প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪০।

0
54

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।

‘ইশফাকের ঘরে কেন গিয়েছিলে, তনু?’

প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত হয় তনুকা। মেহতাবের দিকে ফিরে চায়। অকস্মাৎ প্রশ্নে রা হারায় সে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। মেহতাবের দৃষ্টি নিগূঢ় স্বচ্ছ। তনুকা ঘাবড়াচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জবাব না পেয়ে এগিয়ে আসে মেহতাব। হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। তারপর ফের জিজ্ঞেস করে একই প্রশ্ন,

‘বললে না তো, কেন গিয়েছিলে?’

তনুকাকে অস্থির দেখায়। ধরা পড়া চোরের মতো মুখ চুপসে যায়। সাত পাঁচ না ভেবেই বলে উঠে,

‘আপনার খোঁজ নেওয়ার জন্য।’

‘আমার খোঁজ তুমি কল দিয়েই নিতে পারতে, বাড়ির বউ রাত বিরাতে একজন সহকারীর ঘরে, ব্যাপারটা কেমন না।’

তনুকা মাথা নত করে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘আর হবে না এমন।’

মেহতাব মুচকি হেসে ডাকে তাকে। তনুকা অপ্রস্তুত ভঙিতে এগিয়ে যায়। মেহতাব হাত ধরে, তাকে টেনে নিজের কাছে বসায়। তারপর আলতো হাতে তনুকার কপালের চুলগুলো গুঁজে দেয় কানে। এগিয়ে এসে ললাটে এক গভীর চুম্বন আঁকে। তনুকা নির্বাক রইল। মেহতাবের ছোঁয়ায় হৃদয়ের কম্পন বাড়লেও, নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল সে। মেহতাব এক হাতে তনুকার কোমর জড়িয়ে তাকে আরো কাছে টানে। তনুকা বুঝতে পারছে না মেহতাবের উদ্দেশ্য। সে বরাবরের মতোই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু, আচমকাই মেহতাবের হাতের বাঁধন দৃঢ় হতেই সে চমকে ওঠে। একটু নড়ে সরে আসার চেষ্টা চালায়। মেহতাব বাঁধা দেয়। মুহূর্তেই পাল্টে যায় তার চোখে মুখের অভিব্যক্তি। গলার স্বর দৃঢ় হয়। চোয়াল হয় শক্ত। আচমকা মেহতাবের এমন পরিবর্তন ভীত করে তনুকাকে। সে ঢোক গিলে। মেহতাব অন্যহাতে তনুকার গালে হাত বুলিয়ে বলে উঠে,

‘আর কত মিথ্যে বলবে, বিবিজান?’

তনুকার নিষ্পলক চাহনি। মেহতাব ক্রমাগত তার গালে হাত বুলিয়ে চলছে। ঐদিকে কোমরে মেহতাবের হাতের স্পর্শ যেন হাড় বাঁকিয়ে ফেলার উপক্রম করেছে। তনুকা নড়ে চড়ে উঠে। অস্ফুট স্বরে বলে,

‘ছাড়ুন, লাগছে।’

মেহতাব ঠোঁট উল্টে আহ্লাদের সুরে বলে,

‘আহারে! আমার বিবিজানের লাগছে বুঝি? ঠিক আছে, ছেড়ে দিলাম। এবার সত্যিটা বলে ফেলো তো, কেন ইশফাকের ঘরে গিয়েছিলে?’

মেহতাবের অদ্ভুত আচরণ তনুকার ভয়ের মাত্রাকে তড়ান্নিত করে। সে ভীত সুরে বলে উঠে,

‘বললাম তো, আপনার খোঁজ নিতে।’

‘আহা, আবারও মিথ্যে বলছো। সত্যটা বলো, বিবিজান। আমি কিছু মনে করব না।’

তনুকা মহাবিপদে পড়েছে। এখনই সত্যিটা জানলে, রেনুর বিপদ। আর মিথ্যে বলেও আজ হয়তো পার পাবে না সে। কিন্তু, কথা হচ্ছে, মেহতাবকে এসব কে জানাল? ইশফাক তো কখনোই বলবে না, তবে আর কে? মহলের কেউ?

