প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৮।

0
106

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।

‘কবে কথা বলবে?’

‘এখন কি এসব বলার সময়?’

‘প্রায় এক মাস হতে চলল, এখনও কি সময় হয়নি? তুমি আর কতদিন ওর সাথে থাকতে চাও? নাকি ইতিমধ্যেই চিন্তায় কোনোরূপ বদল ঘটেছে?’

আঁতকে উঠে জবাব এল,

‘তুমি কি কোনোভাবে আমাকে সন্দেহ করছো?’

‘না, সন্দেহ না ঠিক। তবে মনের উপর তো ভরসা নেই। বলা তো যায় না, যদি বেশি সময় নিতে গিয়ে দূর্বল হয়ে পড়ো; তখন?’

‘এমন কিছুই হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আর আপাতত এসব বাদ দিয়ে, যেটা করতে চাইছো সেটাই করো।’

‘ঠিক আছে, যাও তুমি।’

_________

মেহতাবের জন্য আনা কফির মগটা সাইড টেবিলে রাখল তনুকা। মেহতাব ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। চোখ মুখ কুঁচকে আছে অযথা। তনুকা তার পাশে বসে। হাতে তার গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ। বলে,

‘আপনার কফি দিয়েছি। খেয়ে নিন, নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

মেহতাব কফির মগ হাতে নিয়ে তনুকার দিকে চাইল। জিজ্ঞেস করল,

‘এতক্ষণ কি রেনুর ঘরে ছিলে?’

তনুকা ততক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ও পড়ছিল তো, তাই ওকে এক মগ কফি দিয়ে এলাম।’

‘ভালো করেছো।’

মেহতাব মনোযোগ দেয় আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে। তনুকাও তাকায় সেদিকে। বোঝার চেষ্টা করে, মেহতাব কী করছে। দেখে, কিছু ফাইলের লেখা মেহতাব সংশোধন করছে। তনুকার বুঝতে অসুবিধা হয় বিধায় জিজ্ঞেস করে,

‘কী করছেন?’

‘একটা জরুরি কাজ।’

‘এটা কীসের ফাইল?’

‘বুঝবে না তুমি।’

তনুকার মুখ থমথমে হয়। বুঝবে না মানে কী? সে কি অশিক্ষিত না কি? বিদেশ থেকে অনার্স কমপ্লিট করে এসে সামান্য একটা ফাইল বুঝবে না। বিরক্ত হয়ে আর কথাই বললনা। চুপচাপ কফি শেষ করে শুয়ে পড়ল।

_________

সকাল এখন সাতটা। বাগানে সম্মুখ প্রান্তে নির্লিপ্ত ভঙিতে হাঁটছেন রমেজ মজুমদার। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তাঁর। বাগানের এক কোণে পাতা বেঞ্চে বসে আছেন ঊর্মি বেগম। নিগূঢ়, নির্বাক তাঁর অভিব্যক্তি। অনেকক্ষণ হেঁটে রমেজ মজুমদার সহধর্মিণীর শিউরে বসলেন। বললেন,

‘আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, ঊর্মি।’

‘আমারও।’

‘রাদাভ এখন না আসলেও পারতো।’

ঊর্মি চাইলেন। নিঃসাড় সেই দৃষ্টি। বললেন,

‘সে অবশ্যই আসত। আমাদের এতদিনের সব পরিকল্পনার একমাত্র বাঁধা এই ছেলে। তার উপর আমাদের মেয়ের….’

রমেজ মজুমদার সতর্কতার সহিত বললেন,

‘আহা, আস্তে। শুনবে কেউ।’

‘আর কত লুকিয়ে রাখবেন?’

