#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব২৭
#Raiha_Zubair_Ripti
কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। আজ নাইমুর এসেছে তার মা কে নিয়ে শাফায়াত দের বাসায়। বিয়ে নিয়ে কথা বলতে। রজনী চলে গেছিলো তার নিজ বাসায় তার পরের দিন সকালেই। রুয়াত সানজিদা কে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। পড়নে মিষ্টি কালারের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। নতুন বউ লাগছে। নাইমুর চোখ সরাতেই পারলো না সানজিদার থেকে।
শাফায়াত এর মা শারমিন বেগম আর নাইমুর এর মা নূর জাহান কথা বলছেন বিয়ের ডেট নিয়ে। পাশেই শাফায়াত বসে ফোন স্ক্রোল করছে। রুয়াত রান্না ঘরে গেলো জগে পানি আনতে। সেটা দেখে শাফায়াত ও পেছন পেছন গেলো। রুয়াত পানি নিয়ে পেছন ঘুরতেই দেখে শাফায়াত বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে মেয়েটা খেটেই যাচ্ছে। রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘর গুছানো,সানজিদা কে সাজানো এভরিথিং।
-“ এখানে কেনো আপনি? যান গিয়ে বসুন। কিছু লাগলে বলুন এনে দিচ্ছি।
শাফায়াত এগিয়ে আসলো। মিহি কন্ঠে বলল-
-“ তোমাকে দরকার।
কথাটা বলেই রুয়াতের থেকো জগ টা হাতে নিয়ে হাঁটা ধরলো।
-“ চুপচাপ বসে থাকবা। সকাল থেকে অনেক কাজ করছো। খাবার সার্ভ করা সেটা আমি আর আম্মু পারবো।
সোফার কাছে এসে সোফায় বসতে বলে হাত ছেড়ে দিলো। রুয়াত বসলো সোফায়। শাফায়াত গ্লাসে পানি ঢেলে সোফায় বসলো।
নূর জাহান জানান অতি শীগ্রই সানজিদা তার বাড়ি নিয়ে যেতে চান। শারমিন বেগম আপত্তি জানালেন না তা নিয়ে। দুই পরিবারের সম্মতি তে বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো সামনের সপ্তাহে। খুব বেশি আয়োজন হবে না। মিডিয়াম পরিসরে বিয়ে টা হবে।
দুপুর হতেই শারমিন বেগম রুয়াত কে বলল টেবিলে খাবার সাজাতে। রুয়াত জ্বি বলে উঠতে নিলে শাফায়াত বাঁধা দিয়ে বলে-
-“ রুয়াত বসুক আম্মু। খাবার সার্ভ তো আমি করে দিচ্ছি।
রুয়াত উঠে দাঁড়ালো।
-“ আপনা কে করতে হবে না। আমি পারবো।
শাফায়াত পাত্তা দিলো না সেই কথা৷ আগে আগে হাঁটা শুরু দিয়ে টেবিলের কাছে এসে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। পেছন পেছন রুয়াত ও আসলো। তবে শাফায়াত তার বাঁধা শুনলো না। উপায়ন্তর না পেয়ে রুয়াত শাফায়াত এর হাতে হাতে সাজাতে লাগলো টেবিল।
নূর জাহান সেটা দেখে মুচকি হাসলো। বলল-
-“ বাহ্ শাফায়াত তো ভারী বউ পাগল। ভালোই সংসারে ঝগড়া হবে না।
শারমিন বেগম প্রতিত্তোরে হাসলো। নূর জাহান কে নিয়ে উঠে আসলো। নাইমুর উঠে আসার সময় সানজিদা কে ফিসফিস করে বলল-
-“ আমি ও এমন বউ পাগল হবো দেখে নিও।
