১.
অচেনা একটি ছেলের সাথে ভয়ে সিটিয়ে আছে মৌনি। ছেলেটার ডান হাত মৌনিকে আকড়ে রেখেছে আর অন্য হাত দিয়ে চেপে রেখেছে মৌনির কোমল ঠোঁটযুগল। কিন্ত মৌনির সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের সকল ভয়-ব্যাথা ভুলে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে এই ছেলেটার দিকে।
ছেলেটার হালকা বাদামী চোখযুগল রাতের আধাঁরে অনন্য লাগছে। একবার সে মৌনির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার অন্যপাশে থাকা হন্য হয়ে বেড়ানো লোকগুলোর দিকে। ওদের কথা ভাবতেই আঁতকে ওঠে মৌনি। ওই লোকগুলোর হাতে পড়লেই সর্বনাশ হয়ে যাবে ওর। ভয়ে একপ্রকার তটস্থ হয়েই আরও মিশে গিয়েছে সেই ছেলেটার সাথে। ওকে এত ভয় পেতে থাকে ছেলেটা মৌনির মুখের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো…..
—–হুশশশ। এত ভয় পেয়ো না। ওরা বুঝে যাবে যে আমরা এখানে আছি।
.
মৌনি নিজের ভয় কমিয়ে পুনরায় তাকায় ছেলেটার দিকে। একটা ছেলের ফিসফিসানো কন্ঠ এতটা নেশাক্ত কি করে হতে পারে এটা যেন ওর মাথাতেই আসছে না। বুড়িগঙ্গার পানির ঘোলাটে গন্ধ থেকে সেই ছেলেটার গায়ের তীব্র ঘ্রাণ ওর নাকে আসছে। এদিকে পায়ে গুলি লাগার কারনে অসহনীয় ব্যাথার সাথে কলকল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ায় সামনের দৃষ্টি যেনো ঘোলাটে হয়ে আসছে। কানে ওর ভেসে আসছে কিছু সরু কন্ঠ……
.
—–জলদি ওই মাইয়াডারে সবাই খোঁজ। ওরে লগে না নিয়া যাইতে পারলে ওস্তাদ আমাগো কল্লা কাইট্টা দিবো।
.
একথাটি শুনে মৌনির বুকের ধুকধুকানি ক্রমশ যেন বেড়েই চলছে। হঠাৎ লঞ্চ ছাড়ার শব্দ হলেই সেই লোকগুলো আরও বিচলিত হয়ে পড়ে। যেকোনো মুহূর্তেই সদরঘাটের এই লঞ্টি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। এদিকে মেয়েটাকে খুঁজে না পেয়েই তাদের চোখমুখ আরও শুকিয়ে গেছে। ওদের মধ্যেই একজন বলে ওঠে……
—- আমার মনে হয় মাইয়াডা লঞ্চ থেইক্কা নাইম্মা গেসে। অনেকক্ষণই তো খুঁজলাম। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকন যাইবো না। এমনিও হাতে পিস্তল আছে। লোকজন বুঝলে সমস্যা হইবো।
বাকি সবাইও সম্মতি জানায় । তাই আস্তে করে সবাই বেরিয়ে পড়ে লঞ্চ থেকে।
.
লোকগুলা চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিভ্র। সে জানে না লোকগুলো কে আর কেনই বা এই মেয়েটার পায়ে গুলি করেছে। তার মনে হয়েছিলো মেয়েটা বিপদে আছে আর যেভাবেই হোক ওদের হাত থেকে ওকে উদ্ধার করতে হবে তাই হণ্য হয়ে থাকা লোকগুলো থেকে মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য লঞ্চের এই অন্ধকার কোণায় নিয়ে আসে । এদিকে মৌনির অবস্থা করুন। একে তো গুলিবদ্ধ পা দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়াতে সহ্য করতে হচ্ছে অসহনীয় ব্যাথা। আবার অনেকটা ভয়ের কারনেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরিচিত এই ছেলেটার সাথে মিশে গিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। কিছুতেই তার চোখ যেন মেলে থাকতে চাইছে না।
নিভ্র তা দেখে আলতো হাতে মেয়েটার গালে থাপ্পড় মারে। কিছুটা শঙ্কা নিয়ে বলে ওঠে….
