#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।
পরদিন সকালে তনুকার ঘুম ভাঙে আচানক। সে চোখ মেলে তাকাতেই মেহতাবকে পায় তার অতি নিকটে। মেহতাব ঝুঁকে আছে তার দিকে। ঘুম থেকে চোখ মেলেই এমন কিছু হয়তো সে আশা করেনি, তাই অপ্রস্তুত হয় ভীষণ। উঠতে নেয়, মেহতাব আটকায়। বলে,
‘উঠছো কেন?’
তনুকা ক্ষীণ সুরে বলে,
‘আপনি এভাবে কী দেখছেন?’
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,
‘এই কয়দিনের এত ব্যস্ততায় আমি আমার বিবিজানকে ঠিক মতো দেখতেও পারেনি, আজ তাই মন ভরে দেখে পুষিয়ে নিচ্ছি।’
তনুকা ইতস্তত সুরে বলে,
‘আমি উঠব, সরুন।’
‘উঁহু, আরো আধঘন্টা আমি তোমাকে এভাবেই দেখব।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘পাগল হয়েছেন? আজ আপনার আর কোনো কাজ নেই?’
‘না।’
মেহতাবের কন্ঠের গভীরতা আন্দাজ করতে পেরে তনুকা অস্থির হয়। সে মেহতাবের বুকে হাত রেখে তাকে সরানোর চেষ্টা করে। মেহতাব নড়ে না এক ইঞ্চিও। তনুকা বিরক্ত হয়। বলে,
‘আশ্চর্য! এমন করছেন কেন?’
মেহতাব এক হাত তনুকার গালে ঠেকায়। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘তুমি সেদিন বলেছিলে না, যদি মানুষের সব চাওয়া পূর্ণ হতো তবে পৃথিবীটা সুখে ভরে যেত। কিন্তু, নির্মম সত্যি এটাই যে, মানুষের অতিরিক্ত চাওয়া জিনিসটা কখনোই তার হয় না; সেটা আজীবন অপূর্ণ’ই থেকে যায়।’
মেহতাবের গলার স্বর অবাক করে তনুকাকে। মেহতাব ফের বিধ্বস্ত সুরে বলে উঠে,
‘আমাকে একটু ভালোবাসলে কী ক্ষতি হতো, তনু? কেন ভালোবাসোনি? আমি কি খুব খারাপ?’
তনুকা নির্বাক, নিস্তব্ধ। কী বলবে সে? মেহতাবকে কখনো এভাবে আশা করেনি। সে হঠাৎ এত ভেঙে পড়ল কেন? মেহতাব এগিয়ে এসে তনুকার কপালে চুমু খায়। তনুকা দম টেনে নিশ্বাস ছাড়ে। মেহতাব আবার বলে,
‘আমার জন্য এই মুহূর্তে সবথেকে দামি বস্তুটা হলো তোমার ভালোবাসা, যেটা হয়তো কখনোই আর আমার পাওয়া হয়ে উঠবে না। কিন্তু, বিশ্বাস করো তনু, অধিকার থাকার পরও যেই জিনিসটা আমি পাবো না, সেটা আমি কখনো অন্য কাউকেও পেতে দিব না। এক্ষেত্রে আমি বড্ড স্বার্থপর, নিষ্ঠুরও বটে।’
তনুকা ঢোক গিলে। ভয় পায় সে। মেহতাব এসব কেন বলছে? সে আবার কিছু বুঝে ফেলেনি তো? তনুকার সম্বিত ফেরে নাকের উপর মেহতাবের উষ্ণ স্পর্শে। তনুকা চোখ বোজে গাঢ় নিশ্বাস ফেলে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘ছাড়ুন, মেহতাব।’
মেহতাব ছাড়ল না। তনুকাকে আজ ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো তার। মন বলছে, হয়তো বেশি সময় নেই; ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার আগেই একবার সে যত্ন করে ভালোবাসতে চায়। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে চায়। বলতে চায়, “পৃথিবীর সবকিছুতে ভুল থাকলেও আমার ভালোবাসায় কোনো ভুল নেই, বিবিজান। আমার ভালোবাসা ঐ আকাশের ন্যায় বিশুদ্ধ শুভ্র। বিশ্বাস করো, আমি তোমায় সত্যি ভীষণ ভালোবাসি।”
মেহতাবের উষ্ণ স্পর্শ প্রগাঢ় হয়। তনুকার অস্বস্তির মাত্রা বাড়ে। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু, মেহতাব যেন ছাড়তে নারাজ। মেহতাব মাথা তুলে তনুকার ঠোঁটের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেই দৃষ্টির অর্থ আন্দাজ করতে পেরে বিচলিত হয় তনুকা। ছটফটের মাত্রা বেড়ে যায়। মেহতাব আরেকটু এগুতেই তনুকা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় তাকে। মেহতাবকে তাও চুল পরিমাণ নাড়াতে পারে না। তাই কেঁদে ফেলে এবার। বলে উঠে,
‘আপনি বলছিলেন, কোনোপ্রকার জোর জবরদস্তি আপনি করবেন না। তবে, আজ এমন কেন করছেন?’
