বেসামাল_প্রেম #জান্নাতুল_নাঈমা #পর্ব_৪৯

0
199

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৯
.
সামনে সপ্তাহে রিদওয়ান শেখ দেশে আসবেন। এই নিয়ে রুদ্রর মনটা বেশ ফুরফুরে। বাড়ি ফিরল প্রফুল্লচিত্তে। সোহান, রোশান ডিনার করছে তখন। রুদ্রকে ফিরতে দেখে ছোটো কাকি বেরিয়ে এলেন। নিজের ঘর থেকে দাদিন বেরোতে বেরোতে বললেন,

-” রুদ্র আসছস? ”

রুদ্র বলল,

-” আসলাম মাত্র। খাওয়া হয়েছে সবার? ”

ছোটো কাকি বললেন,

-” মাত্রই সোহান, রোশানকে খেতে দিলাম। তোমার বড়ো কাকি সাদমানকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি গেছে। মা খেয়ে নিছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো ওদের সঙ্গে বসে পড়ো। ”

হাতে থাকা ফাস্টফুডের ব্যাগ ছোটো কাকির দিকে এগিয়ে দিল রুদ্র। বলল,

-” হৈমী খেয়েছে? ”

-” না তার নাকি খিদে নেই৷ ডাকাডাকি করে ফিরে আসছি। ”

কাকির উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকাল রুদ্র। বলল,

-” সোহান, রোশানকে এর থেকে ভাগাভাগি করে দিয়ে হৈমীর জন্য রেখে দেবেন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”

কথাটা বলেই দাদিনকে জিজ্ঞেস করল,

-” মেজ ছেলের খবর শুনেছ? ”

দাদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে মাথা দুলালো। রুদ্র বাঁকা হেসে দাদিনের গাল টিপে দিয়ে বলল,

-” খুশি তো আঁটছে না মুখে। ”

দাদিন বলল,

-” হইছে যা তাড়াতাড়ি হাত,মুখ ধুয়ে আয়। বউটারে সাথে আনিস। তোর সাথে খাব দেখেই মনে হয় অপেক্ষা করতেছে। ”

মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেল রুদ্র। রিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনিং রুমে ফিরে গেল। বিরবির করে বলল,

-” কী যে আছে কপালে! ”

ভীতিগ্রস্ত হয়ে শুয়ে ছিল হৈমী। রুদ্র এসে লাইট জ্বালাতেই আঁতকে ওঠল। টের পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল রুদ্র। অভয় দিয়ে বলল,

-” আমি। ”

সহসা ওঠে বসল হৈমী। প্রচণ্ড জড়তা নিয়ে ওড়না ঠিক করতে শুরু করল। রুদ্র ধীরপায়ে বিছানার একপাশে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। মৃদু হেসে বলল,

-” শাওয়ার নিব তোয়ালে, টিশার্ট, ট্রাউজার বের করে দাও। ”

টুঁশব্দ করল না হৈমী। নিঃশব্দে ওঠে গেল। ভীষণ রকম অবাক হলো রুদ্র। আন্দাজ করল মন খারাপ কিনা। তাই বলল,

-” মন খারাপ? ”

রুদ্রর চাওয়া অনুযায়ী সব বের করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল হৈমী। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। রুদ্র পকেট থেকে মোবাইল, ওয়ালেট বের করে বিছানায় রাখল। হ্যান্ড ওয়াচ খুলতে খুলতে বলল,

-” আমার কিছু করার নেই হৈমী। তোমাকে এক রাতের জন্যও ছাড়তে পারব না। ”

নড়েচড়ে ঢোক গিলল হৈমী। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণে চেষ্টা করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-” নিন। ”

এগিয়ে এলো রুদ্র। প্রগাঢ় চোখে তাকিয়ে ঠোঁট এগিয়ে কপাল স্পর্শ করল। হৈমীর দেহ কেঁপে ওঠল। রুদ্রর কেন জানি মনে হলো এই কম্পন তীব্র ভয়ের। কিন্তু ভয়ের কিছুই তো ঘটেনি। তাহলে তার কেন মনে হচ্ছে হৈমী তীব্র ভয়ে জর্জরিত হয়ে আছে? হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে সহসা হৈমীর হাতে থাকা জিনিসগুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল হৈমী। থরথর করে কাঁপতে থাকল সে। কপাল বেয়ে স্বেদজল নিঃসৃত হলো। বুকটা হাপরের ন্যায় ওঠানামা করছে অবিরত। কী হবে? কী করবে সে?