—কি হয়েছে তোমার? চোখ খোলার চেষ্টা করো।
কিন্ত মৌনি কিছুই করতে পারলো না। সে বুঝতে পারছে যে লঞ্চ ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। এখন আর কিছুই করার নেই মৌনির। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে সে তলিয়ে যায় তার অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যতের দিকে।
.
.
২.
নিজের চেতনা ধীরে ধীরে ফিরে পেতে শুরু করেছে মৌনি পানির স্পর্শ পেয়ে। আশেপাশের শীতল বাতাস তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেও সে যেন অনুভব করছে এর প্রবল রকমের উষ্ণতা ; যেন এই উষ্ণতার রেশ তাকে যেকোনো সময়ই গ্রাস করতে পারবে। পিটপিট করেই চোখ খুলতেই তার চোখের সামনে সেই ছেলেটাকেই পায়। আশেপাশে খোলা আকাশ দেখেই বিচলিত হয়ে পড়ে সে। তড়িঘড়ি করে সে সরে আসে ছেলেটার বুক থেকে। সে এখন লঞ্চের ছাদে আছে। চারিদিকে শুধু জোৎস্নামাখা আকাশ তার কলকল পানি। সেই হিংস্র লোকগুলোর কথা ভাবতেই মৌনির গায়ে যেন হিম ধরে গেিয়েছে। অপরিচিত এই ছেলেটাকে জ্ঞান ফেরার পর এত কাছে পেয়ে তৎক্ষণায় সে দূরে সরে আসে।
হঠাৎ মেয়েটার এমন রিয়্যাক্ট করাতে হকচকিয়ে গিয়েছে নিভ্র। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এই মেয়েটা প্রচন্ড পরিমাণে ভয় পেয়ে আছে। নিভ্র একটু এগিয়ে যায় মেয়েটার কাছে। নিভ্র যতই এগিয়ে আসছে মেয়েটা ততই পিছিয়ে একপর্যায়ে লঞ্চের ছাদের রেলিংয়ের সাথে ঘেঁষে বসে পড়ে।
.
—রিল্যাক্স হও। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।
.
ছেলেটার শীতল কন্ঠ শুনে মৌনি চোখ তুলে তাকায় ছেলেটার দিকে।চোখাচোখি হতেই ছ্যাঁত করে উঠলো মৌনির বুকটা। ছেলেটা দু হাটু গেড়ে বসে আছে ওর সামনে । চোখের দৃষ্টিতে আছে একপ্রকার সহবচ্ছতা। জোৎস্না রাতের মায়াবী আলোর প্রতিফলনে এই ছেলেটার রূপ যেন শরীর চিরে বেরিয়ে পড়ছে। আর কি সুন্দর তার দৃষ্টি। ওই লোকগুলোর মতো এই ছেলেটার চোখে কোনো তিক্ততা নেই ; শুধু রয়েছে অগাধ মায়া।
নিভ্র বুঝতে পারছে যেএই মেয়েটা ঠিক ওকে ভরসা করে উঠতে পারছেনা। কিন্ত আফসোস এখানে নিভ্রর পরিচিত কোনো মেয়ে নেই যে এই মেয়েটাকে আগলে ধরবে।মেয়েটা রীতিমতো যেন কাঁপছে।একপর্যায়ে মেয়েটার দুবাহু আঁকড়ে ধরে নিভ্র। তার কালচে বাদামী চোখের দৃষ্টি সরাসরি স্থাপন করে মেয়েটার চোখের ওপর। একপর্যায়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মৌরি। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে সে নিভ্রর দিকে। নিভ্র একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে আবারও বলে উঠলো………
.
—আমি বলছি আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। বলো কি হয়েছে?
.
এবার মৌনি শান্ত হয়ে বসে। অজানাভাবেই এই ছেলেটাকে ভরসা করতে মন চাচ্ছে তার। নিজের ভয়টাকে হালকা দূর করে স্বাভাবিকভাবে রেলিং ঘেষে বসে থাকে সে। পানিরাশির বড় বড় স্রোত পেরিয়ে লঞ্চ অগ্রসর হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে।
.
নিভ্র প্রশ্ন করে মেয়েটিকে…..