মেহতাব নিজেকে আটকায়। গলার স্বর দৃঢ় করে বলে,
‘তখনও মনে ক্ষুদ্র আশা ছিল। কিন্তু, এখন আমার আর কোনো আশা নেই। আশাহীন প্রতীক্ষার কোনো মানে হয় না।’
‘তাই বলে আপনি জোর করবেন?’
‘আমার অধিকার আছে।’
‘আপনিও অন্য সবার মতো অধিকার খাটাতে চাইছেন, মেহতাব? এত ঠুনকো আপনার ভালোবাসা?’
মেহতাব হাসে। বেশ শব্দ করেই হাসে সে। চট করে উঠে বসে। মাথার চুল ঠিক করে। হাসি জারি রাখে বেশ কিছুক্ষণ। তনুকাও ধরফরিয়ে উঠে বসে। মেহতাবের অদ্ভুত আচরণে হতভম্ব সে। মেহতাব তার দিকে তাকায়। হাসি থামিয়ে বলে উঠে,
‘আমার ভালোবাসা ঠুনকো হলে কার ভালোবাসা দৃঢ়, বলো? বলো, কে সে? যদি আমার থেকেও প্রগাঢ় কেউ ভালোবাসে তোমায় তবে, নিজ হাতে আমি তোমাকে তার হাতে তুলে দিব।’
তনুকা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। মেহতাব কী বলছে এসব? সে কি কোনো সুযোগ দিতে চাইছে তাকে? তার এখন কী করা উচিত? মেহতাবের প্রস্তাবে রাজি হওয়া উচিত, না কি না? এটা আবার তার কোনো ফাঁদ নয়তো?
তনুকা বিপাকে পড়ে। চিন্তায় কপাল কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়। বীতঃস্পৃহ সুরে বলে,
‘এসব শুনতে ভালো লাগছে না, মেহতাব। কেন বলছেন এসব? সকাল সকাল কী হয়েছে আপনার?’
মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘কিছু হয়নি। ফ্রেশ হয়ে এসো, খেয়ে দেয়ে তোমাকে নিয়ে মনোহর নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাব।’
তনুকা আর কথা বাড়াল না। সে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে এসে মেহতাবকে আর ঘরে পায় না তনুকা। তার বলা কথাগুলো সব কানে বাজছে ক্রমাগত। তনুকা হাত মুখ মুছে নিচে যায়। ডাইনিং এ আজ সবাই থাকলেও মেহতাব নেই। রাদাভও নেই। তনুকা এক ফাঁকে রেনুর কাছে তাদের কথা জিজ্ঞেস করে। তবে রেনু জানায়, সে কিছুই জানে না।
________
অন্ধকার ঘরে জানলার শিক গলিয়ে আসা ক্ষুদ্র আলো বৈ আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে, শোনা যাচ্ছে এক অদ্ভুত আওয়াজ। বেশ খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এটা কারোর গোঙানোর স্বর। একটু পরেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল বেশ শব্দ করে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে প্রবেশ করল, এক পশলা আলোকচ্ছটা। চোখে মুখে আলো পড়তেই চোখ পিটপিট করে তাকায় ব্যক্তিটি। হাত, পা আর মুখ বাঁধা বলে কোনোপ্রকার শব্দ করতে পারছে না। তবে, দরজায় দাঁড়ান ব্যক্তিকে ঠাহর করতে পেরেই তার অস্থিরতার মাত্রা তীব্র হয়। দুজন ব্যক্তি খটখট করে শব্দ করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। একজন গিয়ে অজ্ঞাত লোকটির ঠিক মুখ বরাবর রাখা চেয়ারটাতে আয়েশ করে বসে। পায়ের উপর পা তুলে কিছুটা ঝুঁকে আসে সে। ক্রূর হাসে। বলে উঠে,
‘এতবার সাবধান করার পরও একই ভুল করলেন। আমাকে কি একটুও ভয় করে না আপনার?’
লোকটি ভয়ে রীতিমত কাঁপছে। মুখ বাঁধা বলে কিছু বলতেও পারছে না।
‘উনি কে, ভাইজান?’
মেহতাব চাইল রাদাভের পানে। হেসে বলল,
‘সেকি! চিনতে পারছিস না?’
রাদাভ ভ্রু কুঁচকে মনোযোগের সহিত লোকটাকে দেখে বলল,
‘ওমর মামা! উনি এখানে এভাবে… কেন?’
‘আমি এনেছি।’
রাদাভ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কিন্তু, কেন?’
মেহতাব বলে,
‘জানিস, তনুকা এতদিন উনার কাছেই ছিল।’
‘হ্যাঁ, সেটা তো সবাই জানে।’
মেহতাব আচমকা প্রশ্ন করে,
‘তনুকা যে সুস্থ, সেটা জানিস?’
রাদাভ পুলকিত হয়। হ্যাঁ কী না বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মেহতাব রাদাভের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘তুই জানতিস না?’
রাদাভ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,
‘ন না, আমি ক কী করে জানব? সবাই তো জানে, ভাবি অসুস্থ।’
‘উঁহু, তনুকা একদম সুস্থ। এতদিন উনারা আমাদের মিথ্যে বলে এসেছেন।’
রাদাভ ঢোক গিলে। তনুকার সুস্থ থাকার কথাটা যদি মেহতাব জেনে যায় তবে, পরবর্তী সব কথাও মেহতাব জেনে যাবে। আর এই মুহূর্তে মেহতাবের সবকিছু জেনে যাওয়া মানে ঘোর বিপদ।
রাদাভ অস্থির হয়। কী করে ব্যাপারটা সামাল দিবে, সেটাই ভাবছে। মেহতাব কিছুটা সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘উনাকে মে রে ফেললে কি তনু খুব বেশি কষ্ট পাবে, রাদাভ? আফটার অল, তনুকে ছোট থেকে নিজ সন্তানের মতো বড়ো করেছেন, কষ্ট হয়তো খানিকটা পাবে, তাই না?’
রাদাভ বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি উনাকে মে রে ফেলতে চাইছো?’
‘হ্যাঁ, চাইছি। আমি কোনো মিথ্যাবাদীকে পৃথিবীতে রাখতে চাই না। আমাকে মিথ্যে বলা প্রত্যেকটা মানুষকে আমি নিজ হাতে খু ন করব।’
রাদাভ ঢোক গিলে। ঘামে গায়ের শার্টটা ইতিমধ্যেই ভিজে গিয়েছে তার। সে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলে উঠে,
‘এমন করো না, ভাইজান। পুলিশ কেইস হতে পারে।’
মেহতাব হেসে বলে,
‘সামান্য পুলিশ তোর ভাইজানের কিছুই করতে পারবে না, বোকা। ঐ ড্রয়ারে দেখ একটা চাপাতি আছে, নিয়ে আয় তো।’
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️