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে রুদ্র তার সঙ্গে নিচে যেতে বলল। হৈমী যেতে রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে চাপা ধমক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। কিন্তু খেতে বসার পর খাবারগুলো গলা দিয়ে নামল না। ছোটো কাকি সব গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল। তার প্রিয় সিরিয়াল শুরু হয়ে গেছে৷ আপাতত টিভির সামনে বসা ছাড়া তাকে কোথাও দেখা যাবে না। আজকের খাবারের মেনুতে ভাজাপোড়াই বেশি। আলু ভাজা নাড়াচাড়া করছিল হৈমী। রুদ্র খাওয়ার ফাঁকে খেয়াল করে ভাজা মাছের পেটিটা তুলে দিল হৈমীর প্লেটে। হৈমী বাঁধা দিতে নিলে চোখ গরম করল সে। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,

-” খাওয়া নিয়ে এই বাহানা কবে কমবে? এই যে দিলাম পুরোটা শেষ করবে। নয়তো আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। ”

হৈমীর নীরবতা এমনিতেই ভালো ঠেকছিল না। এরওপর খাবার খেতে এতটা অনিহা। রুদ্রর রাগ বেড়ে গেল। সে নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হৈমীর দিকে। হৈমী অনেক চেষ্টা করে দু’বার মুখে দিল খাবার। মাছ দিয়ে মুখের সামনে নিতেই আঁশটে গন্ধে পেটের ভিতর মুচড়ে ওঠল। ঠিক এই গন্ধটাই বাড়ি ফেরার পর পেয়েছিল। যার কারণে ওভাবে বমি করল। এখনও তেমনটা হবে নাকি? ভয়ে শিউরে ওঠল হৈমী। আতঙ্কিত মুখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ইশারা করল খেতে। সে জোর পূর্বক মুখে দিয়ে সহসা মুখ চেপে ধরে ওঠে পড়ল। বেসিনের সামনে গিয়ে গলগল করে করে দিল বমি। রুদ্র চমকে ওঠল। ত্বরিত এসে ধরল হৈমীকে। বলল,

-” এভাবে খেলে বমি তো হবেই। খাবারটা কি স্বাচ্ছন্দ্যে খাওয়া যায় না? তোমাকে কি পঁচা আবর্জনা খাওয়াচ্ছি। ”

হৈমীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। রুদ্র বিরক্ত হয়ে চোখ, মুখ কুঁচকে বলল,

-” ওকে খেতে হবে না। বাইরের খাবারে তুমি বেশি কমফোর্ট তো? তাহলে সেগুলোই খাও। ”

বলতে বলতে ছোটো কাকিকে ডাকল। বলল হৈমীকে তার আনা ফাস্টফুড গুলো দিতে। এরপর হৈমীকে বলল চোখেমুখে পানি দিয়ে রুমে যেতে। ছোটো কাকি যাওয়ার পথে হৈমীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল। রুদ্রর নজর তাদের দিকেই ছিল। তাই খাবারগুলো দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” সুযোগ পেলে আমাকে কল বা ম্যাসেজ করো। রুদ্র বাড়ি থাকাকালীন আলাদা কথা বলা মানে বিপদ বাড়ানো। ”
_______________
গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে হৈমী। রুদ্র লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিল। পাশে এসে শুয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরল হৈমীকে৷ ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ভরাট স্বরে বলল,

-” যখন বললাম চলে আসতে তখন তো এতটা নারাজ বুঝিনি। বুঝলে জোর করতাম না। কথা বলো আমার সঙ্গে হৈমী। ”

