#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব:৭ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
১১. রাত প্রায় পোনে দুইটা। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে মুখরিত হয়ে উঠেছে সারা পরিবেশ। কিন্ত নিভ্র সেসব পরোয়া না করে বেলকনিতে চেয়ার পেতে কোনো একটি বিষয় নিয়ে গুগল ঘাটাঘাটি করতে মগ্ন। ফর্সা কপালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চিন্তার ভাঁজ। এই মৃদু বর্ষার শীতল রাতেও তার নাকের ডগায় বিন্দুপরিমাণ ঘাম লেপ্টে আছে। মৌনির যে ”Overnight disorder” এর মতো একটা ভয়ঙ্কর রোগ আছে নিভ্র আগেই তা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। তবে তা যে এত ভয়ঙ্কর পরিমাণে ওর অস্তিস্তে বিরাজ করবে তা ধারনা করতে পারেনি। অথচ মেয়েটা কতটাই না স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করে বেড়াচ্ছে !
মৌনির এ রোগের কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসা এখনও বাংলাদেশে হয়নি কারন এটা ইউরোপ থেকে উৎপত্তি হয়েছে যার একটি ডোজ মৌনির অগোচরেই ওর শরীরে দেয়া হয়েছিলো। তবে বিশেষ কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে এটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে এই আর্টিকেল পড়েই নিভ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মাঝে মাঝে নিভ্র অনেক অবাক হয়ে যায় নিজের কাজগুলো দেখে। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটি অপারেশনে সে সাক্সেসফুল হয়েছে সে………আবার কখনও কখনও বিফলও হয়েছে । কিন্ত মৌনির প্রতি ওর যেই চিন্তাটি কাজ করে ; নিভ্রর মনে পড়েনা কখনও অন্য কারও প্রতি এমন অনুভূতিটা কাজ করেছিলো কি না।
.
—একি নিভ্র? এখনও ঘুমাসনি?
তুর্যকে সামনে দাঁড়াতে দেখে নিভ্র ল্যপটপটা বন্ধ করে রাখে। চোখে মুখে বেশ ক্লান্তির ছাপ। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলো…….
—না। একটু রিসার্চ করছিলাম।
.
তুর্য মলিন হাসে নিভ্রর কথা শুনে। একটা মেয়ের জন্য ওর এত দরদ দেখে তুর্য বেশ অবাকই হচ্ছে।
—মৌনির জন্য চিন্তা করছিস না?
—হ্যাঁ।
—আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল্ তো। এই মেয়েটা অসুস্থ মানলাম। বাট তুই জানোস না ওর সাথে থাকলে তোর লাইফের রিক্স আছে?
—মানে?
—এমন ভাব করছিস যেন কিছুই তুই জানিস না। নিভ্র think carefully ! এই মেয়েটাকে তুই প্রথম পেয়েছিলি গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। ওকে মারার জন্য একটা ক্রাইম গ্যাং পড়ে আছে। দোষটা ওর না। মৌনি যেই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে এই ক্ষেত্র্রটা খুবই রিস্কি……….
.
এবার ক্ষেপে ওঠলো নিভ্র। অনেকটা উচ্চস্বরে বলে ওঠে……….
—তো কি বলতে চাস তুই? আমি তাহলে এই বিপদে ওকে ছেড়ে দিবো……..
—ছেড়ে দিবি কেনো? তোর সিকিউরিটির একটা,,,,,,,,,
—জাস্ট শাট আপ স্টুপিড ! তুই আমার ফ্রেন্ড বলে বেশি কিছু বলবো না। একটা কথা ভালোমতো শুনে রাখ। মৌনি যতদিন আমার সাথে থাকতে চাবে ততদিনই ও থাকবে। ওর ফুল সিকিউরিটির দায়িত্ব আমি নেবো। ওকে সুস্থও করবো আমি।
এর জন্য আমার যদি রিস্ক নিতে হয় তবুও আমি রাজি। এই ব্যাপারে তোর মুখে আর একটা কথাও আমি না শুনি তুর্য।
.
এটা বলেই নিভ্র থেমে যায়। রাগে তার গা কাঁপছে। তুর্য এই প্রথম নিভ্রকে এত পরিমাণ রাগতে দেখলো। নিভ্র তুর্যকে পরোয়া না করেই উঠে চলে গেলো নিজের ঘরে। আর তুর্য বাকরুদ্ধ। নিভ্রর এই কাজে মুখে মিহি হাসি ফুটলো তুর্যের। আনমনে বলো……
—তোর পার্টনার পেয়ে গিয়েছিস তুই। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
.
.