তার ভাবনার মাঝেই মেহতাবের কর্কশ স্বর শোনা যায়। সে বলে,

‘বুঝতে পেরেছি, তুমি বলবে না। তবে, ইশফাকের কাছ থেকেই সব শুনব আমি।’

মেহতাব উঠে দাঁড়াতেই তনুকা তার পথ আটকে দাঁড়ায়। বিচলিত সুরে বলে,

‘বলব, সব বলব আমি তবে, তার আগে ওয়াদা করতে হবে সব শুনে রাগতে পারবেন না একদম। ঠান্ডা মাথায় সমাধান করবেন।’

মেহতাব কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

‘আমার আঁড়ালে কী করেছো তুমি?’

‘আপনার আঁড়ালে কিছু করা সম্ভব না, মেহতাব। আমি বলছি সব, দয়া করে আপনি শান্ত হয়ে বসুন।’

মেহতাব বসল। গম্ভীর সুরে বলল,

‘বলো এবার।’

তনুকা ভয়ে ভয়ে পাশে বসল তার। কোথ থেকে কীভাবে শুরু করবে ভাবল প্রথমে। অতঃপর একটু রয়ে সয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলতে আরম্ভ করল সব। মেহতাব নিষ্পলক চেয়ে রইল। এতকিছু তার আঁড়ালে, অথচ সে কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। মেহতাব হতবিহ্বল হয় সব শুনে। বলে,

‘এতকিছু হয়ে গেল, আর আমি কিছুই জানি না? আমার বোন শেষে কি না সামান্য এক সহকারীকে ভালোবেসেছে?’

তনুকা মলিন স্বরে বলল,

‘ভালোবাসার জন্য কি খুব ধনী মানুষ প্রয়োজন?’

মেহতাব চাইল; উত্তর দিল না কোনো। তনুকা বলল,

‘এখন এই নিয়ে রেনুকে কিছু বলবেন না, প্লিজ। ওর মাধ্যমিকের পর যা করার করবেন।’

‘করার কিছুই নেই। মাধ্যমিকের পর বিয়ে দিব ওকে। আর ওর জন্য পাত্র আমি আরো আগ থেকেই ঠিক করে রেখেছি।’

তনুকা বিচলিত হয়ে বলল,

‘তাহলে ওর ভালোবাসার কী হবে?’

‘ওসব স্বল্প সময়ের আবেগ বৈ আর কিছু না, সময়ের সাথে সাথে সব কেটে যাবে।’

তনুকা মানতে নারাজ। দ্বিমত পোষণ করে বলে উঠে,

‘আবেগ নয় এটা। আমি রেনুর চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি।’

মেহতাব তখন হতাশ স্বরে বলল,

‘আর আমার চোখে দেখোনি?”

তনুকা কথার তাল হারায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘দয়া করে ওদের সাথে কোনোরূপ অন্যায় করবেন না, ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।’

মেহতাব শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

‘কিন্তু, আমি সেখানে ওয়াদা দিয়ে ফেলেছি। তুমি জানো, আমি ওয়াদার খেলাফ করি না।’

মেহতাব তার কথা শেষ করে গোসলখানায় প্রবেশ করে। তনুকা অসহায় বোধ করে তখন। সে চায় না, রেনুর অবস্থাও তার মতোই হোক। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে না পাওয়ার যে বিদঘুটে কষ্টটা, সেটা যে রেনু সহ্য করতে পারবে না।