বুকটা ধক করে ওঠল হৈমীর৷ শরীরটা পাথরের মতো শক্ত করে রইল। রুদ্র অনুভব করল নিগূঢ় ভাবে। বলল,

-” কাল রেখে আসব। মায়ের কাছে একদিন থাকার অনুমতি দিলাম। এবার নিশ্চয়ই মুখে কথা ফুটবে? ”

সহসা হৈমী বলল,

-” সত্যি? ”

কিঞ্চিৎ রাগ হলো রুদ্রর। চট করে নরম ঘাড়টায় আলতো করে কামড় বসাল। মুচড়ে ওঠল হৈমী। রুদ্র তাকে আরো নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল,

-” এবার খুব খুশি তাই না? ”

মাথা ঝাঁকাল হৈমী। মনে মনে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল। রুদ্রর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,

-” আপনি রাগ করবেন না তো? ”

-” একদিন অনুমতি দিয়েছি। সময় অনুযায়ী চলে এলেই রাগ করব না। ”

-” আচ্ছা। ”

রুদ্রর চুলে হাত বুলাল হৈমী। রুদ্র চোখ বুজে ফেলল। সে টের পেয়ে যেভাবে মাথা টিপলে রুদ্রর ঘুম হবে সেভাবেই টিপতে লাগল। সত্যিই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর হৈমী টের পেয়ে আলগোছে ওঠে মোবাইল খুঁজতে লাগল। খুঁজে পাওয়ার পর বাথরুমে ঢুকে কল করল ছোটো কাকিকে। সকাল সকাল হৈমীকে নিয়ে খান মঞ্জিলে চলে এলো রুদ্র। ঘন্টা দুয়েক দেরি করে পুনরায় ফিরে এলো নিজ নিবাসে। নিজের বাড়ি এসে ভয়, বিপদ অনেকটাই কেটে গেল হৈমীর৷ হ্যান্ড পার্স থেকে ত্বরিত ছোটো কাকির দেওয়া কাগজটা বের করল৷ যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে কোন ট্যাবলেট খেলে গর্ভপাত হয়। সব নিয়মকানুনও লিখে দিয়েছেন কাকি। এবার শুধু ওষুধ গুলো আনার অপেক্ষা। তীব্র ভয় বুকে চেপে দুপুরে টিশার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, একঘন্টা সময় কাটিয়ে ফিরে আসবে। এই বলে বেরিয়ে গেল হৈমী। ফার্মেসিতে গিয়ে ছোটো কাকিকে কল করল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

-” আমার খুব ভয় করছে কাকি। ”

-” আরে মেয়ে এত ভয় পাও কেন? সামান্য একটা বিষয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? শোনো রোশান হওয়ার সাত মাসের মাথায় এক্সিডেন্টলি আমিও গর্ভবতী হয়েছিলাম। একদিকে পাজি সোহান অপরদিকে বাচ্চা রোশান। এদের সামলেই আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। ষাট কেজি থেকে ওজন নামল ছয়চল্লিশ কেজিতে। আরেকটা ছানা এলে নির্ঘাত আমার জান বেরোবে। এই ভয়েই তোমার কাকা শশুর ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে এই ওষুধ গুলো এনে দিয়েছিল। মাত্র ঊনত্রিশ দিনের ভ্রুণ ছিল। তেমন কষ্টই হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে আমরা প্রতি মাসে ছয়, সাতদিন যা কষ্ট করি তাই। অতো ভয় পেলে এসব করার দরকার কি ফিরে যাও। ”

সাহস পেল হৈমী বলল,

-” না না ভয় পাচ্ছি না। ”

-” তাহলে ফার্মেসিতে থাকা লোকটাকে ফোন দাও আমি বলে দিচ্ছি ওষুধের নাম৷ তুমি কাগজটা উনাকে একবার দেখাও আর আমার সাথে ফোন ধরিয়ে দাও৷ কাজ শেষ টাকা নিয়ে গেছ তো? ”

