প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৯।

0
147

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।

সময়ের স্রোতে কান্নার শব্দ তীব্র হয়। তনুকা আর রেনু ছুটে যায়, সেই শব্দের কারণ উদঘাটন করতে। শব্দ আসছে চারতলা থেকে। আর চারতলায় একটাই কামরা, মোহন লাল মজুমদারের।

তনুকা আর রেনু ছুটে গেল সেই কক্ষে। গিয়ে দেখল, আম্বিরা বেগম মোহন লাল মজুমদারের বিছানার পাশে বসে কাঁদছেন। সময় নিল না বেশি। ততক্ষণাৎ অযাচিত এক ভয়ে রেনুর বুকে মোচড় দিল। সে এগিয়ে গেল ত্রস্ত পায়ে। মায়ের শিউরে হাঁটু ভেঙে বসল। তনুকা দরজার কাছে ঠাই দাঁড়ান। শরীর অসাড় তার। হাত পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। রেনু ভয়ে ভয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করল,

‘আম্মা, কাঁদছো কেন?’

আম্বিরা বেগম কান্নার শব্দ বাড়িয়ে দিলেন। মেয়ের বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললেন,

‘সব শেষ রে মা, আমার সব শেষ। আমার স্বামী যে আর আমাকে দেখবেন না, মা। আমার স্বামী যে আমাকে ছেড়ে আজীবনের জন্য চলে গিয়েছেন। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব, কার আশায় বাঁচব? ও আল্লাহ…’

তিনি বিলাপ ছেড়ে কাঁদছেন। রেনুর গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সে একবার তার বাবার মুখের পানে চাইল। সবসময়ের মতো ঘুমন্ত’ই মনে হলো তাঁকে। কোনোদিক দিয়ে তো মৃ’ত মনে হচ্ছে না। মায়ের কি তবে কোথাও ভুল হচ্ছে? সে মা’কে ছেড়ে হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়ায়। বিছানার কিনারে হাত রেখে নিষ্পলক চেয়ে থাকে বাবার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে একবার সাহস করে বাবার গাল স্পর্শ করে। অত্যধিক ঠান্ডায় বক্ষঃস্থল কম্পিত হয় তার। বিশ্বাস হয়, সত্যিই বাবা মৃত। ধপ করে জমিনে বসে। স্তব্ধ হয়, কান্না আসে না। অথচ বুক ফেটে চৌচির যেন। তনুকা এখনও বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে বাড়ির সবাই দোরের মুখে উপস্থিত। মেহতাব বিচলিত পায়ে ছুটে এসে তনুকার পাশে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি ঠাহর করতে না পেরে তনুকাকে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে?’

তনুকা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে শুধুমাত্র “বাবা” শব্দখানা। মেহতাব বাবার দিকে তাকায়। মা আর বোনকে দেখে বাকিটুকু আর বুঝতে বিলম্ব করে না। সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয় কতক্ষণ। বাড়ির বাকি সব সদস্যের কারোর মুখে কোনো রা নেই। তারা বর্তমানে খুশি না বেজার তা বোঝা কষ্টসাধ্য।

মেহতাব এগিয়ে আসে। বাবার শিউরে বসে একবার হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে। হয়তো ভেবেছিল, বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। তবে তাকে আশাহত করে দিয়ে ফলাফল বের হলো, তার আব্বাজান সত্যিই মা’রা গিয়েছেন। এখন এই তিক্ত বিদঘুটে সত্যিটা মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।

রেনু ভাইয়ের দিকে চাইল। চোখ শুকনো, অথচ ভেতর অগ্নি দাবানলে জ্বলে যাচ্ছে। সে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাইজান, ডাক্তার ডাকবে না? ডাক্তার কি আব্বাজানকে বাঁচাতে পারবেন না, ভাইজান? তুমি ডাক্তার ডাকো না একবার, ডাক্তার পারবেন তো।’

মেহতাব চোখ বোজে নিশ্বাস ছাড়ে। এগিয়ে এসে বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,

‘উপর থেকে ডাক এলে, কারোর ক্ষমতা নেই সেই ডাক অগ্রাহ্য করার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তারকে নিয়ে এলেও আজ আর আমাদের আব্বা চোখ মেলে চাইবেন না, রেনু। আব্বা যে আজীবনের জন্য ঘুমিয়েছেন।’

রেনুর বুকের ভেতরে যেন কেমন করে ওঠল। এতদিন অসুস্থ বাবাকে একবার করে দেখে যেত সে; যখনই সে আসত, বাবা কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত। রেনু একাই বাবার সাথে গল্প করত অনেক। বাবা জবাব দিতে না পারলেও শুনতেন বেশ মনোযোগ দিয়ে। আজ থেকেও তো আর সেটাও হবে না। রেনুর মনে হলো বুকের ভেতর ভারী কিছু চেপে বসে আছে। বাবা মৃ’ত, কথাটা ভাবতেই দম আটকে আসছে তার। মায়ের প্রতিটা কান্নার শব্দ সেই কষ্টকে তরান্নিত করছে কেবল।

__________

জমিদার মোহন লাল মজুমদার মা’রা গিয়েছেন, কথাটা বাতাসে ভেসে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণাৎ হাহাকার দেখা দিল সকলের মাঝে। এই মানুষটাকে গ্রামের মানুষরা ভালোবাসত বড্ড। সম্মানও করত বেশ। আজ তাঁর মৃত্যুতে পুরো গ্রামে যেন শোকের ছায়া নেমেছে।

