#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।
তনুকার মুখে এতক্ষণে কিছু পড়েছে। বিরিয়ানির এক লোকমা মুখে তুলতেই মনে হলো, অমৃতের স্বাদ আস্বাদন করছে সে। কী দারুণ হয়েছে! খুদা পেটে তো সব খাবারই অসাধারণ লাগে, তারউপর বিরিয়ানি তার প্রিয়। সে পরপর কয়েক লোকমা খেয়ে একটু স্থির হয়। এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে আবার বাকি খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
দরজাটা শব্দ করে খুলে যায়। আচমকা শব্দে চমকে তাকায় তনুকা। রেনু হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি খেয়েছ, রেনু?’
‘আর খাওয়া! তোমার সাথে একটা জরুরি কথা বলার আছে।’
তনুকা খাওয়া ফেলে পূর্ণ মনোযোগে তাকে দেখে বলে,
‘কী কথা? বলো।’
রেনু পা তুলে বিছানায় বসে। তারপর কিছু সময় পূর্বে ঘটে যাওয়ার ঘটনার বিশদ আলোচনা করে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ভাইজানের এমন অদ্ভুত হুকুমের কারণ তুমি কি জানো, বউমনি?’
তনুকাও নিজেও অবাক সব শুনে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘না, আমি তো এসব কিছুই জানি না। শুনে অবাক লাগছে। তোমার ভাইজানের কাছ থেকে জানতে হবে।’
‘আচ্ছা। তুমি জেনে আমাকেও জানিও।’
‘ঠিক আছে, এখন গিয়ে আগে খেয়ে নাও।’
রেনু উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তনুকা ফের ডেকে বলল,
‘তোমার গলার নেকলেসটা সুন্দর। কবে কিনলে?’
রেনু মিষ্টি হেসে স্বলজ্জ সুরে বলে,
‘কিনিনি তো। ইশফাক উপহার দিয়েছেন।’
তনুকা হেসে বলে,
‘বাবা, তাই। সুন্দর হয়েছে তো।’
‘হু, কাউকে বলো না কিন্তু।’
‘আচ্ছা, বলব না।’
রেনু রুম ছাড়ে। তনুকার বিরিয়ানির প্লেটটা হাতে নেয়। একটা মাংসের টুকরো হাতে নিয়ে ভালোমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,
‘আশ্চর্য, বিরিয়ানির মাংস আলাদা কেন?’
___________
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। তবে মেহতাব এখনও খায়নি। সকল গ্রামবাসী আজ পেট পুরে খেয়ে গিয়েছেন। মেহতাবের আত্মতৃপ্ত হয়েছে তাতে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়েছে সকলকে। বিরিয়ানির প্রশংসা ছিল সকলের মুখে মুখে। এমন স্বাদ যে, আগামী এক বছরেও এই স্বাদ জিভ থেকে যাবে না।
বাইরের সব কাজ মিটিয়ে অন্দরে ফেরে মেহতাব। মহলের ভেতরের পরিবেশও এখন বেশ শান্ত। আম্বিরা বেগম তাকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন,
‘বাবা, জলদি গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসো। সারাদিন কিচ্ছু পেটে পড়েনি, খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?’
মেহতাব হেসে বলে,
‘না আম্মা, গ্রামের মানুষদের খাওয়াতে পেরেছি, তাতেই আমার অন্তর শান্তি।’
‘এইজন্যই তোমাকে নিয়ে আমার এত গর্ব।’
মেহতাব এদিক ওদিক চেয়ে বলে,
‘তনু কি ঘরে?’
‘হ্যাঁ। সেই যে বিকেলে ঢুকেছিল, আর বের হয়নি।’
‘খেয়েছে ও?’
