প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩২।

0
75

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।

তনুকা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই বসার ঘরে মেহতাবকে পেল। অকস্মাৎ তাকে দেখে ঘাবড়াল সে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিকটে স্থির হলো। মেহতাব চাইল। তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় ছিলে?’

তনুকা ঢোক গিলে। জবাবে সত্য না মিথ্যা বলবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেন। মেহতাব বিমূর্ত। তনুকা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘বাবার ঘরে গিয়েছিলাম।’

‘এত রাতে আব্বার ঘরে কেন?’

তনুকা সাথে সাথেই জবাব দিল,

‘বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই।’

মেহতাব বিশ্বাস করল কি না কে জানে? তার অভিব্যক্তি দেখে তা বোঝা দুষ্কর। তনুকা মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ভাত দিব? খাবেন?’

‘না, শুতে এসো।’

মেহতাব ঘরের দিকে গেল। তনুকা ভয় পাচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে। মেহতাব বুঝে গেলে যে কেলেঙ্কারি হওয়ার আর কিছু বাকি থাকবে না।

________

পরদিন বেশ সকাল সকালই দুই ভাই বিচার মহলে উপস্থিত হয়। আজ বিচার মহল পূর্ণ হয় কানায় কানায়। অর্ধেকের বেশি লোক এসেছে কেবল রাদাভকে দেখতে। রাদাভ তার নিত্য দিনকার বেশ ভূষা পাল্টে ভাইয়ের মতো এক সাদা রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েছে। ভাইয়ের পাশেই দাঁড়িয়েছে গম্ভীর মুখে। মেহতাব গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখে। তাদের বোঝায়, জমিদারের মৃত্যুতে সকলে ব্যথিত হলেও কেউ যেন ভেঙে না পড়ে। আরো বলে, আজ থেকে বাবার সমস্ত দায়িত্ব সে নিয়েছে। বাবা যেমন গ্রামকে এতদিন আগলে রেখেছেন, আজ থেকে সেও সেইভাবেই এই গ্রামকে আগলে রাখবে। আর তার অনুজ তো আছেই তাকে সাহায্য করতে।
রাদাভও ছোট খাটো বক্তব্য রাখে। গ্রামের মানুষের মনে একটা ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে। ওয়াদা করে, সে আর তার ভাই আজীবন এই গ্রামকে আগলে রাখবে, আগলে রাখবে গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে। গ্রামের মানুষ সন্তুষ্ট বেশ। অতঃপর বক্তব্য শেষ হতেই যার যার মতো প্রস্থান ঘটায় সকলে। মেহতাব তখন রাদাভকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ঘাটে যাবি?’

রাদাভ চেয়ে বলল,

‘চলো।’

দুই ভাই মিলে ঘাটে বসল। দুইজনের দৃষ্টি’ই দীঘির স্বচ্ছ জলে নিবদ্ধ। মেহতাব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,

‘একেবারের জন্য চলে এসেছিস?’

‘তোমার সমস্যা না থাকলে, এবার আর ফিরব না।’

মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমার আবার কী সমস্যা হবে? বরং আমি চাই, তুই থাক এখানে। আমার একার উপর চাপ পড়ে খুব। তুই থাকলে আমারও একটু সাহায্য হবে।’

‘মেঝো আর ছোট কাকা আছেন না তোমার সাহায্যের জন্য?’

‘মেঝো কাকা তো আছেন তবে, ছোট কাকাকে তো চিনিস’ই। একমাত্র তুই ছাড়া আমি আর কাউকেই ঠিক মতো ভরসা করতে পারিনা।’

রাদাভ হেসে বলে,

‘আমাকে ভরসা করার জন্য ধন্যবাদ, ভাইজান। আশা করছি, আমি তোমার ভরসার মান রাখতে পারব।’

মেহতাবও হেসে বলে,

‘আমি জানি, তুই অবশ্যই পারবি।’

.