-” হ্যাঁ হ্যাঁ। ”
.
.
ফেরার পথে অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপল হৈমীর। বাড়ি ফিরে রুমের দরজা আঁটকে ওষুধ হাতে বসে রইল দীর্ঘক্ষণ। মাতৃত্বের কোনো অনুভূতিই তার মধ্যে কাজ করছে না। অথচ এই মেয়েটাই ছোটো থেকে সবাইকে বলে বেরাতো,

-” আমার মা হওয়ার খুব শখ। ”

একদিন তো রুদ্রকেও বলেছিল,

-” জানেন আমার মধ্যে মা মা একটা ভাব আছে? মা হওয়ার প্রতি অনেক ঝোঁক আমার। ইস, আমি যে কবে মা হবো। শুনুন, আমি কিন্তু আমাদের বাচ্চাকে খুব খুব আদর করব। অনেক বেশি ভালোবাসবো। আর শুনুন আমার আর পড়াশোনার দরকার নেই। যতটুকু জানি তাতে বাচ্চাদের সেভেন, এইট পর্যন্ত পড়াতে পারব। সংসার সামলে রোজ বাচ্চাদের নিয়ে স্কুল দৌড়ানোর খুব স্বপ্ন আমার। ইস, কবে যে পূরণ হবে! ”

সেই অনুভূতি কোথায় হারিয়ে গেল? আজকাল বুঝি
অনুভূতিরাও রূপ বদলায়? বুকটা ভাঙা নদীর মতো হয়ে গেল যেন। বিদঘুটে কান্নারা দলা পাকিয়ে এলো। সিদ্ধান্ত নিল রাতে খেয়েদেয়ে এটা খাবে। তাই সবকিছু গুছিয়ে রাখল। যদি বেশি রক্তপাত হয়? সে কথা মাথায় রেখেও ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে। হঠাৎ হৈমী অনুভব করল সে অনেক বেশি সাহসী হয়ে গেছে। ভয় শুধু পাচ্ছে রুদ্র জেনে যাবার। এক রুদ্র ছাড়া আর কিছুতেই ভয় হচ্ছে না। রুদ্রর ভয়ে এতটাই তটস্থ যে কতবড়ো পাপ করতে যাচ্ছে এটুকুও হুঁশ নেই।
________________
সোহান, রোশান দুই ভাই দাবা খেলছে। তাদের পাশেই বসে টিভি দেখছিল রিনা। হঠাৎ হৈমীর কথা মনে পড়ল তার। তাই চটপট ফোনটা নিয়ে ম্যাসেজ দিল মেয়েটাকে। সে মুহুর্তেই ভিতর ঘর থেকে ডাক এলো দাদিনের,

-” সোহানের মা আছ নাকি ওখানে। এইদিক আসো তো। আমার ছোটো বোনের নাম্বারটা খুঁজে পাইনা খুঁজে দিয়ে যাও। ”