________

রাতের খাবার খেতে বসেছে সবাই। খাবার মাঝেই মেহতাবের দৃষ্টি পড়ে রাদাভের উপর। যে এই মুহূর্তে তনুকাকে দেখতে ব্যস্ত। রাদাভের দৃষ্টি টের পেতেই মেহতাবের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শরীর শক্ত হয়, দৃঢ় হয় চোয়াল। কপালের ভাঁজ বলে দিচ্ছে, সে এখন মাত্রাতিরিক্ত রেগে গিয়েছে। খাবারের প্লেটটা ঠাস করে সরিয়ে দেয়। হঠাৎ এমন শব্দে চমকে তাকায় সকলে। আম্বিরা বেগম জিজ্ঞেস করেন,

‘কী হয়েছে, মেহতাব?’

মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

‘কাল থেকে রাতের খাবার সবাই যার যার ঘরে খাবে, ডাইনিং এ বসে আর কোনোপ্রকার খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না।’

সবাই হতভম্ব এমন আদেশ শুনে। আম্বিরা বেগম কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই মেহতাব তাঁকে থামিয়ে দেয়। বলে উঠে,

‘আমার আদেশের যেন কোনো হেরফের না হয়। বিবিজান, ঘরে এসো।’

সে বড়ো বড়ো পায়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। অগত্যাই তনুকাকেও উঠে দাঁড়াতে হলো। রাদাভ বিরক্ত স্বরে বলল,

‘তোমার বড়ো ছেলের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী, মা?’

আম্বিরা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘আমি কী করে জানব?’

‘এটা তো রীতিমত অত্যাচার। তোমরা কেউ প্রতিবাদ কেন করলে না?’

রাহীলা সুযোগের সৎ ব্যবহার করার জন্য বলে উঠলেন,

‘জমিদার সাহেবের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারোর আছে না কি? বাবা গো বাবা! বলা তো যায় না, দেখা যাবে কথা বললে আবার জিভ’ই ছিড়ে নিলেন।’

ঊর্মি ধমকে উঠে বললেন,

‘আহা, ছোটো! কী বলছিস?’

‘না না মেঝ কাকী, চুপ থাকলে তো চলবে না। ভাইজানের সব কথা তো শোনা যায় না, আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। মা, তুমিও কি কিছু বলবে না?’

আম্বিরা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘অযথা ঝামেলা করতে যেও না, রাদাভ। তোমার ভাইজান মোটেও মানবে না এসব।’

তিনি চলে গেলেন। রেনুও চলে গেল তারপর। মেঝ কাকা আর মেঝ কাকীও উঠে পড়লেন। বসে রইলেন কেবল ছোট কাকা আর ছোট কাকী। ছোট কাকী রাহীলা তখন বললেন,

‘রাদাভ, আমরা প্রতিবাদ করতে চাই। এই অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না।’

রাদাভ ফিচেল হেসে বলে,

‘আরেকটু ধৈর্য্য ধরো, কাকী। আর বেশিদিন নেই।’

রাতে আর মেহতাবের সাথে কোনোপ্রকার কথা বলেনি তনুকা। খাবার টেবিলে মেহতাবের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণও জানতে চায়নি। তবে, বিরক্ত সে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

____

রাত বোধ হয় তখন দুইটা। তনুকার ফোনে কল আসে। তনুকা ঘুমে বিভোর, তাই কলের শব্দ কানে যায় না ঠিক। তবে, মেহতাব ঠিকই টের পায়। আস্তে করে উঠে বসে তনুকার কলটা রিসিভ করে। কানে লাগিয়ে চুপ রয় সে। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,

‘ঐখান থেকে পালিয়ে যা, মা। ঐখানে থাকলে মেহতাব মজুমদার তোকে আর শান্তিতে থাকতে দিবে না।’

মেহতাব হেসে ফেলে। ফোনটা চোখের সামনে ধরে নাম্বারটা দেখে নেয়। এরপর কল কেটে নাম্বারটা ব্লক করে ডিলিট করে, অতঃপর ফের চুপচাপ শুয়ে পড়ে তার জায়গায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here