—নাম কি তোমার?
—মৌনি।
নিজের কোমল ঠোঁটযুগল হালকা নাড়িয়ে মৌনি বললো।
—বাসা কোথায়?
—কুমিল্লা। পড়ার সুবাদে ঢাকায় থাকি। Department of Mass communication ,2nd year, Dhaka University……
নিভ্র মোটামোটি অবাক হয়ে গিয়েছে মৌনি নামের মেয়েটার কথা শুনে। ঢাকা ভার্সিটির একজন জার্নালিজম স্টুডেন্ট হয়ে এত বড় সমস্যায় কিভাবে পড়লো এটাই নিভ্রর মাথায় যেনো ঢুকছে না।
কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র আবার প্রশ্ন করলো….
—-ওই লোকগুলো তোমার পিছে কেন পড়েছিলো আর তোমায় শুটই বা কেন করেছিলো?
.
এই প্রশ্ন শুনেই মৌনির মনে পড়ে যে ওর তো পায়ে গুলি লেগেছিলো। সাথে সাথেই গোড়ালির দিকে তাকায় সে। একটা মোটা তুলো দিয়ে গুলিবিদ্ধ অংশ চারিদিক থেকে আবদ্ধ করা। আগের তুলনায় ব্যাথার পরিমাণটাও যেন বেশ কম। মৌনি পুনরায় তাকায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা উদগ্রীব হয়ে বসে আছে ওর উত্তর শোনার জন্য।
.
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে…
—জার্নালিজম পড়ছি বলে ভাবিনি এত বড় সমস্যার মুখী হবো। আমাদের একটা প্রজেক্ট দেয়া হয়েছিলো ফেক সার্টিফিকেটের টপিকে।এই প্রজেক্টটা ঠিকঠাকমতো কমপ্লিট করতে পারলে একটা বড় সুযোগ থাকবে আমার আগামী ক্যারিয়্যারের জন্য। আর এই প্রজেক্টে যারা ফেক সার্টিফিকেট বানায় তাদের সেই বড় চক্রান্তের অনেক বড় একটা প্রুফ আমার হাতে আসে যা কোনোভাবে তাদের লিডার জেনে গিয়েছিলো। তাই সে আমায়……….
.
—মেরে ফেলতে চায়?
.
—হ্যাঁ। তবে আমার থেকে আগে প্রুফগুলো নিয়ে। তাই তারা আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। আমি থামছিলাম না দেখে ঠিক গোড়ালিতে শুট করে।
এতটুকু বলেই চুপ হয়ে যায় মৌনি। নিভ্ররও আপাতত এখন আর কোনোকিছু জানার নেই। এই পরিস্থিতিতে পড়লে যে কেউই ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা এখনও রীতিমতো কাপছেঁ। নিভ্র বুঝতে পারছে না এখন কিই বা করা উচিত। একে তো মেয়েটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সদরঘাট থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের এই লঞ্চে উঠেছে আবার ঢাকায় ফিরে গেলেও মেয়েটার সমস্যা হবে।
.
নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র এবার মৌনিকে প্রশ্ন করলো…
—-এবার কি করবে তুমি?
.
মৌনি ছলছল চোখে তাকায় এই ছেলেটার দিকে। ছেলেটাকে দেখে নিতান্তই মৌনির আপন মনে হচ্ছে যেন কত বছরের সম্পর্ক দুজনের।
—আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না। ঢাকায় ফিরে গেলে ও-ওরা ম-মেরে ফেলবে আমায়। আ-আমায় ওই জানোয়ারগুলো খুবলে খুবলে খাবে। আমি ফিরে যেতে চাই না ওখানে।
এতটুকু বলেই আচমকা নিভ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৌনি। শব্দ করে কাদতে থাকে সে। নিভ্র একহাতে মৌনিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে। এই মেয়েটার এখন সাপোর্ট প্রয়োজন। মৌনির কাদতে কাদতে বলে ওঠে…….
—-আপনার সাথে আমি যেতে চাই ভাইয়া। আপনি আমায় নিজের সাথে নিয়ে যাবেন প্লিজ। ও-ওরা নাহয় আবার……..
