প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫০।

0
81

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫০।

মেহতাব কোনো এক কাজে বেরিয়েছে। ইশফাককে নেয়নি সাথে। ইশফাকের দুশ্চিন্তা তাতেই। মেহতাব নারাজ হয়েছে ভীষণ। ইশফাক চায়নি এমনটা। তবে ভালোবাসার কাছে পরাস্ত হয়ে এইটুকু তাকে এখন সহ্য করে নিতেই হবে।

______

‘বুঝলে রাহীলা, যা দেখছি দুদিন পর থালা নিয়ে পথে না বসতে হয় আমাদের।’

রাহীলা হকচকিয়ে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন,

‘কেন কেন? কী হয়েছে?’

‘হওয়ার কী আর কিছু বাকি আছে? ঐ মেহতাবের উপর তো কোনো কালেই ভরসা ছিল না, ভেবেছিলাম রাদাভকে একটু বিশ্বাস করে যদি কিছু পায়। কিন্তু, এখন তো মনে হচ্ছে ঐ বেটাও ধূর্ত ভীষণ। আমাদের কিছুই দিবে না।’

রাহীলা নাক মুখ কুঁচকালেন। নিরস মুখে বললেন,

‘তা তো আমি আগেই জানতাম। যতই হোক দুই ভাই না, বৈশিষ্ট্য তো একই রকম হবেই।’

‘কিন্তু, এভাবে চলতে দিলে তো হবে না। কিছু একটা তো করতে হবে। নয়তো মেঝো ভাইজানরাও সব পেয়ে যাবেন, শেষে ফকির হয়ে বসে থাকব আমরা।’

রাহীলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘মেঝো ভাইজানকে কে কী দিবেন বলুন তো? উনার কোনো সন্তান আছে না কি যে কিছু পাবেন?’

মতিব মজুমদার নিভু সুরে বললেন,

‘আছে আছে।’

রাহীলা চমকালেন খুব। চেঁচিয়ে বললেন,

‘কী? কোথায়? আমি জানি না কেন?’

মতিব মজুমদার বিরক্ত হয়ে তাঁর মুখ চেপে বললেন,

‘আরে, আস্তে আস্তে। চেঁচালে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে যে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, চেঁচাব না। আপনি জলদি বলুন সব।’

‘বলছি। আসলে তুমি এই মহলের খবর অনেক কিছুই জানো না। কারণ তুমি এই মহলে এসেছ অনেক পরে। আমাদের বিয়ের আগেই অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল এখানে, যা তোমাকে কখনো জানানো হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি তাই। তবে আজ জেনে নেওয়া উচিত। মেহতাবের বউ তনুকা কিন্তু এই বাড়িরই মেয়ে। আমাদের মেঝো ভাই ভাবির একমাত্র মেয়ে। ওর যখন পনেরো কী ষোলো বছর বয়স তখন ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এক্সিডেন্টে ওর মস্তিষ্কে চাপ পড়াতে পুরনো সমস্ত স্মৃতি মুছে গিয়েছে। ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। গ্রামে ভালো চিকিৎসা পাবে না বলে, ওকে সবাই মিলে ঢাকা তার মামার কাছে পাঠায়। তারপর থেকে সেখানেই বড়ো হয়েছে সে। কিন্তু, এত এত চিকিৎসা করেও স্মৃতি আর ফেরানো যায়নি। ডাক্তারও বলেছিলেন, কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে মস্তিষ্ক একেবারেই বিকল হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়ে পরিবারের কেউ তার সাথে কখনো কোনো যোগাযোগ রাখেনি। দূর থেকে খবর নিয়েছে কেবল। তবে এতকিছুর মাঝেও আমাদের জমিদার সাহেব তনুকা বলতে আধপাগল ছিলেন। ছোট থেকেই এই দূর্বলতা তার। তাই তনুকা বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরতেই একপ্রকার জেদ করেই তাকে বিয়ে করে এই বাড়িতে আনে। মেঝো ভাই ভাবি কিংবা বড়ো ভাবিও চাননি এই বিয়ে। কেবল মেহতাবের জোরের কারণেই হয়েছে সব। মেহতাব চেয়েছে, তনুকা পুরোনো পরিচয়ে নয় বরং নতুন পরিচয়ে এই বাড়িতে থাকুক। আর সেই জন্যই তো তার প্রতি জনাবের এত টান।’

