকিছু করত বুঝি?

________

অর্ধেকের বেশি মানুষের খাওয়া শেষ। দমে দমে বিরিয়ানির পাতিল বসানো হচ্ছে। মহলের বিরিয়ানি অনেক আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মহলে। বাইরে থেকে আর কোনো বিরিয়ানি ভেতরে যাবে না।

দুপুর বারোটায় চেয়ারে বসেছিল তনুকা। এখন তিনটা বাজতে চলল। দুই ঘন্টার উপরে টানা এক জায়গায় বসে আছে সে। কোমর যেন ধরে গিয়েছে। এইদিকে বিরিয়ানির গন্ধে খিদাও বাড়ছে তার। অথচ আম্বিরা বেগমের অনুমতি বিহীন খেতেও পারছে না। আম্বিরা বেগম তো কেবল নামে চাবি দিয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে, এখনও মহলের ভেতরে সব তাঁর হুকুমেই চলে। তা নিয়ে অবশ্য তনুকার কিছুই যায় আসে না। এই মহল, এই ক্ষমতা, এই সম্পত্তি কোনোকিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। যেটাতে আগ্রহ আছে, সেটাও যে কখনো তার হবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। তাই এখন অতসব না ভেবে কেবল এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে পেট ঠান্ডা করতে চায় সে।

রেনু ফের বাইরে আসে। তার বেহায়া মন যেন আজকে একটু বেশিই বেহায়াপনা করতে চাইছে। অন্দরে প্রবেশের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়েছে সে। অস্থির দৃষ্টি ঐ দূরের সামিয়ানার ভেতরে, ইশফাকের খোঁজে। এর মাঝেই দুজন ছেলে এক বিশাল মাংসের পাতিল নিয়ে সেদিক দিয়ে পা বাড়ায়। সেই পাতিলে আবার বড়ো করে লেখা, “গ্রামবাসীর বিরিয়ানির মাংস।” রেনু পাতিলের ভেতরে লাল লাল মাংস দেখে আর লোভ সামলাতে পারে না। ওদের ততক্ষণাৎ দাঁড় করিয়ে বলল,

‘আমি এখান থেকে একটা মাংস খাই?’

‘জি আপা, খান। সব তো আপনাদের জন্যই।’

রেনু খুশি হয়ে এক টুকরো মাংস মুখের সামনে তুলতেই আচমকা এক হাত সজোরে ধাক্কা দিয়ে তার সেই হাতের মাংসটা ফেলে দেয়। আকস্মিক এমন ঘটনায় ভড়কে যায় সে। চকিতে উপস্থিত সেই হাতের মালিকের দিকে তাকায়। ইশফাককে দেখে আরেকদফা চমকায় সে। জিজ্ঞেস করে,

‘মাংসট ফেলে দিলেন কেন?’

ইশফাক সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো সেই ছেলে দুটোকে ধমকে উঠে বলল,

‘ভাইজানের হুকুম অমান্য করছো কোন সাহসে? ভাইজান বলেছেন না, গ্রামবাসীর জন্য রান্না করা মাংস মহলের কাউকে যেন দেওয়া না হয়। তবে কোন সাহসে উনাকে খেতে দিচ্ছিলে?’

রেনু হতভম্ব হয় এই কথা শুনে। ছেলে দুটো নত মস্তিষ্কে বলে উঠে,

‘ক্ষমা করবেন সাহেব, উনি চাইছিলেন তাই…’

‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাইজানের হুকুম। তারপর অন্যকিছু। যাও এখান থেকে। ঐদিকে বাবুর্চি মাংসের জন্য অপেক্ষা করছে।’

ছেলে দুজন দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। রেনু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এটা কেমন ব্যবহার? আমি এখান থেকে এক টুকরো মাংস খেলে ভাইজান নিশ্চয়ই মেরে ফেলতেন না। আশ্চর্য! আপনি এমন কেন করলেন?’

‘আপনার ভাইজানের হুকুম তাই।’

‘সামন্য মাংসের উপর এত হুকুমদারি কেন?’

‘জানি না আমি। তবে এইটুকু জানি, গ্রামবাসীর মাংস মহলের কাউকে খেতে দেওয়া হবে না। আর ভাইজানের হুকুমের বিরুদ্ধে না যাওয়াই ভালো।’

রেনু কপাল কুঁচকাল। বলল,

‘এমন অদ্ভুত হুকুম ভাইজান কেন দিলেন?’

‘এতকিছু জেনে আপনার কোনো লাভ নেই। অন্দরে তো মাংস বিরিয়ানি পাঠানো হয়েছে সব, সেখান থেকে খান গিয়ে।’

ইশফাক চলে আসে। রেনু হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয় কিছুক্ষণ। তার মাথাতেই ধরে না, “ভাইজান এমন অদ্ভুত হুকুম কেন দিল? বউমনি কি এই নিয়ে কিছু জানে? তাকেই না হয় একবার জিজ্ঞেস করা যাক।’

রেনু অতঃপর ছুটল, “বউমনি, বউমনি” ডেকে ডেকে।

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here