রিনা তৎক্ষনাৎ ওঠে গেল। এরপরই বাড়ি এলো রুদ্র। আবিরের সঙ্গে অনেকদিন পর আড্ডা দিতে গিয়েছিল সে। চিন্তা ছিল বাইরে ডিনার করবে আজ। বন্ধুর সাথে কিন্তু হলো না। এর কারণ ছোটো কাকি। রুদ্র বরাবরের সন্দেহবাতিক মানুষ। হৈমীর সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক। মোটামুটি সুখী দম্পতি বলা যায়। ভালোবাসারও কমতি নেই। কিন্তু ঐ যে কালো অতীত! সেই অতীতটার জন্যই এই সুখের সম্পর্কে ফাঁক রেখেছে সে। নিজের স্ত্রীকে সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে সে। সেটা হোক সকলের সম্মুখে বা অগোচরে। বোকা হৈমী হয়তো রুদ্রকে এখনো পুরোপুরি চিনতে পারেনি। হৈমীর পার্সনাল ফোন যেখানে ইউজ করা নিষেধ করেছিল রুদ্র। সেখানে এ বাড়িতে আসার পর হৈমী ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সমস্তই স্বাচ্ছন্দ্যে ইউজ করছে। কারণ হৈমীর ফোন সহ সমস্ত মাধ্যমই রুদ্রর কন্ট্রোলে! এই সত্যিটা হৈমী জানে না। রুদ্র ব্যতীত কেউ জানে না। আবিরের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে হঠাৎই রুদ্র নিজের ফোনে থাকা বিশেষ অ্যাপে ঢুকে। কারণ আজ হৈমী বাবার বাড়িতে আছে। তাকে ছাড়া। এই সুযোগে সে কার সঙ্গে কথা বলছে এ বিষয়ে সন্দিহান হয় রুদ্র। সে সন্দেহ থেকেই বিশেষ অ্যাপটিতে ঢোকার পর দেখে একটি নাম্বারে আজ হৈমী বেশ কয়েকবার কল করেছে। কথা বলেছে বেশ অনেক মিনিট। এরপর আচমকাই মনে হয় নাম্বারটা তারও পরিচিত। কিন্তু সূচনা বা মাহেরের নাম্বার নয়। দাদিনেরও নয়। ভাবতে ভাবতে সহসা খেয়াল হয় এটা ছোটো কাকির নাম্বার! রুদ্রর সন্দিহান মনে সন্দেহের পাহাড় তৈরি হয় নিমিষেই। ছোটো কাকি হৈমীকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। হৈমীও খুব একটা পছন্দ করে না। আড়ালে আবডালে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছে। তাহলে হঠাৎ এত ফোনকলের মানে কী? ছোটো কাকি বেশ চতুর মহিলা। আর হৈমী বুদ্ধিহীন, মাথামোটা। এই দুজনের এত ভাবে নিশ্চয়ই স্বার্থ আছে ছোটো কাকির? নিজের বউ সম্পর্কে তেমন কিছু ভাবতে পারল না। কারণ হৈমীকে শিরায় শিরায় চেনা শেষ তার। কিন্তু মনের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। সেই অনুভূতি ধীরেধীরে বিষাক্ততায় রূপ নিতেই আড্ডা ভঙ্গ করে বাড়ি ফিরল সে। উদ্দেশ্য ছোটো কাকিকে জিজ্ঞেস করবে, হৈমী কেন তাকে এতবার ফোন করেছে? কারণ কী? যদি সামান্য কারণও থাকে তবুও লজ্জা পাবে না সে। তবুও প্রশ্ন করে উত্তর জানতে দ্বিধা করবে না। আর পাঁচ টা ছেলের মতো অতো ভদ্র, সভ্য, লাজুক ছেলে সে নয়।

সোহান রোশানকে ছোটো কাকির কথা জিজ্ঞেস করতে করতে সোফায় এসে বসল রুদ্র। সোহান বলল,

-” আম্মু দাদিনের ঘরে। ”

রুদ্র ভুলবশত রিনার ফোনের ওপর বশে পড়েছে। তাই কিঞ্চিৎ সরে গিয়ে ফোনটা বের করে পাশে রাখতে নিয়ে সহসা নজর পড়ল স্ক্রিনে। হৈমীর নাম্বার থেকে একটি দীর্ঘ ম্যাসেজ এসেছে। সন্দেহের মাত্রা তীব্র হলো রুদ্রর। ভ্রু কুঁচকে উদ্বিগ্ন মনে পুরো ম্যাসেজটা রয়েসয়ে পড়ল সে। মুহুর্তেই বুক কেঁপে ওঠল তার। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়েও নিভে গেল। চোয়ালদ্বয় হলো ক্রমশ কঠিন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। যে ম্যাসেজটা সে পড়ল এটা যদি সত্যি হয়। তাহলে এ মুহুর্তে ছোটো কাকির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে যাওয়াটাও ভুল হবে। শরীটা অবশ হয়ে এলো রুদ্রর। একবার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিল তার। সেটা স্মরণ করে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করতে করতে গাড়ির চাবি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ল। পনেরো, বিশ মিনিটের পথ মাত্র সাত মিনিটে শেষ করল সে। কলিং বেল না বাজিয়ে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দরজায় আঘাত করল পরপর। মাহের এসে দরজা খুলে দিতেই রুদ্র কোনোদিক না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মাহের রুদ্রর এমন আগমনে হকচকিয়ে গেল। রুদ্র বিচলিত হয়ে বলল,

