#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব:৮ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
১৩.মৌনি নিজের চোখ একবার বন্ধ করছে তো একবার খুলছে। না , নিভ্রর বুকেই সে লেপ্টে আছে। কপালের মধ্যে বারবার আছড়ে পড়ছে নিভ্রর উত্তাল নিঃশ্বাস। মৌনি দুর্বল চোখে চারিদিকে তাকায়। নিভ্রর রুমে সে। মৌনির পুনরায় মনে পড়ে অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তগুলো। অভিমানটা একপ্রকার চাড়া দিয়ে উঠতেই মৌনি সরে আসতে চায় কিন্ত বাধাঁ দেয় নিভ্র। নিভ্রর একহাত মৌনির চুলে বিচরণ করছে আর অন্যহাত দিয়ে আগলে রেখেছে ওর বাহু। তাই মৌনি চাইলেও নড়তে পারলো না। মৌনির মস্তিষ্ক বলছে এককথা কিন্ত মন বলছে অন্যকথা। তবুও মনমস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করে নিভ্রকে সে বললো………..
—নিভ্র ভাই ! আমায় ছাড়ুন।
—হুসসসস। একটা কথাও বলবে না তুমি। যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। এমনিতেও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। শরীরেও কেমন যেন জ্বরজ্বর ভাব। মনে হয় জ্বর আসবে।
নিভ্রর বুকে মাথা রেখেই মৌনি ড্যাবড্যাব চোখ করে তাকিয়ে আছে নিভ্রর দিকে। সন্ধ্যা হয়েছে। ঘরের মৃদু আলোতে নিভ্রকে দেখা যাচ্ছে বেশ ক্লান্ত। চোখে-মুখেও কেমন যেন অস্থির একটা ভাব। মৌনি একবার ভাবলো এই অস্থিরতা টা কি মৌনির জন্য। পরক্ষণেই নিজের উদ্ভট চিন্তা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। মৌনি নিশ্চিত যে নিভ্রর মতো ছেলে কখনোই ওকে ভালোবাসতে পারবে না। এতদিন ও একটা ভুল ধারনা পোষণ করে রেখেছিলো।
মৌনি নিভ্রর কথার কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে সরে আসে নিভ্রর কাছ থেকে। মৌনির হঠাৎ এমন করাতে নিভ্র কিছুটা অবাক। তবুও মৌনিকে কিছু বলেনা। কারন নিভ্র বুঝতে পেরেছে যে মৌনি ওর মানসিক রোগটির কথা জেনে গিয়েছে।মৌনিকে না জানানোর কারনে ওর এরকম করাটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়।
—এখন কেমন লাগছে তোমার?
নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো নিভ্র।
—কিছুটা ভালো। তবে কতক্ষণ থাকবো জানিনা।
মৌনির মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। চোখ-মুখ হয়ে গিয়েছে লাল।নিভ্র মৌনির কথার পরোয়া না করে কপালে গালে উল্টো করে হাত স্পর্শ করলো।
—রেস্ট নাও তুমি। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তোমার।
এবার মৌনির রাগটা চাড়া দিয়ে ওঠে। দুর্বল পায়েই তড়িঘড়ি করে সরে আসে নিভ্রর কাছ থেকে। উচ্চস্বরে বলে ওঠে………..
.
—সমস্যা কি আপনার?বারবার এত কাছে আসেন কেন?কি প্রমাণ করতে চান আপনি একজন ভালো ডক্টর?ইউ নো হোয়াট সাইক্রেটিস্ট হওয়ার সাথে আপনি একজন মাইন্ড গেমার। খুব সহজেই আমায় কাবু করে নিয়েছিলেন আপনি। কিন্ত আর না। আমি চলে যাবো । চলে যাবো এখান থেকে।
.
—What rubbish? এসব কি বলছো তুমি?
.
