হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕 পর্ব ১৪ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক] #কায়ানাত_আফরিন

0
101

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৪ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২২. জোৎস্নার অপরূপ ছায়ার সমারোহে আলোকিত হয়েছে চারিপাশ। চলন্ত ট্রাকে চড়ে মৌনি আর নিভ্র আপনমনে সে দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। দুধারে দিগন্তজোড়া বিস্তৃত প্রান্তর ; মাঝখান দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাওয়া ট্রাক।অনুভূতিটাই অন্যরকম। ক্ষণে ক্ষণে ট্রাকের পাশ দিয়ে গাড়ি বাসও চলে যাচ্ছে নিজ গতিতে। মৌনির কাছে সব কিছু কেমন যেন বিস্ময়ের মতো লাগছে। মৌনি জীবনেও কল্পনা করতে পারেনি এত গহীন রাতে কোনো একটি ছেলের সাথে সে এভাবে ট্রাক জার্নি করবে। কৌতুহলতার গাছটি যেন আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। নিভ্র এবার চিৎ হয়ে বস্তার ওপর শুয়ে পড়লো। চোখে-মুখে যেন প্রাণোচ্ছলতার খেলা। নিভ্র ইশারায় মৌনিকে বলে নিভ্র পাশে বস্তার ওপর শুয়ে পড়তে। কিন্ত মৌনি প্রথমে দ্বিধা জানায়। একে তো বস্তাগুলো বেশ ময়লা দেখাচ্ছে আবার নিভ্রর পাশে শুতেও অন্যরকম লাগছে। যদিও এর আগে নিভ্রর সাথে বেশ দূরত্ব নিয়ে শুয়েছিলো। কিন্ত তখনকার ব্যাপার আর এ ব্যাপারটি অন্যরকম।
নিভ্র মৌনিকে আগের মতোই হাটুগেড়ে বসে থাকতে দেখে এবারওর হাত টান দিয়ে পাশে শুয়িয়ে দিলো। ঘটনাটি ঘটেছে হঠাৎ করে। তাই পরিস্থিতি মৌনি বুঝে উঠতে না পেরে বস্তায় শুয়ে পড়লেও মৌনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নিভ্রর দিকে। নিভ্র অপার বিস্ময়ের সাথে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে রয়েছে স্মিত হাসি। জোৎস্নার মায়াবী আলোর খেলায় নিভ্রকে এখন কোনো রাজপুত্র থেকে কম লাগছে না। রাজপুত্র যেমন ঘোড়া চড়ে তার প্রেয়সীকে নিয়ে যায় ; নিভ্র নিয়ে যাচ্ছে ট্রাকে করে। ব্যাপারটা ভিন্ন ধরনের বটে।
নিভ্র এবার মৌনির দিকে তাকাতেই দেখলো মৌনি ফ্যালফ্যাল চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিভ্র তাই ওর মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বললো………….
—এই যে ম্যাডাম ! আমায় দেখার জন্য এখনও দিন পড়ে আছে। এখন এই আকাশটির দিকে একবার তাকান তো !
নিভ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে মৌনিও তাকালো খোলা আকাশের দিকে। তাকাতেই সে যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। এ তো কোনো আসমান না যেনো এক মায়াস্বর্গ। নিশিরাতের এই গুমোট পরিবেশে মনমাতানো জোছনার আমেজে চারিদিক হয়ে উঠেছে প্রাণমুখর। মৌনি অস্পষ্টস্বরে বলে ওঠলো…………
—মাশাল্লাহ !
.
মৌনির জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সে কখনও ভাবেনি যে নিশিরাতে এভাবে খোলা আকাশের অভূতপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। নিভ্র উদাসীনভাবে মৌনির দিকে মনোনিবেশ করে। মেয়েটার মায়াবী মুখে টানটান উত্তেজনা। হাসিটি যেন মুক্তার মতো ঝরে পড়ছে। নিভ্র এবার বললো………
—মানুষকে অবাক করতে আমার বড্ড বেশি ভালোলাগে।
—তো সেই ভালোলাগাটা পরিহার করেন। এখন থেকে আপনি শুধু আমাকে অবাক করবে। অন্য কাউকে না।
—কেন?
.
মৌনি এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলো। নিভ্রর ”কেন” শুনে মৌনি এবার নিভ্রর সাথে ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। নিভ্র এখনও কিছুটা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আছে। মৌনি তা দেখে নিভ্রর কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে নেয়। তারপর বললো………..
—কারন। আপনার অবাক করার মতো অস্বাভাবিক গুণের প্রেমেই আমি প্রথমে পড়েছিলাম। আপনি এমন একজন মানুষ যে সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। আকৃষ্ট করতে পারে নিজের দক্ষতা দিয়ে। এখন যদি অন্য মেয়েরাও আপনার প্রেমে পড়ে বিড়ালের মতো আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ; তবে আমার কি হবে? আপনি শুধু আমার মালাইয়ের কৌটা। অন্য করো জংলী বিড়ালকে আমার মালাইয়ের কৌটার কাছে ঘেঁষতে দিবো না।
.
