#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।
‘মা, আসব?’
আম্বিরা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসলেন। মৃদু হেসে বললেন,
‘এসো এসো।’
রাদাভ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। আম্বিরা বেগম বললেন,
‘বসো।’
রাদাভ বসল। বলল,
‘ভালো আছো?’
এই ক্ষণে এমন অযাচিত প্রশ্নে অবাক হলেন আম্বিরা বেগম। বললেন,
‘হঠাৎ ভালো আছি কিনা জিজ্ঞেস করছো যে?’
‘ঐ যে বাবা মারা গেলেন না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
আম্বিরা বেগম কপালে ভাঁজ ফেললেন। গম্ভীর সুরে বললেন,
‘তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’
রাদাভ তাচ্ছিল্য ভাবে হাসল। বলল,
‘আমার কথা তুমি কবেই বা বুঝেছো? সবসময় তো বুঝেছো কেবল তোমার বড়ো ছেলে মেহতাব মজুমদারের কথা। আমি তো তোমার কাছে ফেলনা বৈ আর কিছুই না।’
আম্বিরা বেগম অস্থির হলেন। চোখ মুখ কুঁচকালেন মাত্রাতিরিক্ত। বললেন,
‘এসব কী কথা, রাদাভ? আমার কাছে আমার দুই ছেলেই সমান। তোমাদের মধ্যে আমি কখনো ফারাক করিনি।’
রাদাভ হাসল। বলল,
‘মিথ্যেটা তুমি খুব ভালো বলতে পারো। যাকগে সেসব; এখন আসল কথা বলো, বাবা মারা গেলেন কী করে?’
আম্বিরা বেগম নাক মুখ কুঁচকে অন্যদিকে চাইলেন। বোঝালেন, এহেন প্রশ্নে ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন তিনি। তাও জবাবে বললেন,
‘জানি না আমি। রাতে উনার ঘরে গিয়ে মৃ’ত দেখেছিলাম।’
‘হুট করেই মারা গেল? একবার ডাক্তারও ডাকলে না?’
‘তোমার বাবা আরো আগ থেকেই অসুস্থ ছিলেন, সেটা তুমিও জানতে। আর ইদানিং উনি একটু বেশিই দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। মেহতাবের অনুষ্ঠানের পর ডাক্তার আসার কথা ছিল কিন্তু, তার আগেই তিনি…(দীর্ঘশ্বাস ফেলেন)। এতদিন বাবার এত অসুস্থতার খবর পেয়েও আসলে না, আর এখন বাবা মারা যাওয়াতেই এত প্রশ্ন? বাবার প্রতি এত চিন্তা তোমার আগে কোথায় ছিল?’
রাদাভ চোয়াল শক্ত করে নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘বাবার বড়ো ছেলে মেহতাব মজুমদার ছিল বলে আসার প্রয়োজন বোধ করিনি।’
‘তবে এখন কেন এসেছ?’
‘বাবার দায়িত্ব পালন করতে।’
‘শুধু কি দায়িত্ব পালন করাই তোমার উদ্দেশ্য?’
রাদাভ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। আম্বিরা বেগম হেসে বললেন,
‘আর যাই হোক, নিজের ছেলেদের আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারি। যা ভেবে এসেছ, তা কখনোই সম্ভব না; অন্তত মেহতাব বেঁচে থাকতে তো না’ই।’
‘আর মেহতাব ম’রে গেলে?’
আম্বিরা বেগম ভ্রু উঁচিয়ে বিদ্রুপের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কে মা’রবে? তুমি?’
জবাবে শব্দ করে হাসল রাদাভ। উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘সেটা সময় এলেই দেখবে। আপাতত গেলাম, আবার কথা হবে।’
সে বেরিয়ে যায়। আম্বিরা বেগম শুয়ে পড়লেন। মাথায় হাত ঠেকালেন। চিন্তা হচ্ছে তাঁর। দুই সিংহ জন্ম দিয়েছেন তিনি। যেদিন সেই সিংহদ্বয়ের মাঝে যুদ্ধ লাগবে, সেদিন আর এই রাজত্ব আস্ত থাকবে না; এটা তিনি এখনই বেশ বুঝতে পারছেন।
_____________
তনুকা ছাদে। বিকেল এখন। সূর্য তাই হেলে আছে পশ্চিম পানে। ঐদিকের আকাশটা রক্তিম। একদিকে কিছু হলুদের ছোঁয়া। ছাদ থেকে দূরের পিচ ঢালা রাস্তাটা স্পষ্ট। আজও সেখানে দুইজন মানুষ। দুজনই পরিচিত তার। একজন দেবর, অন্যজন কাকা শ্বশুর। তাদের মধ্যে চলছে গম্ভীর আলাপ। তনুকা নীরবে কিছুক্ষণ দেখে তা। পরে সরে আসে। ছাদের এক কোণে নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে রয়। জীবনের এই অগোছালো সমীকরণ নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে। কার সাথে যোগ দিবে আর কার থেকে বিয়োগ করবে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। অথচ, তার মাথায় বিশাল দায়িত্বের বোঝা। সে ক্লান্ত বোধ করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে চেয়ে। তারপর ছাদ থেকে নেমে ঘরে ফিরে।
মেহতাব ঘরেতেই কিছু কাগজপত্র নিয়ে বসেছে। তনুকা তার পাশে গিয়ে বসে। মেহতাবের পূর্ণ মনোযোগ তার হাতের কাগজে হলেও তনুকার একনিষ্ঠ মনোযোগ মেহতাবের দিকেই। সে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। হঠাৎ প্রশ্ন করে,
‘বিশ্বাসঘাতককে কী শাস্তি দেন আপনি?’