ইতিমধ্যেই জমিদার বাড়িতে জমেছে মানুষের ভিড়। প্রিয় জমিদারকে শেষবারের জন্য একবার দেখতে সবার এত সমাগম। মোহন লাল মজুমদারের লা’শটা বাইরে বিচার মহলে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে আছে প্রহরীরা। গ্রামের পুরুষরা উপচে পড়েছে সেই মহলে। ছোট বড়ো সকলের একমাত্র আগ্রহ এখন জমিদার লা’শকে একবার দেখা।

_______

‘মেহতাব, আমার আপনার সাথে কথা আছে।’

মেহতাব তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিল। বাবার শবদাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এইদিকে ছোট ভাই রাদাভও আজ আসতে পারবে না। সে নিজেও কী করে এসব করবে বুঝতে পারছে না কিছু। তাই দুশ্চিন্তায় জবাব দেয়,

‘আমার এখন সময় নেই, তনু। পরে এসে শুনব।’

তনুকা তাও উদ্বিগ্ন সুরে বলে উঠল,

‘আপনার কি মনে হয় না, বাবার লা’শটাকে একটা ময়নাতদন্তে পাঠানোর দরকার?’

মেহতাব ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘ময়নাতদন্ত? কেন? আব্বার মৃত্যু তো স্বাভাবিক মৃত্যু, তাহলে এখানে ময়নাতদন্তের কথা কোথ থেকে আসছে?’

‘কী করে শিউর হলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু? অস্বাভাবিকও হতে পারে।’

মেহতাব বোধ হয় এখন এসব কথা নিতে পারছে না ঠিক। সে বিরক্ত গলায় বলে,

‘তনু প্লিজ, এমনিতেই মহলের পরিস্থিতি ভালো না। তারউপর তোমার এসব উল্টা পাল্টা কথা পুরো গ্রামে হৈ চৈ ফেলে দিবে, তাই প্লিজ এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দাও। আব্বা অসুস্থ ছিলেন; ডাক্তার প্রথম থেকেই বলছিলেন, সুস্থ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আর ইদানিং তো তুমি নিজেই দেখছিলে, আব্বা দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিলেন। হয়তো, নিজের অসুস্থতার সাথে আর পেরে উঠেননি; ধৈর্য্যহারা হয়ে তাই মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছেন।’

তনুকা নিমিষ চেয়ে শুনল সব। মেহতাবের বিচলিত চোখ মুখ দেখে আর কিছু বলল না সে। মেহতাব বেরিয়ে গেল। তবে তার মনের সন্দেহ ছিটে ফোটাও কমল না। অন্তত এইটুকু সে নিশ্চিত যে, এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু না।

____

একনাগাড়ে অনেক কেঁদে আম্বিরা বেগম এখন ক্লান্ত। বিছানায় হেলান দিয়ে তাই চুপচাপ বসে আছেন। তাঁর পাশেই থমথমে মুখে বসে আছেন তার দুই জা। রেনু একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বোজে আছে। ভেতরে তার কী চলছে, একমাত্র সে’ই জানে।

অন্দরে বাইরে থেকে বেশ কয়জন মহিলা এসেছেন। তনুকা আর ভৃত্যরা মিলে তাদের বসার ব্যবস্থা করেছে। মহিলারা হাজার প্রশ্ন করতে করতে অস্থির। জমিদার বাবু কীভাবে মারা গেলেন, কখন মারা গেলেন…এই সব। কেউ কেউ আবার আফসোস নিয়ে বলছেন, আজই জমিদার ছেলে এত সুন্দর আয়োজন করল, আর আজই ঘটল এই অঘটন; বেচারার ভাগ্যটাই খারাপ! তনুকা শুনল সব, ধৈর্য্য নিয়ে জবাবও দিল সবকিছুর।

রাত এখন একটা। বাইরের কেউ অন্দরে নেই। বিচারমহলও খালি প্রায়। কাছের কয়জন ছাড়া সবাই চলে গিয়েছে। তনুকা নিজ ঘরে। পায়চারিতে ব্যস্ত সে। মাথায় ঘুরছে অনেক কিছু। কালই তার পরিচিত ডাক্তার আসার কথা ছিল, অথচ আজই বাবার মৃত্যু হলো। মেহতাবের কি এতে একবারও খটকা লাগছে না? উনি এতটা নিশ্চিত কী করে? তনুকা হাত কচলাচ্ছে সমানে। কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি খু’নই হয় তবে, বাবার মতো অমন ভালো মানুষকে কে’ই বা খ’ন করবে?

তনুকা ভেবে ভেবে উত্তর মেলায়, ‘হ্যাঁ, কেন করবে না? হয়তো অর্থ, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার লোভে কেউ এসব করেছে?’ তবে কে সে? মেহতাবের অমন ধূর্ত চোখের আঁড়ালে কে এই ভয়ানক কাজটা করেছে? কার এত বড়ো বুকের পাটা যে, সে মেহতাব মজুমদারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার আব্বাজানকে খু’ন করে বসেছে?

মাথা ব্যথা আরম্ভ হয় তনুকার, তাও উত্তর পায় না কিছু। হতাশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। দূর থেকে মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে। এক হাত কোমরে তার। অন্যহাতে ফোন ধরে কার সাথে কথা বলছে যেন। তনুকার তখন হঠাৎই মনে হয়,

‘আচ্ছা, এই বাড়ির কেউই আবার এই খু’নটা করেনি তো?’

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here