-” হৈমী হৈমী কোথায়? ”

-” কী হয়েছে রুদ্র? হৈমী খাবার ঘরে খাচ্ছে। তুমি এমন করছ কেন তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? ”

উত্তেজনা কিঞ্চিৎ কমল রুদ্রর। কারণ হৈমী স্পষ্ট লিখেছে রাতের খাবার খেয়ে তারপর গর্ভপাতের জন্য ওষুধ খাবে! তার মানে হৈমীর খাওয়া শেষ হয়নি। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল সে। সহসা নিজেকে শক্ত খোলসে ঢেকে নিয়ে বলল,

-” আই এম ওকে। আজ এখানেই থাকব অসুবিধা নেই তো? ”

ভিতর থেকে হামিদা এলেন। রুদ্র কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,

-” ছিঃ ছিঃ বাবা কী অসুবিধা হবে। আমিত খুশিই হয়েছি তুমি আসাতে। এসো ভেতরে এসো ওদের খেতে দিয়েছি তুমিও বসবে এসো। ”

নাটকীয় ভাবে হাসল রুদ্র। বাধ্য ছেলের মতো শান্ত মাথায় প্রবেশ করল ডাইনিং রুমে। রুদ্রকে দেখে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল হৈমীর। বুকের ভিতর ধড়ফড়িয়ে ওঠল নিমিষেই। তার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসি দিল রুদ্র। সেই হাসিতে শরীর ঘেমে ওঠল হৈমীর। রুদ্র নিঃশব্দে এসে বসল তার পাশে। গ্লাস ভর্তি পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,

-” পানি খাও। ”

হৈমীর ভয়ের তাড়নায় পুরো পানি শেষ করল। সূচনা, হামিদা যত্ন নিয়ে খাওয়াল রুদ্র। পেটপুরে খেয়ে হৈমীর আগেই বেডরুমে ঢুকে গেল রুদ্র। রুদ্র রুমে ঢোকার পর ঝড়েরবেগে রুমে এলো হৈমী। বালিশের নিচে রাখা মেডিসিন গুলো রুদ্রর আড়াল করতে বিছানার তলায় রাখল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুদ্র বলল,

-” আমার উপস্থিতির জন্য খুব অসুবিধা হয়ে গেল তাই না? ”

চমকে ফিরে তাকাল হৈমী। রুদ্রর কণ্ঠস্বর এতটাই ভীতি সৃষ্টি করল মনে যে ঢোক গিলল ঘনঘন। জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে আমতাআমতা করে বলল,

-” কইইই আমি তো তো খুশিই হয়েছি। ”

তাচ্ছিল্য হেসে ভ্রু বাঁকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো রুদ্র। ঢোক গিলে এক পা পিছাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল হৈমী। রুদ্র যখন তার খুব কাছাকাছি চলে এলো হৈমীর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। কারণ রুদ্রর ভয়ার্ত রক্তিম দু’টো চোখের ধকল সে সহ্য করতে পারল না। থরথর করে কাঁপতে লাগল, তিরতির করে ঘামতে লাগল শরীরটা। রুদ্র ঘাড় ডান দিক বাম দিক বাঁকিয়ে আচমকা হৈমীর দিকে ঝুঁকল। হৈমী কেঁদে দিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের সাথে ঠেকে গেল। হাঁটু ভর করে রুদ্রও এগিয়ে এলো৷ অতি নিকটে এসে ফাঁপা স্বরে বলল,

-” বাচ্চাটা কার হৈমী? ”

চোখ বড়ো বড়ো করে শ্বাস আঁটকে শক্ত মূর্তির মতো বসে রইল হৈমী৷ রুদ্র পুনরায় জিজ্ঞেস করল,