‘মেহতাব জানতে পারলে গর্দান নিবে আমাদের।’

‘গর্দান সে এমনিতেই নিবে। তারউপর আপনার মেয়ে যা করছে না, ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদের কঠিন মাশুল গুনতে হবে, দেখবেন।’

‘আমার মেয়ে কিছুই করছে না, করছে তো তার বিবিজান; যাকে প্রতিনিয়ত চোখে হারায় সে।’

ঊর্মি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে,

‘হ্যাঁ, বেচারার বিবিজানের প্রতি এই অতি প্রেম’ই না তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।’

‘তা যা বলেছ, এই মহলে প্রেম ভালোবাসা বলতে কিছু আছে না কি? এক মহাশয় প্রেম দেখাতে গিয়ে আজ পুড়ে ছাই। অন্যজন তো তাঁরই পথে।’

ঊর্মি আফসোসের সুরে বলল,

‘ভাইজানের জন্য আমার মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়। মানুষটা ভাবিকে মন থেকে ভালোবেসে ছিল। অথচ ভাবি…’

থামলেন তিনি। এই মহলের আনাচে কানাচে কথা শোনার মানুষের অভাব নেই। বেশি কথা বললে বিপদে পড়তে হবে অবশ্যই, তাই চুপ থাকলেন। রমেজ মজুমদার বললেন,

‘চলো, উঠা যাক এবার। আমার আবার একটু পর বেরুতে হবে।’

তাঁরা উঠতেই নিচ্ছিলেন। সেই সময় সামনে এসে প্রকট হয় তনুকা। তনুকাকে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেননি দুজন। তাই অবাক চোখে তাকান। ঊর্মি জিজ্ঞেস করেন,

‘তুমি এখানে?’

‘হু, বারান্দা দিয়ে দেখলাম, আপনারা বসে আড্ডা দিচ্ছেন, তাই চলে এলাম একটু খোশ গল্প করার জন্য। তা কী নিয়ে কথা বলছিলেন?’

ঊর্মি বেগম আর রমেজ মজুমদার একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে সামান্য হাসলেন। রমেজ মজুমদার বললেন,

‘তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল, বসো না।’

তনুকা হেসে বসল। বলল,

‘আমাকে নিয়ে? বাহ, কী কথা? ষড়যন্ত্র?’

রমেজ মজুমদার আর ঊর্মি বেগমকে হতাশ দেখাল। ঊর্মি বেগম বললেন,

‘তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে আমাদের লাভ?’

তনুকা হাসল; যেন, বেশ মজার কথা শুনেছে সে। বলল,

‘ষড়যন্ত্র ছাড়া আজ অবধি আপনারা আর কিছু করতে পেরেছেন?’

ঊর্মি বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,

‘এসব নিয়ে কোনো কথা বলার ইচ্ছে আমাদের নেই, তুমি আসতে পারো।’

তনুকা গম্ভীর মুখে চাইল। জিজ্ঞেস করল,

‘বাবাকে কে মে’রেছে?’

রমেজ মজুমদার অবাক কন্ঠে বললেন,

‘সেটা আমরা কী করে বলব?’

‘আপনারা অবশ্যই জানেন। এখন না বললে সমস্যা নেই, পুলিশ অবশ্যই খুঁজে বের করবে।’

‘ঠিক আছে তবে, বের করলেই দেখে নিও।’

‘এখন বললে, বেঁচেও যেতে পারেন।’

রমেজ মজুমদার আঁতকে উঠে বললেন,

‘তুমি কি কোনোভাবে আমাদের সন্দেহ করছো?’

‘না করেও তো উপায় নেই। আপাতত অপেক্ষা করছি, তদন্তের পরই খোলাসা হবে সব।’

তনুকা চলে গেল সেখান থেকে। ঊর্মি বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে বললেন,

‘দেখলেন, মেয়েটা আমাদের সন্দেহ করে। আমরা কি এতটাই খারাপ?’

__________

‘মা, ডেকেছিলেন আমায়?’

আম্বিরা বেগম বই রেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘হ্যাঁ, ভেতরে এসো।’

তনুকা ভেতরে প্রবেশ করে। দাঁড়ায় চুপচাপ। আম্বিরা বেগম বইটা নিজের টেবিলে রেখে বলেন,

‘তুমি নাকি তোমার শ্বশুরের মৃত্যুর তদন্ত চাইছো?’