সানজিদা হাসলো। বউ পাগল ছেলে রা সত্যি অসাধারণ। বিশেষ করে তারা, যারা মা কে মায়ের জায়গায় আর বউ কে বউয়ের জায়গায় রেখে সমান তালে এগিয়ে যায়।
খাবার টেবিল জুড়ে বইছে নানা রকমের খাবারের বাহার। পোলাও,রোস্ট, টিকা,দই,মিষ্টি, পায়েস,গোস,ডাল,ডিম। চোখ জুড়িয়ে আসলো শারমিন বেগম এর। সে আজ রান্না ঘরের ধারে কাছেও যায় নি। তার ছেলের বউ একা হাতে এতো রান্না করেছেন” সত্যি প্রসংশা না করে পারছেন না।
সবাই বসে খেয়ে নিলো দুপুরের খাবার। বিকেল হতেই চলে গেলো নাইমুর তার মা কে নিয়ে।
সন্ধ্যার দিকে গোল বৈঠক বসে বসার ঘরে। বিয়ে সামনের সপ্তাহেই। শারমিন বেগম আত্নীয় দের ইনভাইট করে দিলেন। সাথে রুয়াতের বাপের বাড়ির সকল কে।
রুয়াত সোফার এক কোনে বসে তাদের ব্যস্ততা দেখছে। শাফায়াত লিস্ট বানাচ্ছে। আহ! পুরুষ টা তার কতই না খাটবে বোনের বিয়েতে। রুয়াত ফিসফিস করে বলে উঠল-
-“ ঠান্ডা শরবত এনে দিব? যে হারে পরিশ্রম করছেন।
-“ শাফায়াত তাকালো। শারমিন বেগম ফোন কানে করে চলে গেলেন। হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা তাই কথা বলতে গিয়েছে অন্য সাইডে। শাফায়াত কলম টা টেবিলের উপর রেখে পূর্ণ দৃষ্টি রুয়াতের দিকে দিয়ে বলল-
-“ ভিটামিন সি দিবা? আই নিড দ্যিস।
রুয়াত সোজা হয়ে বসলো। এতোক্ষণ ঝুকে ছিলো।
-“ আপনি এতো অভদ্র কেনো? আমি তো আপনার ভালোর জন্যই বলেছি এটা। শয়তানি না করলে চলে না?
-“ না চলে না৷ শুধু তোমাকে দেখলেই আমার শয়তানি টা বেড়ে যায়। তা না হলে আমি অনেক ভদ্র পুরুষ। ইউ নোও না?
রুয়াত এবার সরু চোখে তাকালো।
-“ আমি সিরিয়াস কিন্তু। শরবত বা ঠান্ডা কিছু লাগলে বলুন নিয়ে আসি। আমি কিন্তু চলে যাব রুমে।
-“ আমিও কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি রুয়াত। আই নিড ভিটামিন সি। আজ নিতে পারি নি ভিটামিন সি। তোমার তো দায়িত্ব রোজ নিয়ম করে তিন বেলা ভিটামিন সি সাপ্লাই করা।
রুয়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুমের দিকে যেতে যেতে বলে গেল-
-“ অসভ্য।
শাফায়াত পেছন থেকে বলে উঠল-
-“ তার জন্য কি তুমি দায়ী নয়?
-“ মোটেও না।
-“ মোটেও হ্যাঁ। উসকিয়ে ছো তুমি আমায়। এখন তার ঝাঁঝ তো নিতেই হবে।
রুয়াত মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো।
রুমে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে সাদমান। সেদিন ভেজার পর থেকে শরীরে জ্বর। রুয়াত রুমে যাওয়ার আগে সাদমান কে দেখতে চলে আসলো। দরজায় কড়া নেড়ে বলল-
-“ আসবো?
সাদমান দরজার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ হ্যাঁ রুয়াত আসো।
রুয়াত রুমের ভেতর ঢুকে বলল-
-“ কেমন আছেন এখন জ্বর কমেছে?