—————
পূব দিগন্তে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সূর্যের রেখা। বাইরে বহমান ফুরফুরে বাতাস। ছাদের একপ্রান্তে মৌনি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন আকাশটা পরিষ্কার হবে। কাপাকাপা হাতে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফুরফুরে বাতাসের ওর মনে প্রশান্তির বদলে এলোপাথারি ঝড় বয়ে দিচ্ছে। মোবাইলটা অন করতেই দেখলো ওর আব্বু-আম্মু বন্ধু আর প্রফেসরের অনেকগুলো মিসডকল। বাবার সাথে যদিও নিভ্রর ফোন দিয়ে কথা হয়েছে কিন্ত মৌনি তাকে বলেনি যে ও এখন ঢাকায় নেই। কিন্ত প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করাটা এখন খুব প্রয়োজন। প্রফেসর এ সময় মর্নিং ওয়াকে বের হবে তাই আর কিন্ত না ভেবে প্রফেসরের নম্বরে কল দিলো মৌনি……..। দু’তিনবার রিং হওয়ার পরই প্রফেসর কল ধরলো। ব্যতিব্যস্ত স্বরে বললেন……
.
—হ্যালো , মৌনি ! কোথায় তুমি? ঠিকাছো তো? তিনদিন ধরে তোমায় কলের ওপর কল করে যাচ্ছি বাট নো রেসপন্স…….
—আমি এখন চট্টগ্রামে আছি স্যার।
.
প্রফেসরকে কথা বলতে না দিয়েই মৌনি ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে। মৌনির কথা শুনে অপরপাশে থাকা এনায়েতউল্লাহ সাহেব খানিকটা অবাক হয়ে যায়।
—চট্টগ্রামে আছো মানে? আমাদের দুদিন পর সব ফাইল জমা দিতে হবে আর তুমি…….wait ! তুমি ঠিকাছো তো মৌনি?
—এখনও আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি স্যার । ক’দিন লুকিয়ে থাকবো এভাবে জানিনা। সেদিন রিদান শেখের লোকদের কাছ থেকে একটুর জন্য বেঁচে ফিরি আমি। আমায় আটকানোর জন্য আমার পায়েও শুট করেছিলো।
তারপর একে একে মৌনি নিভ্রর কথাও খুলে বলে প্রফেসরকে। সব শুনে এনায়েতউল্লাহ সাহেব চিন্তায় পড়ে যান মেয়েটির জন্য। এভাবে ওর জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে পেনড্রাইভ দেওয়া উচিত হয়নি উনার যা ভালোমতই এখন বুঝতে পারছেন।
.
—স্যার পেনড্রাইভটা যতদ্রুত সম্ভব আমার কাছ থেকে নিয়ে নিন। এই দুর্নীতির কাজটি যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। নাহলে হাজারো মানুষের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে ফেক সার্টিফিকেটের পাল্লায় পড়ে।
—পেড্রাইভটা কোথায় এখন?
.
—আমার কাছেই আছে।
.
—তোমার কাছে এর 50% সফটকপি আছে না? যতদ্রুত সম্ভব তা আমার ইমেইলে পাঠাও। আপাতত অল্প এভিডেন্স দিয়েই ব্যাপারটা মেনেজ করি। পারবে তো?
.
—হুমমম।
—আচ্ছা তাহলে আর বেশি কথা বলবো না। ঢাকায় এই মুহূর্তে আসার একটুও প্রয়োজন নেই। Take care of yourself young girl !
.
কথা শেষ হওয়া মাত্রই মৌনি মোবাইল সুইচ অফ করে রাখে। প্রফেসরের সাথে কথা বলার পর মনের তিক্ততাটি একটু কমেছে মৌনির। মাঝে মাঝে মনে একটা ভয় কাজ করে। আগে এ জীবন চলে গেলেও ওর আফসোস লাগবে না এমন একটা ভুল ধারনা কাজ করতো ওর মনে। কিন্ত ব্যাপারটা ভুল। নিভ্র ওর জীবনে আসার পর থেকেই জীবনটা অন্যভাবে দেখতে শিখেছে মৌনি। আচ্ছা , একদিন তো একদিন নিভ্র থেকে সে সরে আসবে । তখন কি নিভ্রর মৌনি নামের এই মেয়েটির কথা মনে পড়বে? নাকি না? এরকম হাজারো উল্টা-পাল্টা চিন্তার মধ্যেই পেছন থেকে ভেসে এলো এক অতিপরিচিত সুর।
.
—আজকে এত সকালে উঠলে যে?
কন্ঠটি আর কারও না ; নিভ্রর। নিভ্রর চোখে চোখ পড়তেই মৌনির হৃদকম্পন যেন বন্ধ হয়ে গেলো। নিভ্র ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে এসেছে। চোখদুটোতে এখনও রাজ্যের ঘুম। ঠোঁটদুটো কেমন যেন টকটকে লাল লাগছে মৌনির কাছে। মৌনি প্রতিউত্তরে বললো…….
—ঘুম আসছিলো না তাই ছাদে এলাম। আপনার এ অবস্থা কেন?