মেহতাব শান্ত সুরে বলল,
‘মৃত্যুদণ্ড।’
তনুকা চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটু রয়েসয়ে প্রশ্ন করে,
‘আপনার শত্রু যে আপনার কাছের মানুষেরাই, সেটা কি আপনি জানেন?’
মেহতাব তার দিকে তাকায়। তনুকার চোখ মুখ বিষন্ন থমথমে। মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। জবাব দেয়,
‘জানি।’
তনুকা বিচলিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘চিনেন তাদের?’
‘হয়তো চিনি।’
তনুকার অস্থিরতার মাত্রা বাড়ে। বলে উঠে,
‘তবে তাদের ধরে শাস্তি দিচ্ছেন না কেন?’
‘ঠিক সময়ের অপেক্ষা করছি।’
‘তার আগেই ওরা যদি আপনার কোনো ক্ষতি করে বসে?’
মেহতাব প্রসন্ন হেসে জবাব দেয়,
‘তুমি আছো না, আমাকে বাঁচানোর জন্য।’
‘যদি আমিও না থাকি।’
‘থাকবে তুমি, অবশ্যই থাকবে। জোর করে রেখে দিব।’
তনুকা আর জবাব দেয় না। দুটানা মন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘর ছাড়ে। রেনুর ঘরে যায়। রেনুর সাথে একটু গল্প করলে মনটা ভালো হবে হয়তো।
________
‘ভাইজান, আমার মনে হয় বাবার মৃত্যুটা নিয়ে তদন্তের প্রয়োজন আছে।’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
‘কেন?’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রাদাভ জানাল,
‘আমার এই মৃত্যুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তুমি অন্তত একটা পোস্টমর্ডেম করাতে পারতে।’
‘চেয়েছিলাম, আম্মা রাজি হননি।’
রাদাভ গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো। মেহতাব প্রশ্ন করল,
‘তোর হঠাৎ বাবার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে কেন?’
‘না, এমনিতেই মনে হলো আরকি। আমাদের তো আবার শত্রুর অভাব নেই, তাই।’
মেহতাব ফিচেল স্বরে বলল,
‘তা ঠিক। ঘরের শত্রু বিভীষণ সব।’
রাদাভ কপাল কুঁচকে তাকাতেই মেহতাব হেসে বলল,
‘বুঝিসনি? ছোট কাকার কথা বলছিলাম।’
রাদাভও হাসার চেষ্টা করল জবাব শুনে।
‘শুনলাম তোমার কিছু কাছের লোক গুম হয়ে গিয়েছে? কথাটা সত্যি নাকি?’
‘গুম না ঠিক। কেউ মে’রে ফেলেছে তাদের, তাও আবার খুব জঘন্য ভাবে।’
‘কে সে? ছোট কাকা?’
‘না না, ছোট কাকা এত পাকা খেলোয়াড় না। এই কাজ অন্য কেউ করেছে।’
রাদাভ চিন্তায় পড়ল। ছোট কাকা ব্যতিত অন্য কেউ আবার কে? এমন “অন্য কেউ” থাকা মানে তো তার জন্য বিপদ। তাকে চিন্তিত দেখে মেহতাব বলল,
‘আরে চিন্তা করিস না, পুলিশের তদন্ত চলছে; অপরাধীকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে।’
তাও চিন্তা কমল না রাদাভের। চায়ের কাপে পরপর চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ভাইজান, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’
‘ইশফাককে নিয়ে যা সাথে।’
‘ঠিক আছে।’
রাদাভ বেরিয়ে যেতেই আয়েশ করে বসল মেহতাব। টিভিটা চালিয়ে দিয়ে মনোযোগ দিল তার চা পানে।
________
রেনুর ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায় তনুকা। সবাই সন্ধ্যায় চা খেলেও সে খায়নি। এখন খেতে ইচ্ছে করছে। তাই চুলাতে পানি বসায়। দাঁড়িয়ে থাকে পানি ফোটার অপেক্ষায়। হঠাৎ তখন চোখ যায় বাইরের দিকে। যেখানে তাদের বিশাল বাগান। বাগানের সম্মুখে এক ছায়ামূর্তি দেখে সে, যে কীনা উবু হয়ে বসে মাটি হাতড়ে কিছু একটা করছে। বাইরের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির কাজটা স্পষ্ট নয় তনুকার নিকট। সে সরু চোখে তাকায়। চেনার চেষ্টা করে তাকে। কিন্তু, পারে না। কিছুক্ষণ বাদেই ছায়ামূর্তিটা উঠে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক চেয়ে সোজা চলে যায় সামনের দিকে। তনুকা বুঝতেই পারে না, কী ঘটে গেল। সে দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, বাইরে কেউ নেই। সবার যার যার ঘরে। সদর দরজা বন্ধ। মেহতাব আর রাদাভও নিজেদের কক্ষে। তবে, বাইরে কে ছিল?
চলবে…..
ছবি:রত্নাবু❤️