‘তো কি তোমার জন্য না খেয়ে থাকবে? সবার আগেই খেয়ে নিয়েছে।’
‘আহা! এভাবে বলছেন কেন, আম্মা। আমি তো চাই না, ও আমার জন্য না খেয়ে থাকুক।’
‘আচ্ছা হয়েছে, এখন গিয়ে হাতমুখ ধৌও। আমি বিরিয়ানি তোমার ঘরেই পাঠাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে।’
ঘরে এসে মেহতাব দেখল আলো নেভানো। অন্ধকার কক্ষে কারোর নিশ্বাসের শব্দও ঠাহর করা যাচ্ছে না। মেহতাব আলো জ্বালাল তাই। দেখল, খাটে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তার বিবিজান। প্রসন্ন হাসল মেহতাব। তনুকার দিকে এগিয়ে এসে বিছানায় বসল। গায়ের ভারি শাড়ি গয়না খুলে সুতি গামিজ জড়িয়েছে। মুখের উপর প্রসাধনীর রেশ মাত্র নেই। নিরেট শূন্য মুখ, তাও ভীষণ চিত্তাকর্ষক ঠেকছে মেহতাবের নিকট। সে সপ্রতিভ ভঙিতে এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ায় তনুকার কপালে। তারপর দুই চোখের পাতায়। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকায় তনুকা। ঘুম জড়ানো কন্ঠে শুধায়,
‘আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছেন বুঝি?’
মেহতাব ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার কি তাই মনে হয়, বিবিজান?’
‘আপনার কাজ তো তাই প্রমাণ করছে।’
‘ক্লান্ত ভীষণ। একটু স্বস্তি পেতে এসেছিলাম।’
‘আমার মাঝে স্বস্তি খুঁজে লাভ নেই, পাবেন না।’
‘যদি বলি, অবশ্যই পাব।’
তনুকা উঠে বসে। ম্লান হেসে বলে,
‘আমি বলছি তো, সম্ভব না।’
‘মেহতাব মজুমদারের নিকট অসম্ভব বলে কোনো কাজ নেই।’
তনুকা আর ঘাটাল না। প্রশ্ন করল,
‘খেয়েছেন?’
‘না।’
‘ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।’
মেহতাব উঠে ফ্রেশ হতে যায়। গায়ের পাঞ্জাবী পাজামা ছেড়ে একটা ট্রাউজার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে আসে। মেহতাবকে এমন ভাবে খুব একটা দেখা যায় না। সারাক্ষণ পাঞ্জাবী পাজামাতেই থাকে। আজ এই পোশাকে অন্যরকম লাগছে। এতদিনের পুরোদস্তুর সুদর্শন পুরুষকে এখন সদ্য পঁচিশে পা দেওয়া এক উদ্দীপ্ত তরুণ লাগছে। তনুকার দৃষ্টি বেহায়া হয়। তাকে আগাগোড়া মেপে নেয়। নিজের এমন লাগামহীন দৃষ্টিতে বড্ড বিরক্ত সে। চোখ নামিয়ে নিচে তাকায়। মেহতাব তার শিউরে বসেছে। তনুকার নিমজ্জিত দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, তাকাচ্ছো না যে?’
তনুকা জবাব দেয় না। এর মাঝেই এক ভৃত্য বিরিয়ানির প্লেট রেখে যায়। সাথে পানি আর সালাত। মেহতাব ট্রে থেকে প্লেট নিয়ে তনুকার সামনে রাখে। স্বগতোক্তি করে বলে,
‘খাইয়ে দাও তো, বিবি।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
‘আমি কেন? আপনার হাত নেই?’
‘নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর সারাদিনের এত কাজের পর এখন আর গায়ে এইটুকুও শক্তি নেই যে, নিজ হাতে খাব।’
তনুকার মায়া হলো। নিজ চোখে সে মানুষটাকে সকাল থেকে খাটতে দেখেছে। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মানবতার টানে খাবারের প্লেটটা হাতে তুলে নিল। লোমকা তুলল মেহতাবের মুখের সামনে। মেহতাব খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখে নিল খাবার। সারাদিনের ক্লান্তি যেন তার এক নিমিষেই ধুয়ে গেল তাতে।
তনুকা মনোযোগ সহিত খাওয়াচ্ছে মেহতাবকে। তার দৃষ্টি খাবারের প্লেটের দিকে থাকলেও, মেহতাবের নিমিষ দৃষ্টি তার দিকেই তাক করা। তনুকা আরেকবার লোকমা দিয়ে বলল,
‘একটা কথা বলব?’
মুখ ভরা খাবার নিয়ে মেহতাব কেবল ছোট্ট করে “হু” বলল। তনুকা জিজ্ঞেস করল,
‘বিরিয়ানির মাংস আলাদা করেছিলেন কেন?’
