#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব: ২
৩.
টেউয়ের তালে কারও শরীরের উষ্ণতা মৌনি প্রবলভাবে অনুভব করতে পারছে।কেউ তাকে বুকের ঠিক বা পাশে পরম আদরে আগলে রাখার কারনে টেউলের তালে সেই আগন্তুকের হৃদয়ের শব্দ যেন চমৎকার সুর সৃষ্টি করেছে। মৌনির কাছে বিষয়টা কোনো ভ্রমের মতো লাগলো। তীর্যকভাবে সূর্যরশ্মিটি মুখে পড়াতে আনমনে চোখ খুলে সে।পরিস্থিতিটা অন্যরকম। নিভ্র নামের সেই ছেলেটা তাকে একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই যেন সে হারিয়ে যাবে। মৌনিকে পিটপিট করে তাকাতে দেখে নিভ্র উৎসুক চোখে তাকায় ওর দিকে। মায়াবী কন্ঠে বলে ওঠে………..
.
—এখন কেমন লাগছে তোমার?
নিভ্রর মায়াবী কন্ঠ শুনে মৌনির যেন ঘোর লেগে গিয়েছে। ছেলেটার কন্ঠে আসলেই জাদু আছে মনে হয়। নাহলে এত সুন্দর,নিখুঁত কিভাবে কারও গলা হতে পারে!নিভ্রর বুক থেকে সরে আসে সে। ঘুমের রেশটি এখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো….
.
—এখন একটু ভালো লাগছে।
—এই নাও। পানির বোতল। মুখটা ধুয়ে নিলে শরীরটা হালকা হয়ে আসবে।
নিভ্র থেকে পানির বোতলটি নিয়ে মৌনি এবার মুখটা ধুয়ে ফেলে। আসলেই মুখ ধোয়ার পর নিজেকে খুব সতেজ অনুভব করতে পারছে মৌনি।
আশেপাশে যেদিকেই তাকাচ্ছে চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। সেই পানির মধ্যেই বয়ে চলছে অনেকগুলো জাহাজ, স্টীমার আর লঞ্চ। মৌনির হঠাৎ একটু অদ্ভুদ অনুভব হতে শুরু করলো। গতকাল ঘোরের মধ্যে তো সে বোকার মতো একটা অপরিচিত ছেলের সাথে যেতে চাইলো। কিন্ত কাজটা কি ঠিক করেছে? মৌনি এবার পুনরায় তাকায় নিভ্রর দিকে। নিভ্র ব্যাগ থেকে কিছু কেক আর বিস্কুট বের করছে। মৌনির দিকে না তাকিয়েই সে বলে………
.
—খাবারগুলো খেয়ে নাও। এমনিতেও শরীর তোমার অনেক দুর্বল।
.
—আ-আসলে কিছু কথা ছিলো।
.
—বলো।
.
—আসলে । আমরা এখন কোথায়? আর কতক্ষণই বা লাগবে?
.
—চট্টগ্রাম বন্দরের সীমান্তে এসে পড়েছি বলতে পারো। এটা প্যাসেন্জার লঞ্চ না তো তাই যেতে আরও দ্রুত সময় লাগবে।
.
—ওহ!
মৌনির আরও কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলো। কিন্ত পেটে তার ক্ষুধা চাড়া দিয়ে বসেছে। তাই নিভ্রর সাথে বসে হালকা খাবার খেয়ে নেয় সে। মৌনির কাছে সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুদ মনে হচ্ছে। খুবই অদ্ভুদ। এই গুরুগম্ভীর যুবকের মায়াবী চরিত্রটা তার বুঝার বাইরে।। কারন মৌনির তাকে বেশি কিছু বলতে হচ্ছেনা। নিভ্র যেন সবই বুঝে যায় ওর মনের কথা। কোনো সুপার পাওয়ার আছে নাকি!
.
—আপনার কাছে কি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা আছে ভাইয়া?
.
মৌনির প্রশ্ন শুনে নিভ্র সেদিকে তাকায়। মৌনির ফ্যালফ্যাল চাহিনী দেখে নিভ্রর বেশ মজা লাগছে। অবাক স্বরে সে ওকে প্রশ্ন করলো……
.
—এমন কেন মনে হলো তোমার?
.
—আপনি যেভাবে আমার সব সমস্যার কথা বুঝছেন সেভাবে একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
.