রাহীলা দুই ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব বেশ। তিনি মুখ বন্ধ করতে পারছে না। বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছেন যেন।

‘তাই তো বলি, মেঝো ভাবি সেই প্রথম থেকেই তনুকাকে কেমন আগলে আগলে রাখেন। আমি কিছু বলতে গিয়েও উনার জন্য পারতাম না, যেন তনুকার চেয়ে উনারই গায়ে লাগত বেশি। এখন বুঝলাম, মেয়ে বলেই এত ভালোবাসা।’

‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ।’

রাহীলার চোখ মুখ থমথমে হয়ে আসে। তিনি বিষন্ন সুরে বলে উঠেন,

‘তবে এখন কী করবেন? তনুকার মা বাবা হওয়ার সুবাদে উনারাও তো বেশ সম্পত্তি পেয়ে যাবেন। শেষে তো আমরা আর কিছুই পাব না।’

‘তাই তো ভাবছি, গিন্নি। খুব শীঘ্রই কিছু একটা করতে হবে। নয়তো আম আর ছালা দুটোই একসাথে হারাব।’

‘কী করবেন?’

মতিব মজুমদার গাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন,

‘মেহতাবকে মে রে দিলে কেমন হয়?’

রাহীলা চকিত হয়ে বললেন,

‘আপনি পারবেন?’

মতিব মজুমদার হাসলেন। বললেন,

‘হ্যাঁ, পারব।’

‘কীভাবে?’

___________

বিকেল হয়ে এসেছে। সূর্যের তেজ কমেছে অনেকটা। বাগানে এখন সোনালী আলো। দক্ষিণের দিকটাই খানিক বাতাসও বইছে। বসার ঘরে বসে আছে সবাই। গম্ভীর ভাবমূর্তি। মেহতাব ঠিক মাঝের এক সোফাতে বসা। তার পাশেই বসেছেন আম্বিরা বেগম। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চেয়ে আছেন কেবল। সবকিছু এখনও তিনি ঠিক হজম করতে পারছেন না। কবে কখন হলো এসব? ইশফাক আর রেনুর বিয়ে? ঠিক মানতে পারছেন না তিনি। রেনুর আকুতি ভরা চোখ মুখের বাচন ইশফাককেও যেন তার ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে দিচ্ছে না। রাদাভ বলে উঠে,

‘সব ছেড়ে তোমার সামন্য এক সহকারীর সাথে বোনের বিয়ে দিবে, ভাইজান?’

প্রশ্ন শুনে মেহতাব চাইল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘তাতে তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে?’

রাদাভ বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আমাদের বোনের জন্য নিশ্চয়ই ছেলের অভাব পড়েনি তবে, এই সহকারী কেন?’

‘তারা একজন অন্যজনকে ভালোবাসে, তাই।’

রাদাভ কপাল কুঁচকে বলল,

‘ভালোবাসলেই কি সব হয়ে যায়? লেভেলের ও তো একটা ব্যাপার আছে; ওর সাথে কি আমাদের বোন যায়, বলো?’

রাদাভের কথা শুনে তনুকা হতভম্ব। যেন এটা আশাতীত ছিল তার নিকট। রাদাভের কাছে কি ভালোবাসার ঊর্ধ্বেও কোনো বস্তু আছে? তার কাছে ভালোবাসা এত ঠুনকো কী করে হতে পারে? ভালোবাসার প্রতি তার এই মনোভাব তনুকাকে ব্যথিত করে ভীষণ।

মেহতাব বলে,

‘আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়েছি। আশা করছি, আমার কথার বিরুদ্ধে কেউ যাবে না।’

রাদাভ উঠে দাঁড়ায়। গর্জে উঠে বলে,

‘কেন, ভাইজান? সবসময় কেবল তোমার কথাই শুনতে হবে কেন? আমাদের কি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই? তুমি রীতিমতো জুলুম শুরু করেছ আমাদের উপর। আর কত? এবার বন্ধ করো এসব।’

রাদাভের হুংকারে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সকলে। কারোর মুখে কোনো রা নেই। নির্বাক নিষ্পলক চেয়ে আছে কেবল। ভাবছে, হয়তো এক্ষুনি মেহতাব এক টানে তার জিভ ছিড়ে নিয়ে আসবে। অথচ সবাইকে চমকে দিয়ে মেহতাব পূর্বের ন্যায় শান্ত হয়েই বসে রইল। বরং হাসল সে। বলল,

‘হঠাৎ এত রেগে গেলে যে? জীবনের মায়া বুঝি ফুরিয়ে গিয়েছে?’