মৌনির নির্লিপ্ত কন্ঠ শুনে নিভ্র কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে। নিজেকে মালাইয়ের কৌটার সাথে তুলনা করা দেখে নিভ্র হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না।
—নিভ্র ভাই !
—হুমমম !
—আপনি কি আমার মতোই প্রথম এমন জোছনা উপভোগ করছেন?
—না।আমার এটা কত নম্বর অভিজ্ঞতা তা আমার জানা নেই।
—এর আগেও তবে উপভোগ করেছিলেন?
—অনেক । তবে যেটা আমার স্মরণীয় হয়ে ছিলো সেটা হলো বান্দরবানের নীলগিরির সেই রাতটি। প্রায় দেড় বছর আগে আমি আমার ব্যাচমেটদের সাথে গিয়েছিলাম। সময়টা ছিলো শীতকাল। মেঘ আর কুয়াশা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে নিয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতাটা আমি কখনও মুখে বলতে পারবো না।
.
নিভ্রর চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে একরাশ প্রশান্তি। মৌনি তা দেখে মলিন হাসে। নিভ্রর মতো ওর জীবনটা এত সুন্দর ছিলো না। কঠিন সংগ্রাম করে ঢাকার মতো এক অচেনা শহরে পড়াশুনা চালিয়েছে সে। তার কোনো ফ্যামিলি পাওয়ার ছিলো না বিধায় পড়াশুনাসহ ছাত্রাবাসে থাকার ক্ষেত্রেও বাঁধা পড়েছে বিভিন্নভাবে। সাংবাদিকতা পেশাটা আজ অনেকের কাছেই হাস্যের ক্ষেত্র কিছু অসাধু সাংবাদিকদের মিথ্যে খবর প্রচারের ফলে। তবে মৌনি সেসব এড়িয়ে নিজের সর্বোস্ব দিয়ে পড়াশুনা চালিয়েছে।
—কি ভাবছো?
নিভ্রর ডাকে মৌনির ধ্যান ভাঙ্গে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে প্রতিউত্তরে বললো……….
—তেমন কিছু না। আমাদের যেতে আর কতক্ষণ লাগবে।
—উমমম। বলতে পারছি না। চিন্তা নেই ট্রাকওয়ালা মামা ঠিকঠাকমতো জায়গায় নামিয়ে দিবে। আর বাকি পথ তো তুমি জানো।
—হ্যাঁ।
.
.
দুজেই এখন নীরব। নিভ্র কি করছে মৌনি তা জানেনা তবে মৌনি অনুভব করছে নিভ্রর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের খেলাটি। মাঝে মাঝে তো মৌনির মনে হয় যে এটা অনুভব করতে করতেই মৌনি জীবন পার করে ফেলবে। এখন একটু ঠান্ডা লাগছে। একে তো হাওয়ার প্রকট তার ওপর গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশ বলে তাপমাত্রার নিম্নতা। নিভ্র সামনে মামার থেকে একটি চাদর নিয়ে মৌনির দিকে এগিয়ে দেয়। মৌনিও কোনো কথা না বলে চাদরটি নিজের গায়ে জরিয়ে নিলো। এখন একটু হলেও ঠান্ডা কম লাগবে। কিন্ত হঠাৎ মৌনি কি মনে করে নিভ্রর সাথে মিশে গিয়ে দুজনের ওপরই চাদরটা পেচিয়ে নিলো। নিভ্র কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছে মৌনির এরূপ আচরণে ।
—আরে ! এটা কি হলো?
—হুশশশ! একটা কথাও না। চাদরটা বড় আছে। অনায়াসেই আমাদের দুজনের হয়ে যাবে। তবে আমি একা পেচিয়ে রাখবো কেনো?
.
নিভ্র নীরব হয়ে যায়। কিছুটা অস্বস্তিতে ; কিছুটা দ্বিধায়। মৌনির এভাবে হুটহাট করে কাছে আসাটা নিভ্রকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। যত কিছুই হোক না কেন ; নিভ্র একজন যুবক । আশেপাশে এমন আবেদনময়ী যুবতী যদি নিজ থেকে কাছাকাছি এসে পড়ে যেকোনো ছেলে একটুর জন্য হলেও নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। নিভ্র একটা লম্বা শ্বাস নিলো। এসব কু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করতে হবে। মৌনি একহাত দিয়ে নিভ্রর বাহু জরিয়ে রেখেছে। হঠাৎ মৌনি বলে ওঠলো……..
—আমি সত্যিই কি কখনও আপনাকে ভুলে যাবো?
.
এমন প্রশ্নে নিভ্র কিছুটা অবাক। সবকিছু তো ঠিকঠাকই ছিলো তবে হুট করে মৌনির মাথায় এ প্রশ্ন কেনো আসলো এটা নিভ্র ভেবে পেলো না। ঠোঁটে একটি স্মিত হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো নিভ্র বললো…………
—কি মনে তোমার?