নিভ্র আলতো হাসে।যারা সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা করে ওদের মনে কৌতুহলটা অনেক বেশিই থাকে। সিটে হেলান দিয়ে নিভ্র বললো……..
.
—তোমার মতো ইয়াং এজ সহ টিনএজের হাজারো ছেলেমেয়েদের ট্রিটমেন্ট করেছি আমি। বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক না!
.
—মানে? (কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে) আপনি সাইক্রেটিস্ট নাকি?
.
—জ্বী ম্যাডাম। তাছাড়া সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে নিউ নিউ লেকচারার হিসেবেও জয়েন হয়েছি।
.
মৌনি হতবিধহধস্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নিভ্রর দিকে। এই ছেলে একজন সাইক্রেস্টিস্ট তা ওর ধারনার বাইরে ছিলো। আর ওর মতো সামান্য একজন মেয়ের বিপদে কত সুন্দরভাবেই না পাশে দাঁড়িয়েছিলো সে।
,
—কি হলো? কি ভাবছো ?
.
—না। তেমন কিছু না।
.
.
.
৪.
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। দেশের সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র বন্দরের মধ্যে এটা একটা।মৌনি অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে এই বন্দরটিকে। লঞ্চ ইতিমধ্যে বন্দরে ভীড়তে ব্যস্ত।মৌনি এই প্রথম চট্টগ্রামে এসেছে।তবে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে ওর জানা ছিলো স্কুলজীবন থেকেই। জাহাজ নির্মান শিল্পের জন্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দরের নাম।হালিশহর, পতেঙ্গায় দেশীয় শিল্পীর কতৃত্বে অনেকগুলো জাহাজ নির্মান কারখানা যা এখনও আছে কি-না মৌনি তা জানেনা।
আকাশটা এখন বেশ পরিষ্কার। ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলা হয়….”Sunny weather”। নীল আকাশের স্বচ্ছতাটা পানির সাথে একেবারেই যেন মিলে গিয়েছে।
.
মৌনির এতটা অবাক হওয়া দেখে নিভ্র আলতো হাসে। মেয়েটা সম্ভবত নতুন কোনো বিষয়কে গভীরভাবে আগলে রাখতে ভালোবাসে। মিহি কন্ঠে বলে ওঠে……..
.
—Welcome to our district………মৌনি!
.
নিভ্রর মিহি কন্ঠ শুনে মৌনির শিরা-উপশিরা দিয়ে যেন ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো। বন্দরের এই সৌন্দর্য থেকে নিভ্রর কাছে ওর নামটি শুনে অন্যরকম লাগছে। এই ছেলেটা খুবই মিশুক। সবার সাথেই নিজের হাস্যোজ্জল মুখ দিয়ে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে। মৌনি আলতো স্বরে বলে….
.
—ধন্যবাদ।
.
—তো এখন চলো। আমরা নেমে পড়ি ।
.
—হুম…..
.
একথাটা বলে মৌনি উঠতে নিলেই আচমকা ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। পায়ের গোড়ালি চেপে বসে পড়ে নিজের যায়গায়। নিভ্র এবার কিছুটা শঙ্কায় পড়ে গিয়েছে মৌনির কাতরতা দেখে। ওর কাছে হাটু গেড়ে বসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পায়ের গোড়ালি দেখতে। গুলির স্থানটির তুলোর পট্টি খুলে দেখে শুকনো ঘা টি পুনরায় রক্ত দিয়ে ভিজে উঠেছে। নিভ্র এবার খুব সাবধানতার সাথে ব্যাগ থেকে একটা কিট বের করে ঘা এর স্থানটি পরিষ্কার করতে থাকে। নিভ্র কোমলভাবে সেই স্থানটি বারবার তুলো দিয়ে পরিষ্কার করছে যাতে মৌনি সামন্য ব্যথাও যেন অনুভব করতে না পারে।
ক্ষত স্থানটিতে স্যাভলন চেপে ধরতেই মৌনি অস্ফুটস্বরে গোঙিয়ে উঠে। যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সে ক্ষতটি। নিভ্রর হাত চেপে কাতরতার সাথে বলে……
.
—আমার খুব ব্যথা করছে নিভ্র ভাই।
.