এমন প্রশ্নে মেহতাবের কপালে ভাঁজ পড়ে। মুখের খাবারটা গিলে বলে,
‘এটা তো সবসময়ই করি। অন্দর আর গ্রামের জন্য আলাদা আলাদা হিসেবে মাংস করা থাকে, তাই। আমি যতবার গ্রামের মানুষ খাইয়েছি, এই নিয়মেই করেছি। যেন, হিসেবে গোলমাল না হয়।’
মেহতাবের উত্তরে কোনো জড়তা নেই। তনুকা আরেক লোকমা তার মুখে দিয়ে বলল,
‘আপনার সহকারীটা বোধ হয় আপনাকে একটু বেশিই ভয় পায়।’
মেহতাব প্রশ্ন করার আগেই তনুকা প্রশ্নের ধাঁচ বুঝতে পেরেই উত্তর দেয়,
‘গ্রামবাসীর জন্য আলাদা করা মাংস থেকে রেনু একটা মাংসের টুকরো খেতে চেয়েছিল, উনি নাকি সেটুকুও খেতে দেননি। বেচারি রাগ করে এসে বিচার দিয়েছে আমাকে।’
মেহতাব খাবার শেষ করে বলে,
‘ইশফাক আমার খুব বাধ্য। আমি বলেছিলাম, গ্রামবাসীর খাওয়া শেষ না হওয়া অবধি উনাদের মাংস যেন মহলবাসী কাউকে খেতে না দেওয়া না হয়। এতে খাবার শর্ট পড়ার একটা সম্ভবনা থেকে যায়, তাই হয়তো ও এমনটা করেছে।’
‘এক টুকরো মাংস খেলে নিশ্চয়ই খাবার শর্ট পড়ে যেত না?’
‘হ্যাঁ, সেটাই তো। ও হয়তো বুঝতে পারেনি; আমি বুঝিয়ে বলব ওকে।’
মেহতাবের খাওয়া শেষ। সে মুখ ধুয়ে এসে তনুকার ওড়না টেনে মুখ মুছে। বিরক্ত হয় তনুকা। ওড়না টান দিয়ে সরিয়ে নেয়। মেহতাব গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম তার। তনুকা ততক্ষণে খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। প্লেট সব গুছিয়ে রেখে সে রেনুর ঘরে যায়। এবার আর দরজায় টোকা দেয় না। রেনুই নিষেধ করেছিল তাকে।
ঘরে গিয়ে তাকে পায় পড়ার টেবিলে। তনুকা চুপি চুপি পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটাকে দেখে, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ইশফাকের দেওয়া সেই হারটাকেই দেখছে। তনুকা কিঞ্চিৎ হাসে। বলে উঠে,
‘দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই হারে কয়টা পাথর আছে সেটাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে?’
অকস্মাৎ কারোর গলার স্বর পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে রেনু। বইটা বন্ধ করে দেয় সঙ্গে সঙ্গে। পরে তনুকাকে দেখে নিশ্বাস ফেলে। আরেকটু হলেই দম আটকে মারা যাচ্ছিল। বুকে থু থু দিয়ে বলে উঠে,
‘ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে, বউমনি।’
তনুকা হাসতে হাসতে টেবিলের আরেক চেয়ারে বসে। বলে,
‘তোমার এই ইশফাক বাবু তো বড্ড ভীতু।’
তারপর সে মেহতাবের বলা কথাগুলো খুলে বলে। রেনু মাথায় হাত দিয়ে বসে সব শুনে। আফসোস নিয়ে বলে,
‘ভাইজান হুকুম দিয়েছিলেন বলে, এক টুকরো মাংসও উনি আমাকে খেতে দিলেন না? আশ্চর্য, এই লোকটা এত আহাম্মক কেন? আমি খেয়েছি জানলে, ভাইজান নিশ্চয়ই রাগ করতেন না?’
‘একদমই না। বরং তোমাকে তখন খেতে না দেওয়াতে ইশফাক ভাইয়ের উপর উনি এখন রাগ করেছেন।’
‘বেশ হয়েছে। এবার ভাইজান গিয়ে উনাকে আচ্ছা মতো শুনিয়ে আসুক, আমি খুশি হবো।’
‘তাই আর…’
তনুকা বাকি কথা শেষ না করেই থেমে যায়। হঠাৎই কারোর কান্নার শব্দে বুকে মোচড় দেয় তার। কেউ একজন বিকট শব্দে কাঁদছেন। ততক্ষণে রেনুর কানেও সেই শব্দ চলে আসে। এক সেকেন্ড সময় নিয়ে রেনু চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘বউমনি, আম্মা এভাবে কাঁদছেন কেন?’
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️