‘ভয় দেখাচ্ছ আমায়?’

রাদাভ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল। মেহতাব বিদ্রুপের সুরে বলে উঠল,

‘মেহতাব মজুমদার কাউকে ভয় দেখায় না, ভাই। ডিরেক্ট কাজ করে দেখায়। ভাই বলে সব সময় মাফ পেয়ে যাবে ভেবো না। আমার রাগ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তোমার পরিপূর্ণ ধারণা আছে?’

রাদাভ দাঁত খিঁচে এমন ভাবে চাইল যেন, মেহতাবকে এখনই কাঁচা চিবিয়ে খাবে সে। মেহতাব ফের হাসল তা দেখে। বলল না আর কিছু। হালকা গলা ঝেরে বলল,

‘আগামী পরশু আমি রেনু আর ইশফাকের কাবিন করাব। কিছু গরীব দুঃখী খাইয়ে সবটা করব ভাবছি। বড়ো অনুষ্ঠান ভবিষ্যতে হবে। আপাতত রেনু এইটুকুতেই খুশি থাক।’

রেনু খুশিতে নাচতে পারলে বোধ হয় বাঁচত। কোনোরকমে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

‘এইটুকুতেই আমি ভীষণ খুশি, ভাইজান। আমার আর কিচ্ছু চাই না।’

মেহতাব প্রস্থান ঘটাল। মেহতাবের কথার উপর কথা বলার সাহস কারোর নেই। তাই পছন্দ না হলেও মেনে নিল সবাই। একে একে বেরিয়ে গেল তারা। রাদাভ ইশফাকের দিকে কটমট করে চেয়ে নিজের রাস্তা মাপল। দাঁড়িয়ে রইল তনুকা কেবল। রেনুর কাছে গিয়ে বলল,

‘চিন্তা নেই। তোমার ভাইজান যখন বলে দিয়েছেন বিয়ে তখন হবেই।’

রেনু উত্তরে হাসল কেবল। তনুকাও চলে গেল সেখান থেকে। রেনু ইশফাকের বরাবর দাঁড়াল। ক্ষীণ সুরে বলল,

‘ছোট ভাইজানের কথায় আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন, তাই না?’

ইশফাক চাইল। মৃদু হেসে বলল,

‘ভালোবাসলে এমন একটু আধটু কষ্ট সহ্য করে নিতেই হয়।’

রেনু আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,

‘আই লাভ ইউ।’

ইশফাক সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখল, তারপর চোখ পাকিয়ে বলল,

‘বিয়ে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরা যাচ্ছে না? এখনই এত চেঁচিয়ে সব বলে দিতে হবে? আপনার ভাইজানদের ভরসা নেই, আমি আমার কক্ষে যাচ্ছি।’

ইশফাক দ্রুত পা চালাল। তার ব্যস্ততা দেখে হাসল রেনু।

_______

সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোতে দেখা যাচ্ছে দুই ছায়ামূর্তিকে। কিছু একটা নিয়ে জরুরি আলাপ চলছে হয়তো তাদের মাঝে। ইশফাক বিকেলে এইদিকটাই এসেছিল। মেহতাবের দেওয়া কোনো এক কাজ সারতেই এইদিকে আসা তার। যাওয়ার পথে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। মানুষ দুটিকে চেনার জন্য আরেকটু এগিয়ে যায়। সন্ধ্যার মথিত আলোয় যদিও কিছু স্পষ্ট নয় তাও এক চেহারা দেখে চিনতে পেরেছে সে। চেনা মাত্রই চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হয় তার। লোক দুটির কথা শোনার চেষ্টা চালায়। গাছের আঁড়াল থেকে শোনা মুশকিল বেশ। কিন্তু, না শুনলে বিপদ হয়তো। ইশফাকের মন বলছে, লোকটার মাথায় ভয়ানক কিছু চলছে। আর তাঁর মাথায় ভয়ানক কিছু মানে মেহতাবের বিপদ। ইশফাক সেটা চায় না একদমই। তাই শুনতে হবে। কান খাড়া করতেই বেশ কয়েক লাইন তার কর্ণগোচর হয়। আর যতটুকু শুনেছে ততটুকুতেই বুঝেছে মেহতাবের সামনে ঘোর বিপদ। তাকে এক্ষুনি গিয়ে জানাতে হবে সবটা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here