-” ও বৈধ রাইট? ”

হৈমী নিরুত্তর। দেহ কাঁপানো ছাড়া যেন তার কিছুই করার নেই।

-” ও আমার তো? ”

হৈমীর চোখ উপচে অশ্রুধারা। বুক ওঠানামা করছে হাপরের মতো। তীব্র ভয়ে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর বীভৎস মুখটার দিকে। রুদ্র আবারো বলল,

-” আমি ওকে চাইনি ঠিক। ও এসেছে নিশ্চয়ই তোমার ভুলে? এর মানে কী এই তুমি ওকে মেরে ফেলবে! ”

অবিশ্বাস, ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুদ্র। হৈমী কিছু বলতে উদ্যত হতেই রুদ্র সহসা ওর শ্বাসনালী চেপে ধরল৷ শক্ত হাতে। হাত, পা ছুঁড়াছুড়ি করল হৈমী৷ রুদ্র ভয়াবহ এক চিৎকার করে বলল,

-” অ্যাঁই বল ও কার? আমার তো? কোন সাহসে, ঠিক কোন সাহসে তুই এতবড়ো সিদ্ধান্ত নিলি বল। ”

রুদ্রর করা চিৎকার শুনে ছুটে এলো হামিদা, সূচনা, মাহের৷ দু’জনকে এরূপ অবস্থায় দেখে মাহের নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে রুদ্রর পিঠ জাপটে ধরল। সূচনা গিয়ে ধরল হৈমীকে। রুদ্র হৈমীর গলা ছাড়তেই সে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিল। কয়েক পল পর সূচনায় গায়ে বমি করেও দিল৷ হামিদা ডুকরে ওঠল অবস্থা দেখে। মাহের তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল। রুদ্রর গায় হাত তুলতে গেলে রুদ্র তার হাত আঁটকে শান্ত গলায় বলল,

-” আজ যদি সূচনা আপনার সন্তান মেরে ফেলতে চাইত আপনি কী করতেন মাহের? ”

রুদ্রর এহেন প্রশ্নে বুক কেঁপে ওঠল মাহেরের। যেখানে তারা একটি সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। সূচনা পাগলপ্রায়। সেখানে সন্তান এলে মেরে ফেলার প্রশ্ন আসবে কেন? মাহের কিছু বলতে পারল না। রুদ্র চিৎকার করে বলল,

-” আপনার বোন প্রেগন্যান্ট মাহের। হৈমী প্রেগন্যান্ট! আর আমি জানি না। জানি না আমি। ও আমাকে না জানিয়ে নিজ তাগদে এই ওষুধ গুলো নিয়ে এসেছে। ”

নিচু হয়ে বিছানার নিচ থেকে ওষুধ গুলো বের করল রুদ্র। হামিদার হাতে সেসব ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-” আপনি তো মা। জানেন আপনার মেয়ে আমার অংশকে মে/রে ফেলার জন্য এসব নিয়ে এসেছে? ”

রুদ্রর দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল হামিদা। রুদ্রর দেওয়া ওষুধ গুলো হাতে নিয়ে হৈমীর দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। মাহের অধৈর্য্য হয়ে হৈমীকে বলল,

-” রুদ্র এসব কী বলছে হৈমী? তুমি সত্যি টা বলো। ”

রুদ্রর ক্রোধ যেন গাঢ় হলো। সে চিৎকার করে বলল,

-” আমি ওকে রাখব না। আমি ওর সঙ্গে সংসার করব না। ও একটা খু/নি, বিশ্বাসঘাতক একটা। ”

আঁতকে ওঠল হৈমী। সূচনার বুকে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদতে লাগল। হামিদা ছুটে এসে ধরল ওকে। মুখ ঝাঁকিয়ে বলল,

-” রুদ্র যা বলছে তা কি সত্যি হৈমী? ”