নিভ্র সাথে সাথেই নিজের হাত থামিয়ে দেয়। মৌনির ব্যথাটা সে যেন সহ্য করতে পারছে না। নিজের কাছেই ব্যাপারটা বেশ আজব মনে হচ্ছে নিভ্রর কাছে। ওদের ট্রেনিংয়ের সময় বারবার বলে দেওয়া হয় পেশেন্ট যতই তোমার কাছের সম্পর্কের হোক না কেন ; তোমাকে প্যাশনেটভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে ; ইমোশনালভাবে নয়।
আর এই বিষয়টি মাথায় রেখে বহু মানুষের ট্রিটমেন্ট করেছে। কেউ কেউ ড্রাগ নেওয়ার জন্য ছটফট করতো……..কেউ আবার বারবার সুসাইড করতে চাইতো……..কেউ কেউ ”নেক্রোফিলিয়া” র মতো ভয়াবহ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতমানুষের সাথে যৌনসঙ্গম করতে চাইতো এমন সব ক্রিটিক্যাল কেসগুলোতে পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট পাষাণ হৃদয় নিয়ে করেছে সে। আর আজ একটি মেয়ের সামান্য কাতরতা ওর সহ্য হলো না?
.
—রিলেক্স ! আমি আর টাচ করবো না। তবে তুলোটা বেধে দেই। এটলিস্ট কোনো ইনফেকশন হবে না।
.
—আচ্ছা ।
.
.
.
৫.
চায়ের স্টলে বসে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে সবাই নিভ্রর জন্য। আজ অনেকদিন পর ওদের জানের দোস্ত নিভ্র ফিরে আসছে। নিশু এবার ফোস ফোস করে তুর্যকে বললো………..
.
—কিরে তুর্য ? নিভ্রটায় এখনো আসছে না কেন?এদিকে ওর জন্য রোদে দাঁড়িয়ে আমার স্কিন পুড়ে যাচ্ছে।
.
নিশুর কথা শুনে বিরক্ত হয় সোহান। ব্যঙ্গ সুরে বলে…..
.
—এল্লেগাই মাইয়্যা মানুষরে আমি নিয়া আসতে চাইনা যতই আমাগো দোস্তো হোক না কেন? আরে ওই ছেমড়ী ? আজকে কতদিন পর আমাদের দোস্ত আসবো তাই তুই আছোস তোর বদনা মার্কা চামড়া নিয়া?
.
—এক থাপ্পড়ে তোর সবকটা দাঁত আমি ফালায়া দিবো ব্যাটা? আমার স্কিনকে তুই বদনামার্কা চামড়া বলিস কোন সাহসে?
.
—আল্লাহর ওয়াস্তে একটু থামবি তোরা?
লিজা কটাক্ষ গলায় বলে। লিজার রাগ সম্পর্কে সবাই ভালোমতো জানে তাই সোহান আর নিশু চুপ হয়ে গেলো।
.
—ওই দেখ্ । নিভ্র আসতেছে। (তুর্য)
নিভ্র সামনে আসতে আসতেই যেন সবাই বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে যায়। ওরা ভুল দেখছে নাতো। নিভ্রর পিঠে পাতলা গড়নের একটি যুবতী চড়ে আছে। মেয়েটার দুটো হাত নিভ্রর কাঁধ আর গলা জড়ানো। অন্য সবার কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক হলেও ওদের দুজনের কাছে ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক লাগছে। সোহান মিশুর দিকে না তাকিয়েই বললো……..
.
—ওই নিশু? তুই না আমারে থাপ্পড় দিতে চাইছিলি? জলদি থাপ্পড় দে। আমি বুঝতে চাই কোনো ভুল কিছু দেখছি কি-না।
.
—না-রে সোহান………..আমরা সবাই ঠিকই দেখছি……।
.
—এর মানে ওর পিঠে সত্যিই মনে হয় কোনো পরীর আছড় চেপে বসেছে। কত্ত সুন্দর একটা পরী। ওই পরীটা ওই পাগলের ডাক্তারের (নিভ্রর) পিঠে ভর করলো কেনো………আমি আছি না ! কত্ত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আমি!
.
সোহানের কদু মাথা যে পুরাই গেসে সবাই তা বুঝতে পারলো। এরে এখন সত্যিই নিভ্র কে দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে । তবে সবার মনেই একটা প্রশ্ন জাগছে……….নিভ্রর সাথে এই মেয়েটি কে?
.
.
.
.
.
~চলবে
ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আজকের পর্বটা অনেক সময় নিয়ে লিখেছি। আপনাদের পর্বটি ভালো লাগবে ইনশাল্লাহ।