এতটুকু বলে ছেলেটার বুকে আরও গভীরভাবে মিশে যায়।মৌনি জানেনা এই ছেলেটা কে ; কি তার পরিচয় । কিন্ত একজন দূত হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাকে পাঠিয়েছে এ বিশ্বাসটা প্রবলভাবে মৌনি ধারন করেছ।
নিভ্রও কিছু না বলে আলতো করে মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রতিউত্তরে সে বলে…….
—আচ্ছা ঠিকাছে। তুমিও চলবে আমার সাথে।
একথা শুনে নিজেকে মৌনি শান্ত করে। ছেলেটার বুকে থেকেই সে বলে ওঠে…
.
—আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানলাম না।
.
—আমার নাম নিভ্র। জন্মস্থান চট্টগ্রাম । এখন নিজের বাড়িতেই যাচ্ছি আমি।
.
”নিভ্র !” আনমনে মৌনি বলে ওঠে যা নিভ্র নামের এই সুদর্শন ছেলেটির কানে পৌঁছায় নি। ছেলেটার কন্ঠে একটা নেশা আছে। শুনলেও যেন আরও বেশি শুনতে মন চায়। মৌনির একটু ইচ্ছে করছিলো আরও প্রশ্ন করতে কিন্ত মাথাটা দুর্বলতার কারনে ঝিম ধরে আছে। পায়ের ব্যথাটাও চিনচিন অনুভব করতে পারছে। মৌনি জানেনা ওর আগামী দিনগুলো কেমন যাবে কিন্ত সে প্রবলভাবে অনুভব করতে পারছে নিভ্র নামের এই ছেলেটা তার জীবনের ভারসাম্য হারিয়ে দেবে।
চোখের পাল্লা ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে আসছে মৌনির। ধীরে ধীরে নিভ্র নামের এই ছেলেটার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।
,
কিছুক্ষণ কেটে গেলো পিনপন নীরবতা। মৌনি নামের মেয়েটাকে এভাবে তার বুকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে নিভ্র বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। এরকম পরিস্থিতিতে এর আগে কখনোই পড়েনি সে। মেয়েটার চোখে মুখে একপ্রকার মায়া আছে যা ভীতির ছাপে লম্বা একটা সময় আড়ালে ছিলো। জোৎস্নার ছোয়ায় সেই মায়াটি যেন সতেজ হয়ে ফিরেছে। নিভ্র মৌনিকে এবার কোলে তুলে নিয়ে নিচে জেনারেল ওয়ার্ডে বসে পড়ে। এই পাশটাতে মানুষজন একটু কম। কলকল পানির শব্দ তরঙ্গ এই রাতটিকে বেশ মধুময় করে তুলছে।
আচ্ছা এই মেয়েটার হুট করে তার জীবন নাড়িয়ে দেওয়াটা কি কি নিভ্রর স্বাভাবিকভাবে নেওয়া উচিত? একজন সাইক্রেটিস্ট হিসেবে এমন অনেক মেয়ের চিকিৎসা করেছে সে। কিন্ত এই মেয়েটা ভিন্ন। একেবারেই ভিন্ন। নিভ্রর মাথা কাজ করছে না। তবে সে এতটুকু জানে এই মেয়েটাকে সে একা ছাড়তে পারবে না। হোক তা মানবতার কারনে ; অথবা হৃদয়ের কারনে। কিন্ত এই মেয়েটার মধ্যে একটা চাপা ভয় আছে। মেয়েটা যেহেতু স্বেচ্ছায় তার কাছে এসেছে তাই নিভ্র ওকে ফিরিয়ে দেবে না।
.
নিভ্র বুঝতে পারছে ওর বুকের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে মেয়েটা আরও গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে তাই এভাবেই মৌনিকে নিয়ে আনমনে চোখ বন্ধ করে সে। অপেক্ষা করতে থাকে আগামী দিনের নতুন গল্পের।
.
.
.
.
.
~চলবে
#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
সূচনা পর্ব
.
[সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লিখা শুরু করলাম এই গল্পটি। প্রথম পর্বটি পড়ে কেমন লাগনো জানাবেন। আপনাদের প্রিয় গল্প হিসেবে এই গল্পটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ইনশাল্লাহ আপনাদের ভালোলাগবে।]