-“ হ্যাঁ কিছুটা কমেছে।
-“ ওহ্। আচ্ছা থাকুন তাহলে আসি। কিছু দরকার হলে টেক্সট করে জানাবেন।
-“ আচ্ছা।
রুয়াত রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। কাছে আসতেই ফোনে নোটিফিকেশন আসলো। সাদমান মেসেজ পাঠিয়েছে-
-“ তুমি বলেছো কিছু দরকার হলে তোমায় মেসেজ দিতে। আই নিড ইউর সিস্টার। প্লিজ ডু সামথিং।
রুয়াত রজনীর নম্বরে কল লাগালো। রজনী ঊষার সাথে কথা বলছিলো। রুয়াতের কল পেয়ে ঊষার থেকে বিদায় নিয়ে কল রিসিভ করলো।
-“ কেমন আছিস রুয়াত?
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু একজন ভালো নেই।
-“ কে?
-“ সাদমান ভাইয়া। তুমি তাকে কল দিয়ে একটু খোঁজ-খবর নাও। তার ভালো লাগবে।
-“ হ্যাঁ আমি ভেবেছিলাম ফোন দিব। কিন্তু হয়ে উঠে নি। এখনই দিচ্ছি।
রুয়াত কেটে দিলো ফোন। রজনী কল করলো সাদমান এর নম্বরে। সাদমান ফোন হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। হুট করে ফোন আসতেই হাত থেকে সেটা পড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে ফোনটা উঠিয়ে কানে নিয়ে বলল-
-“ আসসালামু আলাইকুম রজনী । কেমন আছেন?
-“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন এটা জিজ্ঞেস করার কথা ছিলো আমার। আর আপনি জিজ্ঞেস করে বসলেন। সে যাই হোক। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন এখন?
-“ আপনার কন্ঠস্বর শুনে এখন একদম ফাস্ট ক্লাস আছি।
-“ কেনো আমার কন্ঠে কি মেডিসিন লাগানো নাকি? যে শুনলেন আর ভালো হয়ে গেলেন?
-“ ধরে নিন কিছুটা তাই।
-“ আচ্ছা ধরলাম। তা ওষুধ খেয়েছিলেন দুপুরে?
-“ হ্যাঁ খেয়েছি।
-“ আপনার শরীর টা তো দেখছি মেয়েলি শরীরের থেকেও বাজে। আমি ভিজলাম অথচ আমার জ্বর আসলো না। আর আপনার সেদিন রাতেই চলে আসলো! ফরেনার বলে কথা।
-“ তা যা বলেছেন। বউয়ের সাথে বৃষ্টি বিলাস করতে গেলে আগাম মেডিসিন খেয়ে তারপর ভিজতে হবে। তা না হলে সাময়িক সুখের জন্য একমাস বেড রেস্টে থাকতে হবে।
-“ বউয়ের জন্য সামান্য এইটুকু সহ্য করতে পারবেন না?
-“ সহ্য করতে পারি বলেই তো বিয়ে না হয়েও এক রমণীর জন্য ভিজে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।
-“ রমণী কে নিয়ে গিয়েছিল কে? রমণী কি বলেছিল সে যাবে ওখানে?
-“ তা বলে নি। তবে…
-“ তবে কি?
-“ তার মুখে হাসির কাছে এই জ্বর নিছকই ফিকে।
-“ পাম দিয়ে পটাতে চান আমায়?