—আমার মনে হয় ভুলে যাবো।
—কেনো?
—আমার Disorder এর কারনে………
—থামো।
মৌনির কথার মাঝখানেই নিভ্র মৌনিকে থামিয়ে দেয়। বাতাসের দাপটের কারনে মৌনির কেমন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু। নিভ্র এবার মৌনির দিকে কোমল চোঁখে তাকায়। ঠোঁটদুটো হালকা নাড়িয়ে বলে উঠলো…………
—মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বড় আর শক্তিশালী উপায় কি জানো? তোমার রোগটিকে ভুলে যাওয়া। সাধারনত ডাক্তাররা অন্য রোগের ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার জন্য বারবার বিষয়টিকে মনে রাখার জন্য বলে। কিন্ত সাইক্রেটিস্ট ডিপার্টমেন্টটি অন্য মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে যেমন ভিন্ন ; তেমনি ট্রিটমেন্টও ভিন্ন।
তাই তুমি সবসময় মনে করবে তুমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। এখন তুমি যদি তোমার রোগের জন্য চারিদিক থেকে নিজেকে বদ্ধ করে রাখো তবে তোমায় কষ্ট তাড়া দিবে। তুমি বাধ্য হবে তোমার স্মৃতিগুলো ভুলতে। এখনকার উদাহরণটাই দেই। এইতো এতক্ষণ আমার সাথে দিব্যি ছিলে আর হঠাৎ তোমার মনে হলো ”আরে ! তুমি তো স্বাভাবিক না” ।ব্যাস ! দুঃখ আর মানসিক যন্ত্রনাটি তোমার তাড়া দিয়ে দিলো। তাই আমি একটাই কথা বলবো ; যতই তোমার সমস্যা থাকুক না কেন ; তুমি তা ভুলে থেকে লাইফটা ইন্জয় করার চেষ্টা করবে। অতীত মানুষের জীবনে ভালো-খারাপ দুটোই হতে পারে । তবে উপভোগ কখনও খারাপ হতে পারে না। জীবনে অভিজ্ঞতা যত বেশি থাকবে জীবন সেসব কঠিন স্মৃতি ভুলে যাবে। আর তোমার কথা শুনলেই বোঝা যায় যে তুমি একটা লম্বা সময় ফ্যালিলির সাথে স্পেন্ড করোনা। তাই তোমায় কুমিল্লায় তোমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।
.
নিভ্রর কথার রাজ্যে মৌনি এতক্ষণ যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো। এসব বিষয় নিয়ে কখনোই সে গভীরভাবে চিন্তা করেনি তাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে নিভ্রর কথাগুলো সে ভাবতে থাকে। বিষয়টা আসলেই সত্যি……..”Mind is related with heart & soul” অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্ক হৃদয় আর আত্নার অধীনে থাকে। নিভ্র নামের এই ছেলেটা যেমন ঝড় হয়ে ওর জীবনে এসেছিলো তেমনি বৃষ্টির মতো এখন ওর জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছে জ্ঞান। নিভ্রর কাছেই মৌনি ভালোবাসার সংজ্ঞা শিখেছে , শিখেছে উপভোগ মানে কি , আনন্দে থাকা মানে কি।
মৌনির কাছে সবকিছু অনেক সুন্দর লাগছে শুধুমাত্র এই নিভ্রর কারনে। এই নিভ্র হারিয়ে গেলে ওর জীবনের অস্তিত্বও হয়তো মৌনি হারিয়ে ফেলবে। আচমকা মৌনি বললো……
.
—নিভ্র ভাই ! তোমার কথার ছলে আমি একদিন মনে হয় হারিয়েই যাবো।
নিভ্র আলতো হেসে বলে……..
—মোটেও না। এই নিভ্রর শিরায় উপশিরায় মৌনির বিচরণ থাকবে।
.
নিভ্র এই কথাগুলো মৌনির খুব কাছে এসে বললো। যার দরুন নিভ্রর উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো মৌনি। নিভ্রর সংস্পর্শটা ওর হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। নিভ্র নিজের মাতাল করা চাহিনীর সাথে এক নতুন অনুভূতির সংস্পর্শ দিলো যেনো। সবজায়গায় অজান্তেই ও নিভ্রকে অনুভব করতে পারছে। মানসিক রোগটা কখনও মৌনির কাছ থেকে যাবে কি-না এ ব্যাপারে ও অনিশ্চিত তবে নিভ্র নামক এই প্রেমরোগে মৌনি আজীবন ভুগতে চায়। অনুভব করতে চায় নিভ্রর শীতল স্পর্শগুলো।
.
.
.
.
~চলবে
সার্ভার ডাউনের কারনে পেইজ রিচ হঠাৎ কমে গিয়েছে। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ রইলো কমেন্ট করার জন্য। সবাই কমেন্ট করবেন আশাকরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here