একথা বলেই নিভ্র এগিয়ে আসার চেষ্টা করে । কিন্ত মৌনির অস্থির হয়ে গিয়েছে। নিভ্রকে নিজের কাছে অনুভব করলেই ওর হৃদস্পন্দন যেন দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। নিভ্রর কথাবার্তা , বাচনভঙ্গি সবকিছুই মৌনিকে বেশ আকর্ষণ করতো। কিন্ত নিভ্র নামের এই ছেলেটার মায়ায় সে আর পড়বে না। আর দগ্ধ হতে পারবে না নিভ্রর জন্য। তাই ওর এগিয়ে আসা থামার জন্য নিভ্র টেবিল থেকে একটা ছুড়ি নিয়ে নেয়। পাগলের মতো করে বলতে থাকে………..
—খবরদার ! খবরদার আমার কাছে আর আসবেন না। আমি নাহলে………
.
—শান্ত হও মৌনি! ছুড়িটা রাখো।
.
—না। আ-আমি রাখবো না। আপনি কাছে আসলে আমি কিন্ত আঘাত করে বসবো নিভ্র ভাই। প-প্লিজ দূ-দূরে সরেন।
.
মৌনিকে এতটা অস্থির হতে দেখে কপালে ভাজ পড়ে নিভ্রর। কিন্ত এখন চিন্তিত হওয়ার সময় না। বেশ কায়দা করেই মৌনিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে। নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া হালকা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয় সে। শীতল কন্ঠে মৌনিকে বললো…….
—মৌনি? আমি তো তোমার শুভাকাঙ্খী ; তাই না ! তুমি তাহলে আমার দূরে সরে যেতে বলছো কেনো? আমরা সবসময় একসাথে থাকবো।
—আপনি মিথ্যে বলছেন। আমি জানি আমি অসুস্থ। আমি সুস্থ হয়ে গেলে আপনি চলে যাবেন নিভ্র ভাই। আ-আর আমার কাছে আসবেন না।
.
মৌনির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এদিকে বাহিরে চলছে তুমুল গতিতে ঝড়ো হাওয়া যার কারনে বারবার লোডশেডিং হচ্ছে । বাড়িতে নিভ্র আর মৌনি ছাড়া আর কেউই নেই।রুমের বড় টিভির স্ক্রিনে চোখ যেতেই মৌনির বুকটা আচমকা ধক করে উঠলো। সে ভুল দেখছে না তো? টিভির পর্দায় স্পষ্ট জহির শেখকে দেখা যাচ্ছে যে হলো ফেক সার্টিফিকেটের mastermind, সারা বাংলাদেশের এই কালো কাজের মূল নিয়ন্ত্রণ করে এই জহির শেখ আর এসব কিছুর দেখাশোনা করছে তাই ছেলে রিদান শেখ। সেদিনের বৃষ্টির রাতটা বারবার ভেসে ওঠছে ওর চোখের সামনে । বারবার ভেসে ওঠছে রিদানের সেই কামনার চাহিনী। তবে কি নিভ্রও……….না না ; নিভ্র কেন এমন করবে?
.
পুনরায় ভয় জেকে বসলো মৌনির মনে। নিভ্র খেয়াল করলো মৌনি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে টিভি স্ক্রিনে । একজন বৃদ্ধ বয়স্ক লোককে ইন্টারভিউ দেখতে দেখা যাচ্ছে। মৌনির হাত থেকে ছুড়ি টি পড়ে যায়। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে এসেছে। নিভ্র আর সময় ব্যয় না করে মৌনির কাছে এগিয়ে আসলো। মৌনি অস্থির হয়ে নিভ্রর বুকে মিশে চিৎকার করে কাদতে থাকে। অনুনয়ের স্বরে বারবার বলছে……..