তারা অনেকক্ষণ ঘাটে বসে। এতে করে পরিষ্কার দীঘির জলে গোসল করার লোভ আর সামলাতে পারে না রাদাভ। বিদেশের ঐসব নীল রঙা সুইমিং পুলে গোসল করে কোনো শান্তি নেই। শান্তি তো এখানে, এই স্বচ্ছ ঘাট বাঁধানো দীঘির জলে গোসল করে। সে তাই মেহতাবকে জিজ্ঞেস করে বসে,

‘ভাইজান, দীঘিতে গোসল করবে?’

‘এইসময়?’

‘হ্যাঁ, কতদিন একসাথে দীঘির জলে গোসল করা হয় না। চলো না…’

ভাইয়ের এমন অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই মেহতাবের। সে রাজি হলো। আন্দ্যপান্ত না ভেবেই দুই ভাই ঝাঁপ দিল দীঘির জলে। অবশ্য ঝাঁপ দেওয়ার আগে পান্জাবীটা খুলে রেখেছিল তারা।

বিচার মহলের জানলা দিয়ে তাদের গোসল দেখছে ইশফাক। মনে মনে ভাবছে, “এই মানুষ দুজনকে দেখলে কেউ বলবে যে, তাঁদের বাবা কালকেই মারা গিয়েছেন? বরং দেখে মনে হচ্ছে যেন, গায়ে ফুর্তির শেষ নেই।”

ঘাটে দাঁড়িয়ে মেহতাব ইশফাককে নাম ধরে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গেই তার সম্মুখে এসে সে হাজির হয়। মেহতাব আদেশের সুরে বলে,

‘অন্দরে গিয়ে আমার বিবিজানকে ডেকে নিয়ে এসো। আর সাথে তাকে একটা গামছাও আনতে বলো।’

ইশফাক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল সেখান থেকে। রাদাভ এখনও উঠেনি। সে সাঁতার কেটে চলছে। মেহতাব ঘাটে বসে চেয়ে দেখছে তাকে। উদম গায়ে সূর্যের আলো পড়তে হলদে ফরসা গায়ের রংটা যেন চকচক করছে তার। সে রাদাভের দিকে গভীর মনোযোগে চেয়ে বলে,

‘তুই বিদেশে থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিস, রাদাভ? নিশ্চয় কয়েক জোড়া প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছিস?’

রাদাভ শব্দ করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে,

‘তোমার কি তাই মনে হয়, ভাইজান?’

‘মনে না হওয়ার কী আছে? তোর মতো একজন সুদর্শন ছেলে নিশ্চয়ই সিঙ্গেল থাকবে না।’

রাদাভ ফের হাসল। একটা ডুব দিয়ে উঠে বলল,

‘আমি একদম পিউর সিঙ্গেল।’

মেহতাব ফিচেল হাসে। বলে,

‘এখন বলতে চাচ্ছিস না, বলিস না। সময় হলে পরিচয় করিয়ে দিস, একেবারে বিয়ে পড়িয়ে দিব।’

রাদাভ কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাসল কেবল। জবাবে বলল না কিছু।

তনুকা হাতে একখানা গামছা ঝুলিয়ে ঘাটের নিকটে আসতেই হতভম্ব হলো। দুই ভাইকে এমন অবস্থাতে আশা করেনি সে। মেহতাব তনুকাকে দেখেই চমৎকার হাসল। বলল,

‘আরে বিবিজান, জলদি এসো। তোমার অপেক্ষাতে তো চুল এমনিতেই শুকিয়ে গিয়েছে আমার।’

তনুকার নাম শুনে রাদাভ ঘাটের দিকে তাকায়। তনুকার সাথে চোখে চোখ পড়তেই হাসে সে। বলে উঠে,

‘ভাইজান, ভাবির সামনে উদম গায়ে, আমার তো লজ্জা করছে।’

মেহতাব তার দিকে চেয়ে বলে,

‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভাবি তো মা সমতুল্য।’

রাদাভ আর জবাব দিল না পরবর্তীতে। অন্যদিকে ঘুরে সাঁতার কাটায় মনোযোগ দিল। মেহতাব তনুকার দিকে চাইল। বলল,

‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এইদিকে এসো। চুল মুছে দাও আমার।’

তনুকা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী?’