হৈমী চোখ বুঁজে মাথা নাড়াল। সূচনা আঁতকে ওঠল। মাহেরের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো৷ হামিদা দ্বিধায় পড়ে গেল রুদ্রকে কী বলবে? হৈমীকেই বা কী বলা উচিৎ। এমন অবস্থায় মাহের রুদ্রকে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলে হৈমীর জন্য পানি নিয়ে এলো। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। রুদ্র গিয়ে বসল বাইরের ঘরের সোফায়। সাফ জানিয়ে দিল হৈমীকে সে রাখবে না। সূচনা এই নিয়ে কিছু বলতে এলে বলল,

-” আজ থেকে ঠিক আটমাস পর আমার সন্তান এ পৃথিবীতে আসার পর ওকে ডিভোর্স দিব আমি। বাচ্চাটা দুনিয়াতে আসুক এরপর ওকে মুক্তি দিয়ে দিব। ”

সূচনার কোনো বোঝই কাজে দিল না। ওদিকে কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হৈমী। তার এক কথা রুদ্র শুরু থেকেই চায়নি তাদের সন্তান হোক। কীভাবে কী হয়েছে টের পায়নি সে। তাই ভয়ে, রুদ্রকে হারানোর ভয়ে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে সে। এমন কথা রুদ্রর কানে এলে সে শুধু একটা কথাই বলল,

-” আমি বাবা হতে চাইনি বলে সন্তান এলে হৈমী ওকে মেরে ফেলবে এটা মেনে নিব? ও একটাবার আমাকে জানাতো। একটাবার জাস্ট একটাবার। আমি খারাপ হতে পারি তাই বলে নিজের অংশকে মেরে ফেলার মতো পাপ করতে পারি না। যে পাপ করার চেষ্টা ও করেছে। ও একটা খু/নি। ”

ধীরেধীরে রাত গভীর হলো। হামিদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল হৈমী। সহসা বসার ঘর থেকে হৈমীর ঘরে গেল রুদ্র। হামিদাকে উদ্দেশ্য করে ঠাণ্ডা গলায় বলল,

-” আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি। আপনার মেয়েকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন। উহুম কোনো না নয়। আপনার মেয়েকে আমার প্রয়োজন নেই। আমি আমার সন্তানের জন্য ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ সঙ্গে সূচনাকেও পাঠাবেন। নয়তো আপনার মেয়েকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না৷ ও যতবার আমার সামনে আসবে ততবার মনে হবে আমার সন্তানের খু/নি আমার সামনে রয়েছে। এরপর কন্ট্রোললেস হয়ে আঘাত করে ফেলতে পারি। তাই সূচনাকে সঙ্গে পাঠাবেন। ”

নিজের ভয়াবহ বক্তব্য শেষ করে দরজার বাইরে এলো রুদ্র। মাহের লজ্জা, অপমানে মাথা নিচু করে আছে। রুদ্র তার দিকে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

-” বোনের ভালোর জন্য আটমাস সেক্রিফাইস করুন মাহের। সূচনা ততদিন থাকবে যতদিন আমার সন্তান আমার কাছে না আসবে। ঠিক সময় বোন, বউ দুটোই ফেরত পাবেন। ”

মাহের করুণ মুখে বলল,

-” রুদ্র মাথা ঠাণ্ডা করুন। প্লিজ হৈমী… ”

-” ব্যস মাহের। আর কোনো কথা নয়। ওর সব বাচ্চামো মেনে নিলেও এটা আমি মানতে পারলাম না। টানটা কোথায় লেগেছে জানেন? রক্তে! ”

আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না রুদ্র। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। মাহের সূচনার দিকে দুঃশ্চিন্তা ভরে তাকাল। করুণ স্বরে বলল,

-” এ কী হয়ে গেল সূচনা। হৈমী কী করে ফেলল এটা!”

চলবে…

সবার সর্বোচ্চ রেসপন্স চাই। আর হ্যাঁ পাঠকবর্গ, আমার দ্বিতীয় ই-বুক না পড়লে শিঘ্রই বইটই থেকে পড়ে নিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here