তনুকা নির্লিপ্ত সুরে বলল,

‘জি।’

আম্বিরা বেগম ঘুরে চাইলেন। ঘরের মাঝে রাখা রকিং চেয়ারে বসলেন আয়েশ করে। বললেন,

‘তোমার কি মনে হয়, তোমার শ্বশুর খু ন হয়েছেন?’

তনুকা চাইল। নির্বিকার তার ভাবভঙ্গি। বলল,

‘জি, আমার তাই মনে হয়।’

‘তা কাকে সন্দেহ হয় তোমার?’

‘আমার সন্দেহ তে কিছু আসে যায় না, মা। পুলিশ তদন্ত করছেন, অপরাধী ঠিকই ধরা পড়বে।’

আম্বিরা বেগম লম্বা করে শ্বাস টানলেন। বললেন,

‘দেখো বউমা, রাদাভ আমার ছেলে তাই হয়তো ওর এই নিয়ে এত মাথা ব্যথা। কিন্তু, তোমাকে এই ব্যাপার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা আমার পছন্দ হচ্ছে না। বাড়ির বউ তুমি, তাই ঘর সামলাও। এসব কিছু দেখার জন্য মেহতাব আর রাদাভ আছে।’

তনুকার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের ন্যায় নির্লিপ্ত। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

‘মা, বাবার ঔষধগুলো কি আমি একটু দেখতে পারি?’

আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকালেন সঙ্গে সঙ্গে; যেন, বিরক্ত হলেন ভীষণ। নিরস মুখে বললেন,

‘ঔষধ দেখে তুমি কী করবে?’

‘তেমন কিছুই না, শুধু দেখব।’

‘ঔষধ মেহতাবের কাছে।’

তনুকা অবাক হলো কিঞ্চিৎ। বলল না কিছু। কেবল মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আচ্ছা, আমি যাই তবে।’

‘যাও। আর কথাখানা মাথায় রেখো।’

তনুকা ঘরে ফিরে আসে। মেহতাব বেরিয়েছে অনেক সময় হয়েছে। রাদাভও নেই। বলতে গেলে কোনো পুরুষ’ই নেই মহলে। রেনু স্কুলে। মহলের বউরা যার যার ঘরে। তনুকা বিষন্ন চিত্তে বিছানায় বসল। কিছু ভালো লাগছে না তার। কবে এসব শেষ হবে কে জানে? কবে ঠিক হবে সব? কবে পূর্ণ হবে তার মনের চাওয়া? আদোত কি পূর্ণ হবে? নাকি মেহতাব মজুমদার দাঁড়াবে সবথেকে বড়ো বাঁধা হয়ে?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তনুকা তার গলায় পরিহিত লকেটটাতে হাত বুলায়। খুলে দেখে সেটা। মেহতাব তার আর ছোটবেলার ছবি। তনুকা মলিন হাসে। আনমনে বলে,

‘মনে যার জায়গা নেই, গলায় তাকে ঝুলিয়ে কী হবে? মেহতাব মজুমদার, জোর জবরদস্তি ব্যতিত আপনি আর কিছুই পারেন না। কিন্তু, আফসোস! আপনি এখনো বুঝতে অক্ষম যে, আমি আপনার কখনোই হব না। কখনোই না।’

চলবে….

(যারা বলছেন, এবার গল্পের রহস্য ক্লিয়ার করার দরকার, আর ভালো লাগছে না; তাদের উদ্দেশ্য বলছি, আমি গল্প নিয়ে যতটুকু ভেবে রেখেছি সবটা না লিখতে পারলে আমি শেষটা গুছিয়ে দিতে পারব না। তখন আবার আপনারাই বলবেন, শেষটা অগোছালো। তাই আমি তাড়াহুড়ো করতে চাইছি না, রহস্য অবশ্যই খুলবে। তবে, আরো কিছু ঘটার বাকি এখনো। চিন্তা নেই, আমি ধীরে সুস্থে শেষ করব সবটা। আপনারা শুধু একটু ধৈর্য্য ধরে পাশে থাকবেন, তাহলেই হবে। আসসালামু আলাইকুম❤️)

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here