-“ সত্যি বলায় যদি পাম হয়। আর সেই পামে যদি পটে যান তাহলে এরকম সত্য পাম হাজার দিব।
-“ আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। রাতের খাবার টা খেয়ে মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আল্লাহ হাফেজ।
সাদমান শুধু হুমম বলল। রজনী কে’টে দিলো ফোন। সাদমান নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলো ফোনের দিকে।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছে রোহান নেহাল আর নীতি। চলে যাব নীতি আজ তার নিজ ঠিকানায়। যেখানে সারা বছরের এক বড় অংশ সময় অতিবাহিত করতে হয়। রোহান আসতে চায় নি কিন্তু নীতির জন্য না এসেও পারলো না। ফোন করে করে কান পচিয়ে ফেলছে। নেহাল মাঝখানে বসে আছে। ট্রেন আসতেই নীতি নেহাল উঠে দাঁড়ালো। নেহাল বোন কে জড়িয়ে ধরলো। আদর করলো। ফোন আসতেই একটু সাইডে চলে গেলো। আবার ছুটি পাবে তবেই আসতে পারবে। নীতি ল্যাগেজ নিলো। রোহান এখনও নিশ্চুপ হয়ে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। নীতি একঝলক তাকালো। তারপর ফিসফিস করে বলল-
-“ আপনার হৃদয় টা পুড়ছে না? আমার খুব পুড়ছে হৃদয় টা। কত গুলো দিন আবার না দেখে থাকতে হবে আপনাকে। ফোন দিলে একটু ধরবেন কেমন? আমি নিশ্চুপ হয়ে আপনার কন্ঠ শুনবো। বিরক্ত মোটেও করবো না। আর রাজনীতি করছেন করুন। একটু দেখেশুনে করবেন কেমন? আপনার যেনো কিছু না হয়। তাহলে হয়তো পৃথিবীতে সেদিন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিবে আমার জন্য।
রোহান উড়ে দাঁড়ালো। ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো-
-“ ভালোবাসিস আমাকে?
ভালোবাসিস আমাকে? কথাটা এতো নিদারুণ লাগলো কেনো নীতির কাছে? মনে হলো কিছুটা স্বর্গীয় সুখের ঘ্রাণ পেলো। নীতি কে চুপ থাকতে দেখে রোহান তাড়া দিয়ে বলল-
-“ চুপ কেনো? বল বাসিস ভালো আমায়?
নীতির কেমন যেনো কেঁদে দিতে ইচ্ছে করলো। চোখ টলমল করলো। কোনোরকমে মাথা নাড়ালো উপর নিচ।রোহান সময় ব্যয় করলো না নীতি কে জড়িয়ে ধরতে। মাথায় চুমু খেয়ে বলল-
-“ বাসিস না আর ভালে নীতি। ভুলে যাস আমায়। তোর যোগ্য নই আমি। আমি স্বার্থপর হতে চাই না। তোর ভালোবাসা কে স্বীকার করতে গেলো লোকে বলবে আমি স্বার্থপর, সুবিধাবাদী। নিজের স্বত্বা কে হেয়ো করতে চাই না। ভুলে যা আমায়। আজকের পর থেকে আমাকে নিয়ে ভাবিস না। সুখ পাবি না আমাকে নিয়ে ভাববে দুঃখ ছাড়া। ভালো থাকিস।
রোহান ছেড়ে দিলো নীতি কে। নীতি বরফের মতো জমে গেলো। কি বলল এটা রোহান? তাকে ভুলে যেতে! আট বছরের ভালো লাগা, ভালোবাসা কে সে ভুলে যাবে? নেহাল কথা বলে শেষ করে চলে আসলো বোনের কাছে। বোনের ল্যাগেজ টা হাতে নিয়ে বোনের এক হাত ধরে ট্রেনে উঠিয়ে দিলো। ট্রেন ছাড়ার জন্য উদ্যোত হলো। নীতি জানালা দিয়ে তাকালো। রোহান তাকিয়ে আছে তার দিকেই। হাত উঁচা করে বিদায় জানাচ্ছে। আকাশী কালার শার্টে কি সুন্দর লাগছে লোকটা কে। লোকটা কি তার অপ্রাপ্তি তেই থেকে যাবে? নীতি শুনেছে কোথাও। ভালোবাসা সত্যি হলে না পাওয়ার অপেক্ষায় ও নাকি অনেক মানুষ তার কাঙ্খিত মানুষ টিকে পেয়ে যায়। আচ্ছা নীতি অপেক্ষা করলে কি সেও পাবে তার এই কাঙ্খিত মানুষ টি কে? পেতেও তো পারে। হ্যাঁ সে অপেক্ষা করবে সেই দিনটির যেদিন রোহান নিজ থেকে এসে তাকে স্বীকার করবে। কেটে যাক এক যুগ তাতেও নীতি রাজি অপেক্ষা করতে।
#চলবে?
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/