—ছাদের দরজা খোলা দেখেই ছুটে চলে এলাম। এ বাড়িতে সকালে ছাদের দরজা খুব কম সময়ই খোলা থাকতে দেখা যায়।
—ওহ্।
নিভ্র খেয়াল করলো মৌনির চোখে-মুখে হালকা দুশ্চিন্তার ছাপ। বারবার কিছু বলতে চেয়েও বারবার যেন আটকে যাচ্ছে।
—কি হয়েছে মৌনি?
—না……..কিছুনা।
মৌনির এই উত্তরটা নিভ্রর কেন যেন পছন্দ হলো না। ভ্রু কুচকে বললো…..
—Are you sure? কিছু লুকাচ্ছো না-তো আবার?
.
নিভ্রর এ প্রশ্ন শোনামাত্র মৌনি নিজের ওড়নার পেছনে মোবাইলটি আরও সাবধানতার সাথে লুকিয়ে রাখে যাতে নিভ্র বিন্দুমাত্র তা আন্দাজ করতে না পারে।
—না……না। কিছু লুকাচ্ছি না।
.
—okay…….নিচে চলো তাহলে…….রোদে পুরে তো নাহলে ছারখার হয়ে যাবে।
—হুম। আপনি চলেন আমি আসছি।
.
.
.
১২.
দুপুরের ঠা ঠা রৌদ্দুরের প্রবাহে পরিবেশ যেন চৌচির হয়ে গিয়েছে।গতরাতে যেমনই ফুরফুরে বাতাস ছিলো এখন তেমনই বিদীর্ণ গরম। মানুষ ছাড়া ছোট্ট এই বাড়িটা একেবারেই নিস্তেজ মনে হলো মৌনির কাছে। নিভ্র কোনো একটা জরুরি কাজের জন্য ইমিডিয়েটলি বাইরে যেতে হয়েছে। সম্ভবত নিভ্রর একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্সেল আসবে যেটা নিভ্রকেই নিয়ে আসতে হবে। আর নিভ্রর সব বন্ধুরা যার যার কাজে চলে গিয়েছে। এই কারনবশত মৌনিকে সময়টা পার করতে হচ্ছে অনেকটাই একা।
.
এই বাড়িটাতে প্রচন্ড পরিমাণে বই আছে যা পড়ে যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের দিন অনায়াসে কেটে যাবে। তাই মৌনি চিন্তা করলো সময়টা না হয় বই পড়েই পার করে দেওয়া যাক। নিভ্রর রুমে যায় সে। ঘরটা মোটামোটি গোছানোর মধ্যেই অগোছালো। খাট আর ড্রেসিংটেবিল পরিষ্কার। তবে স্টাডি টেবিলটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে।
দেয়ালে রয়েছে নিভ্রর হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি। মৌনি কিছুক্ষণ সে ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। সেখান থেকে একটা বই উঠাতে গেলেই আচমকা বইয়ের মাঝ থেকে টুপ করে একটি কাগজ পড়লো। মৌনি কাগজটা উঠিয়ে নিয়ে দেখে একটা মেডিকেল রিপোর্ট। রিপোর্টে নিজের নাম দেখে আরও অবাক হয় সে।
রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে—–Overnight Disorder (Positive)
Blood group A+
আরও অনেক কিছুই লেখা লিখা ছিলো যা মৌনি বুঝতে পারলো না পড়ে। তবে ওর কোনো রোগ আছে?আর নিভ্র ভাই এতবড় একটা সত্য ওর থেকে লুকিয়ে রাখলো ? কেন? চিন্তায় মাথা ভার হয়ে যাচ্ছে।মৌনি বুঝতে পেরেছে নিভ্রর এতদিনের সব কেয়ার চিন্তা ওকে সুস্থ করানোর জন্যই ছিলো ; মৌনিকে সে কোনোদিনই ভালোবাসেনি।
.
ধপ করে নিচে বসে পড়লো মৌনি। চোখ দিয়ে বেয়ে পড়তে অবলীলায় অশ্রু। মাথার মধ্যে আবারও চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়েছে। চোখের সামনে সব কিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে। আটকে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। কিন্ত কেন? মৌনি ভাবছে এই রোগটার জন্যই কি তবে……….
শরীরটা মেঝেতে নেতিয়ে পড়তেই মৌনি বুঝতে পারছে যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে সে। নাক দিয়ে তরল রক্ত অনুভব করতেই মুখে ফুটিয়ে তুলে এক তাচ্ছিল্যের হাসি। নিভ্র থাকতে ওর কিছু হবে না তা মৌনি জানে। কিন্ত মৌনি এখন নিঃশেষ হতে চায়। দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে চায় নিভ্র নামের এই অস্তিত্ব থেকে।
.
.
.
.
~চলবে~
পর্বটা একটু অগোছালো হয়ে গিয়েছে। আজ লেখার ইচ্ছে ছিলো না। তবুও অগোছালো করে একটা পার্ট দিলাম।