‘বললাম, চুল মুছে দাও। ঠান্ডা লাগবে নয়তো।’

তনুকা গামছাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনি নিজে মুছে নিন।’

মেহতাব গামছা না নিয়ে উল্টো তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিল। তার দরুন অতি সম্মুখে গিয়ে থামল তনুকা। ভয়ে ঢোক গিলল। ইতস্তত সুরে বলল,

‘কী করছেন? আপনার ছোট ভাই আছেন তো।’

‘কিছু করিনি তো। কেবল চুল মুছে দিতে বলেছি। তাতেই এত ইতস্তত বোধ করলে কী করে হবে? নাও, মুছে দাও এবার।’

মেহতাব তার মাথা এগিয়ে দিল। তনুকা উপায়ান্তর পেল না কোনো। একপলক সে রাদাভের দিকে চাইল। ছেলেটা এইদিকেই চেয়ে আছে। মনে মনে কী ভাবছে, কে জানে। তনুকা কোনোরকমে মাথা মুছে দেয় মেহতাবের। তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলে,

‘হয়েছে, এবার আমাকে যেতে দিন।’

মেহতাব বিরক্ত হলো। বলল,

‘আহা, এত তাড়া কীসের তোমার? বসো এইদিকে।’

একপ্রকার জোর করেই মেহতাব তনুকে তার পাশে বসায়। রাদাভের সামনে এসব কিছু বড্ড অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। মেহতাব তারপর রাদাভের দিকে তাকায়। বলে,

‘রাদাভ, ঐ দূরের পদ্মটা ছিঁড়ে আনতে পারবি?’

রাদাভ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘মজে যাওয়া পদ্ম ফুল দিয়ে কী করবে?’

‘তোর ভাবিকে দেব।’

তনুকার কপালে ভাঁজ পড়ে। লোকটার ব্যবহার অদ্ভুত লাগে তার। তার মতো এমন কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ ছোট ভাইয়ের সামনে বউয়ের সাথে এমন আহ্লাদীপনা কেন করছেন? কী চাইছেন তিনি?

‘কীরে, পারবি না?’

‘আজ থাক না, ভাইজান। কাল ভোরে এসে ছিঁড়ে নিয়ে যাব। ভোরের দিকে সতেজ পদ্ম পাব।’

‘ঠিক আছে তবে, কাল ভোরে এসে এই পদ্মগুলো ছিঁড়ে আমাকে দিস।’

রাদাভ মাথা নাড়াল। মেহতাব বলল,

‘উঠে আয় এবার। নয়তো ঠান্ডা লাগবে।’

‘তোমরা যাও, আমি আসছি।’

মেহতাব উঠে দাঁড়াল। তনুকাকে বলল,

‘চলো, অন্দরে ফেরা যাক তবে।’

বলেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। পরপর অবাক হতে হতে তনুকা ক্লান্ত এবার। হাত না ধরেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘চলুন।’

সে নিজেই দ্রুত মহলের দিকে এগিয়ে গেল। মেহতাব তার পেছন পেছন এগুলো ধীরে সুস্থে।

তাদের চলে যাওয়া কেউ শক্ত চোয়ালে দেখল। অতঃপর জোরে নিশ্বাস ছাড়ল সে। দীঘিতে যত পদ্মফুল ছিল এক নাগাড়ে তা সব ছিঁড়ে ফেলল। দুই হাতে ফুল সব টেনে টুনে ছিঁড়ে একাকার করে ক্রূর হাসল সে। আওয়াজ তুলে বলল,

‘জোর করেই যদি সব পাওয়া যেত তবে, আমিও আজ এই পদ্মফুলটাকে পেয়ে যেতাম। কিন্তু, আফসোস! খালি জোর করলেই সব পাওয়া যায় না। পেতে গেলে বুদ্ধি লাগে, আর তোমার তো সেই বুদ্ধি নেই।’

বলেই ভুবন কাঁপিয়ে হাসল সে।

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here