—নিভ্র ভাই ! আমাকে বাঁচান। ওই রিদান কুড়ে কুড়ে খাবে আমাকে। আমি মরে যাবো নিভ্র ভাই। আমি এত ধকল আর নিতে পারবো না।
নিভ্র মৌনিকে নিজের সাথে মিশিয়ে চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। অন্য কেউ হলে নিভ্র যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতো। কিন্ত এই মেয়েটির বেলায় তা করতে পারছে না।
—কান্না করো না মৌনি। কেউ কিছু করবে না তোমার। আমি আছি তো !
—সত্যি আপনি থাকবেন তো?
—এই মৌনিপরী ছাড়া নিভ্রও অচল হয়ে যাবে মৌনি। কথা দিচ্ছি কখনোই তোমার থেকে আমি হারিয়ে যাবো না।
—মিথ্যে কথা। আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি আমায় স্বাভাবিক করার জন্য এসব বলেন। আমি জানি। কিন্ত নিভ্র ভাই , আপনার প্রতিটা কাজেই মাতোয়ারা হয়ে পড়ি আমি। আমার ভয় হয় নিভ্র ভাই আপনার থেকে দূরে আমি থাকতে পারবো না। কখনোই পারবো না।
.
অস্থির হয়ে কথাগুলো বলছে মৌনি। নিভ্র এবার আলতো করে মৌনির কপালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে। সাথে সাথেই মৌনি হয়ে যায় শান্ত। একেবারে নাবালিকার মতো। নিভ্র একহাতে আগলে ধরে ওর গাল। মোহ কন্ঠে বললো……….
.
—বিশ্বাস করো মৌনি , আমি কখনোই তোমার থেকে দূরে যাবো না। সবসময় তোমার সাথে থাকবো। তোমার হৃদয়ের সিন্ধুপাড় হিসেবে থাকবো। আর তুমি থাকবে নিভ্রর হৃদয়ের মৌনিপরী হয়ে।
মৌনি বাচ্চাদের মতো মিশে যায় নিভ্রর বুকে। জ্বরে গা বেশ গরম হয়ে আছে। নিভ্রর শীতল দেহে ক্রমাগত ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে উষ্ণতা।
.
.
।।
—ওস্তাদ ! মেয়েটার খোঁজ পেয়ে গিয়েছি।
.
রিদান এবার সরে আসলো মদের বোতলের কাছ থেকে। এতক্ষণ বোতলের চুমুকের সাথে অন্য দুনিয়ায় গুম হয়ে গিয়েছিলো। আর এরকম সময়ে কোনো গার্ড আসলে বরাবরই বিরক্ত হয় সে। কখনও কখনও শ্যুট করতেও তো দুবার ভাবতো না। কিন্ত এবারের ঘটনাটা ভিন্ন। গুপ্তচর সেখানে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপলেও রিদানের ফর্সা মুখে ফুটে ওঠলো এক বাকা হাসি। নিজের ট্রিম করা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠলো…….
.
—কোথায়?
—চট্টগ্রামে আছে ওস্তাদ।
—সব ব্যবস্থা কর। আজই চট্টগ্রামের জন্য রওনা দেবো। বাবাকে খবর দে যে মেয়েটারে পেয়ে গিয়েছি। বাবা পেয়ে যাবে তার কাঙ্খিত পেনড্রাইভ আর আমি সেই মেয়ে ! Go ahed……
.
গুপ্তচর চলে যেতেই চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দেয় রিদান। গার্ডরা ওর হিংস্রতা দেখে ভয়ে কাপাকাপি করলেও মেয়েরা ওর জন্য পাগল। আর এরকম সুযোগ কখনোই মিস করার পরিকল্পনা করে না রিদান। কোটিপতি বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান যাকে বলে। রিদান তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে………
.
—মৌনি ! মৌনি ! মৌনি ! তোমার উড়াউড়ি শেষ। বড্ড জালিয়েছো আমাকে। তোমার নির্মম মৃত্যু না দেখা পর্যন্ত আমার আর ঘুম হবে না।আসছি আমি………
.
