#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।
দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলো অশ্বগতিতে। এই দুই সপ্তাহের মাঝে বেশ কয়েকবার পুলিশ মেহতাবের মহলে এসেছে। সকলের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। করেছে অনেক তদন্তও। কিন্তু, এতসবের পরও ফলাফল বের হয়েছে শূণ্য। মোহন লাল মজুমদারের খু নের ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশকে মেহতাব ঔষধও দেখিয়েছে, তাতেও কিছু পায়নি তারা। অনেক অনেক তদন্তের পরেও যখন তারা কিছু পায়নি, তখন তদন্তের প্রয়োজন সেখানেই সমাপ্ত করে এবং জানিয়ে দেয়, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু; কোনো খু ন নয়।
_______
‘এতকিছু করে লাভ কী হলো? সে’ই তো যেই লাউ সেই কদু।’
‘মেহতাব মজুমদারের পরিকল্পনা সব।’
‘তা আমি জানি। এখন বাকিটা তোমাকেই করতে হবে। জমিটা নিজের নামে করো তাড়াতাড়ি।’
‘মেহতাব মজুমদার কখনোই দিবেন না।’
‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়; আঙ্গুল বাঁকিয়ে যা করার করো। তাও তোমার চুপচাপ বসে থাকা আমি সহ্য করব না।’
মলিন স্বরে জবাব এল,
‘কী দরকার এই জমি-জমার, এই সম্পদের? আমরা পালিয়ে গিয়ে কি ভালো থাকতে পারতাম না?’
অপর পাশের ব্যক্তি হেসে বলে,
‘মেহতাব মজুমদার আমাদের পৃথিবীর ভূগর্ভ থেকে হলেও খুঁজে বের করতো।’
‘কিন্তু, এসব আর কতদিন?’
‘আর বেশি দিন নয়। কিছু খবর পেয়েছি আমি; সেগুলো যদি সত্যি হয় তবে, অতি শীঘ্রই মেহতাব মজুমদারের বিনাশ ঘনিয়ে আসছে।’
বিনাশ! মেহতাব মজুমদারের বিনাশ! কথাটা এতদিন অবধি মনে এক শান্তি দিলেও, আজ হঠাৎই মনঃস্তাপ হলো। ভাবল, সত্যিই কি সে মেহতাব মজুমদারের বিনাশ চায়? কেন মন আজ কঠোর হতে পারছে না। মনটা আবার দূর্বল হয়ে পড়েনি তো। হায় হায়, এমন হলে তো মহাবিপদ!
_______
মাথায় ওড়না টেনে মহলের বাইরে এসে দাঁড়ায় তনুকা। তার পাশেই রেনু। এখন সন্ধ্যা ঠিক সাতটা ত্রিশ। মহলে মেহতাব নেই। অন্যদিন তার সাথে ইশফাক গেলেও, আজ সে যায়নি। শরীর খারাপ তার। গা পোড়ানো জ্বর ওঠেছে। আর সেটা শোনার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠে রেনুর কিশোরী মন। কতক্ষণে ছুটে একবার ইশফাকের কাছে আসবে সেই চিন্তাতেই বিভোর ছিল সে। কিন্তু, মহলে এখন রাদাভ আর ছোট কাকাও রয়েছেন। তার উপর প্রহরীরা তো আছেই। এতসবের মাঝে উপায় না পেয়ে তনুকাকেই অনুরোধ করে বসে। ননদের বিগলিত সুরের এই অনুরোধ তনুকাও পরে আর ফেলতে পারেনি। তাই রাজি হয়ে যায়।
এই মুহূর্তে ইশফাকের ঘরের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রেনু ধীর সুরে ডাকে,
‘ইশফাক, ইশফাক, আছেন ভেতরে? আমি রেনু।’
দু মিনিটের মাঝেই দরজা খুলে যায় সটান। ইশফাককে দেখা যায় আরক্ত মুখে দোরের অভিমুখে। তার জ্বরাক্রান্ত বিধ্বস্ত মুখ দেখে বড্ড মায়া হলো রেনুর। চিন্তিত সুরে বলল,
‘জ্বর কমেনি এখনো?’