.
.
১৪.
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বর্ষার মৌসুমে চট্টগ্রামে হুটহাট এমন বৃষ্টির দেখাটা বেশ স্বাভাবিক এক ব্যাপার। বারান্দার বেতের সোফাটিতে বসে নিভ্র একমনে সে দৃশ্যু উপভোগ করছে । আর ওর বুকের ওপর গা এলিয়ে শুয়ে আছে মৌনি। মৌনির দৃষ্টি দুর্বল। চোখ দুটো জ্বরের ভারে নুয়ে পড়ছে ওর। নিভ্র ওকে বারবার রুমে নিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্ত নাছোড়বান্দা মৌনি এক ইঞ্চিও নড়বে না এই ছেলেটার কোল থেকে। নিভ্র একটু জোর করতে নিলেই নিভ্রর হাতে খামচি মেরে বসে। জ্বরের কবলে বিড়াল যেনো বাঘিনী হয়ে গিয়েছে।
.
—মৌনি?
—হুমম।
—এখন তো চলো। জ্বরে তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
—আপনার ডাক্তারগিরি অন্যদের সামনে দেখান। তিতুন-নিতুনের বাচ্চার মা’র ওপর দেখাবেন না।
ভ্রু কুচকে ফেলে নিভ্র। অবাক স্বরে বললো….
—তিতুন-নিতুন আবার কে?
—কেন আমার আগামী বেবি ?
—তাদের বাবা কে হবে?
—আপনি হবেন তাদের বাবা। আমি ওদের বলে দেবো আপাকে বাবা বলে ডাকতে। নাকি ডাক্তারসাহেব বলতে বলবো?
মৌনির বোকা বোকা কথা শুনে নিভ্র মুখ টিপে হাসে। বেশ মজা লাগছে যেন কথাগুলো শুনে।
—আমি কি বিয়ে করেছি যে আমায় বাবা বলবে?
—কেনো ; আমি আছি না ! আমি হবো আপনার বউ।নিভ্রর মৌনিপরী।
—হুম হয়েছে। মাথাটা গিয়েছে তোমার। এখন ঘুমাতে চলো। আবার বাঘিনীর মতো খামচি দিয়ে বসোনা।
.
নিভ্র আস্তে করে মৌনিকে কোলে তুলে ভেতরে প্রবেশ করে। বাইরের তুলনায় ভেতরে কিছুটা অন্ধকার। মৌনি নিভ্রর গলায় দুহাত জরিয়ে আকিবুকি করে চলছে নিভ্রর বুকে। তবে চোখের দৃষ্টি কিছুটা ভারী। মৌনিকে খাটে শুয়িয়ে নিভ্র আর উঠতে পারলো না। কেননা মৌনির নিভ্রর গলা এখনও জরিয়ে আছে।
মৌনির নিঃশ্বাস কিছুটা ভারী। শরীরের উষ্ণতার সাথে নিঃশ্বাস যেন যুদ্ধ করে চলছে কে বেশি উষ্ণ হতে পারে। নিভ্র ওর দুর্বল চোখে দেখতে পারছে কিছু নির্মল আকুতি। মৌনি নেশাক্ত কন্ঠে বললো……..
.
.
—আই ওয়ান্ট টু কিস ইউর লিপস নিভ্র ভাই।
.
.
.
~চলবে
শুরুতে যেমন ঝড়ের গতিতে সাড়া পেয়েছিলাম তেমনটা এখন না হওয়াতে কিছুটা মন খারাপ। হয়তো গল্পটা অনেকের ভালোলাগছে না । তবুও যারা আছেন তাদের গঠনমূলক কমেন্টের মাধ্যমে লেখালেখিটার আগ্রহ বাড়ে। যারা পড়ছেন আজকের পর্বটা সবার ভালোলাগবে ইনশাল্লাহ।
part 7 https://www.facebook.com/kayanaAfrin/posts/208435664411472