আচমকা দুজন রমণীর উপস্থিতি বক্ষঃস্থলে ভয়ের সঞ্চার করে ইশফাকের। সে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
‘আপনারা এখানে? কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে।’
তনুকা বলল,
‘রেনুকে বুঝিয়ে পারছিলাম না, সে আপনার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেছে।’
ইশফাক রেনুর দিকে চাইল। সত্যিই মেয়েটাকে বিচলিত লাগছে ভীষণ। ইশফাক তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘চিন্তা করবেন না, রেনু। আমি ঠিক আছি। আপনারা মহলে ফিরে যান।’
রেনু বাঁধা দিয়ে বলল,
‘উঁহু, আমি আপনার সাথে কিছুক্ষণ থাকতে চাই।’
‘জেদ করবেন না, দয়া করে। বড়ো ভাইজান মহলে না থাকলেও ছোট ভাইজান আছেন, আমি কোনোপ্রকার ঝামেলা চাইছি না। মহলে যান।’
রেনু আমলে নিল না রুগ্ন ইশফাকের কথা। সে এগিয়ে এসে ইশফাকের গলা গাল স্পর্শ করে চকিত হয়ে বলল,
‘সে কি, আপনার শরীর তো দেখছি পুড়ে যাচ্ছে। কোনো ঔষধ খাননি?’
‘খেয়েছি। কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।’
‘এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে? আপনার জল পট্টি প্রয়োজন।’
ইশফাক ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। দাঁড়াতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। সে ক্লান্ত সুরে বলে,
‘কিছুর প্রয়োজন নেই। আপনি যান, প্লিজ।’
রেনু তনুকার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
‘বউমনি, তুমি একটু বোঝাও না উনাকে। উনার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যে।’
‘কিন্তু রেনু, তুমি কী করে জলপট্টি দিবে বলো? এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা আমাদের জন্য ঠিক হবে না। একবার কারোর চোখে পড়লে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
‘এখন কেউই এইদিকে আসবে না, বউমনি। কেবল দশ মিনিট, দশ মিনিট থেকেই চলে যাব।’
তনুকা মেয়েটার অস্থিরতা দেখে আর বারণ করতে পারল না। ইশফাক বিপদে পড়ল ভীষণ। মেয়েটা নাছরবান্দা, কোনোভাবেই ছাড়বে না। একপ্রকার জোর করেই সে ইশফাকের ঘরে ঢুকেছে। ইশফাকের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। কিন্তু, রেনু এইদিকে নির্লিপ্ত। সে মগে করে পানি এনে রুমাল ভিজিয়ে ইশফাকের কপালে চেপে ধরে। ইশফাক হতভম্ব। মেয়েটার এই চঞ্চলতা আজ অন্যরকম লাগছে তার। সে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। রেনু তার পাশেই। তার কাছে খুব। চাইলেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরা যাবে। অথচ সে ভয়ে বিভোর। জ্বরের কথা বেমালুম ভুলে, ভীত হয়ে বসে আছে। রেনু ক্রমাগত জলপট্টি দিয়ে চলছে। এত যত্ন নিয়ে করছে সব যেন, ইশফাক তার প্রেম নয় কেবল তার একনিষ্ঠ সাধনা, তার স্বামী।
দরজার বাইরে দাঁড়ান তনুকা। বারবার পিটপিট করে আশপাশ দেখছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার, কারোর চোখে না পড়ে যায় আবার। অন্যদিকে রেনুকেও বাঁধা দিতে পারছে না। সে ভালোবাসা বোঝে। ভালোবাসার মানুষের একটু অসুস্থতায় চিত্ত জুড়ে অস্থিরতাটা একদিন সেও অনুভব করেছিল। তবে, সেদিন রেনুর মতো মানুষটাকে কাছে পাচ্ছিল না বলে খুব কেঁদেছিল সে। আজ তাই কোনোভাবেই রেনুকে বাঁধা দিতে মন সায় দিচ্ছে না যেন।
____
‘এখন আপনি যান, রেনু। আমি আগের থেকে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি।’
রেনুর কপাল ছুঁয়ে বলল,
‘জ্বর এখনো কমেনি।’
‘কমে যাবে, যান আপনি।’
‘এত ভয় পান কেন, বলুন তো? ধরা পড়লে কী হবে? বড়জোর ভাইজান খু ন করবেন আমাদের, এর থেকে বেশি কি আর কিছু হবে?’
ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘আমার জন্য খু ন হতেও রাজি আপনি?’
রেনু চাইল তার চোখের দিকে। বলল,
‘হ্যাঁ, রাজি।’
ইশফাক হয়তো জ্বরের ঘোরে নয়তো সজ্ঞানে অযাচিত এক কাজ করে বসল। আচমকা জড়িয়ে ধরল রেনুকে। ইশফাকের অতি উষ্ণ বক্ষের আবরণে কম্পিত হলো রেনুর কিশোরী হৃদয়। আন্দোলিত হলো বক্ষঃস্থলের কম্পন। পায়ের পাতা শির শিরিয়ে ওঠল। নিশ্বাস নেওয়ার কথা ভুলে গেল বেমালুম। ইশফাক ঘনঘন শ্বাস টানল। বলল,
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, রেনু। ভীষণ ভালোবাসি।’
রেনুর এবার দম আটকে আসার উপক্রম। তার উপর ইশফাকের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন তাকে শ্বাস টানতে দিচ্ছে না। রেনু খানিক নড়ে ওঠল। ইশফাক ছেড়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। ভয়ানক কিছু বলে ফেলেছে দেখে লজ্জা আর অস্বস্তিতে মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। রেনু তার দিকে চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। ইশফাক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আপনি এখন যান, রেনু। দেরি করলে বিপদে পড়তে হবে।’
রেনু সহজ ভঙিতে উঠে দাঁড়ায়। ইশফাকের ঠিক বরাবর সে। উচ্চতা কম বলে মাথা তুলে তাকায়। ইশফাকের চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। রেনুর সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। কিন্তু, রেনু স্বাভাবিক ভীষণ। এগিয়ে আসে ইশফাকের দিকে। মেয়েটার সাহস আকাশচুম্বী। সে চট করে ইশফাকের গালে চুমু খেয়ে বসে। হেসে বলে,
‘আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
বলেই ছুটে বেরিয়ে যায় সে। ইশফাক বাকরুদ্ধ। গালে হাত দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে রেনুর ছুটে যাওয়া দেখে। পরে বুকে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে, হৃদপিন্ডটা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
_____
মহলের গেইটের সামনে আসতেই মেহতাবের ফোনটা বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে রাদাভের কল। সে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাদাভ বলে,
‘কোথায়, ভাইজান?’
‘এই তো গেইটের সামনে।’
রাদাভ কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘আর কিছুক্ষণ আগে আসলেই দারুণ এক দৃশ্য দেখতে পেতে।’
‘কী দৃশ্য?’
‘তোমার বউ, মানে আমার একমাত্র ভাবিজান এতক্ষণ তোমার সহকারীর ঘরের ভেতর ছিল। এই যে, মাত্রই বেরিয়ে এল কেবল।’
মেহতাব সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ঠিক দেখেছিস তুই?’
‘একদম। বিশ্বাস না হলে ভিডিয়ো আছে, চাইলে দেখাতে পারব।’
মেহতাব চোয়াল শক্ত করে বলে উঠে,
‘ঠিক আছে রাখ, আমি আসছি।’
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️