#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ২৬+২৭
#কায়ানাত_আফরিন
–”আমি সবসময় স্বাভাবিকভাবে থাকি দেখে এমন মনে করোনা আমার মনে কোনো অনুভূতি নেই। এসব কথা বলে আমার মাথা নস্ট করার ধান্দায় থাকো নাকি তুমি? অন্যরকম ফিলিংস হয় তো !”
মৌনির মন বিক্ষিপ্ত করে তুলতে নিভ্রর এই কথাগুলো যথেস্ট ছিলো।তাই ফ্যালফ্যাল নয়নে সে তাকিয়ে আছে মৌনি নিভ্রর দিকে। নিভ্রর চোখে-মুখে খেলা করছে একরকম দুষ্টু খেলা। মৌনি অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
–”ক-ক-কেমন ফিলিংস হয় আপনার?”
–”বলা যাবে না। পরে তুমিই লজ্জা পাবে।”
এই সময়টার ফুরফুরে হাওয়াতে মৌনির চোখে-মুখে রাজত্ব করছে প্রবল আকারের লজ্জা। মৌনি জানে যে ওর ব্যবহার নিতান্ত ছেলেমানুষী ধরনের । কিন্ত মৌনি এটাও জানে যে ওকে সামলে নেওয়ার জন্য নিভ্র সবসময়ই থাকবে।
–”কিছু খাবে?”
প্রসঙ্গ পাল্টে নিভ্র বলে উঠলো। মৌনি মিহি কন্ঠে বললো,
–”কোকাকোলা খাবো।”
–”Wait! আমি নিয়ে আসছি।”
একথা বলেই নিভ্র চলে গেলো কোকাকোলা কিনতে। বেঞ্চে বসে তাই আনমনে পা দুলিয়ে যাচ্ছে মৌনি। সাথে গুণগুণ করে গানও গাইছে। ওর ধারনা এবার বোধহয় সবকিছু ঠিক হয়ে আসবে। আর কোনো ঝামেলা থাকবে না , থাকবেনা কোনো অস্বাভাবিকতা। হঠাৎই মৌনির ধ্যান ভাঙলো মোবাইলের রিংয়ের কারনে। কপাল ভাঁজ করে পাশে তাকালো মৌনি। বেঞ্চে নিভ্রর ফোন বেজে চলছে। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে , ”অনামিকা” নামটি। চিন্তার ভাঁজ পড়লো মৌনির মুখে। মনে চলছে ছোটখাটো এক বিদ্রোহ। কল রিসিভ করবে নাকি করবেনা।
পরপর দুবার কল যখন কেটে গেলো তৃতীয়বারের সময় কল রিসিভ করলো মৌনি। তখনই পাশে দেখে ভেসে এলো এক মেয়েলি কন্ঠস্বর………….
–”নিভ্র ! আমায় এভোয়েড কেন করছিস তুই? তোর ইগ্নোরেন্স আমি সহ্য করতে পারছি না।”
মৌনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো অনামিকা নামের এই মেয়েটির কথা শুনে। গলার আওয়াজ বের হওয়া যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওপাশ থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো অনামিকা। তারপর বললো,
–”সবসময়ের মতো আজও চুপ করে থাকবি? দোষটা কি আমার? এটাই যে আমি তোর ফ্রেন্ড হয়েও তোকে ভালোবেসে ফেলেছি? তাহলে শুনে রাখ ! আমি আগেও বলেছি এখনও বলবো , ”I Love you Nivro! I Love you very much !”
অনামিকা কথাগুলো মৌনির বুকে বিষাক্ত কাটার মতো বিঁধলো। প্রচন্ড অস্থির অনুভব হচ্ছে ওর। মনে আবারও ঢুকে গেলো নিভ্রকে হারানোর প্রবল ভয়। ইচ্ছে করছে অনামিকা নামের মেয়েটিকে নিজের ক্রোধের আগুনে ভস্ম করে ফেলতে। কে এই মেয়েটা? নিভ্রর অতি কাছের কেউ? সেও কি তবে মৌনির মতো নিভ্রর পার্সোনালিটিতে দুর্বল হয়ে পড়েছে?
–”কি হলো নিভ্র কথা বলছিস না কেনো? প্লিজ কিছু বল না। আমি জানি তোর কোনো প্রেমিকা নাই। তবে আমায় মেনে নিতে সমস্যা কি তোর?আমিও ডক্টর ! তুইও ডক্টর। ভেবে দেখ আমরা খুবই সুন্দর একটা লাইফ লিড করতে পারবো। ”
আর কোনো কথা শোনার মতো সাহস মৌনির কাছে নেই। এই ফুরফুরে পরিবেশটা মৌনির কাছে এখন বিষাক্ত লাগছে। মেয়েটার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছলো যে নিভ্রকে অনেকদিন ধরেই পছন্দ করছে সে। আর নিভ্র? সে কি তবে মেয়েটাকে না মেনে মৌনিকে আগলে নিলো? নাকি অন্যসব ছেলেদের মতো নিভ্রও…………..
আর কিছু ভাবলো না মৌনি। সিজোফ্রেনিয়ার প্রবলেমটা আবারও শুরু হয়েছে স্ট্রেস নেওয়ার কারনে। তাই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসছে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো মৌনি।
এরই মধে নিভ্র এসে পড়লো কোকাকোলা নিয়ে । মৌনির হাতে নিজের মোবাইল দেখে অবাক হয় বেশ। মৌনি নিভ্রর দিকে না তাকিয়েই বললো,
–”অনামিকা নামের একজন মেয়ে কল করেছিলো।”
অবাকের তীব্রতাটি আরও গভীর হলো নিভ্রর মুখে। তাই মৌনিকে বললো,
–”তুমি রিসিভ করেছিলে?”
–”হ্যাঁ।”
আর কিছু বুঝতে হলো না নিভ্রকে। যা বোঝার বুঝেই গিয়েছে। এখন শুধু এটা দেখতে হবে মৌনি কেমন রিয়্যাক্ট করে। কিন্ত নিভ্রকে পুনরায় অবাক করে মৌনি কিছুই করলো না। স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো ,
–”আমি বাসায় যেতে চাই। আমার ভালোলাগছে না।”
নিভ্র তাই প্রতিউত্তরে বললো , ”আচ্ছা ঠিক আছে।”
সারাটা রাস্তায় দুজনের মধ্যেই ছিলো পিনপন নীরবতা। না মৌনি কথা বলেছে , না নিভ্র কথা বলার চেষ্টা করেছে। নিভ্র ঠান্ডা মাথার মানুষ। মৌনির মানসিক অবস্থা অন্য পাচঁজনের মতো স্বাভাবিক না তাই বিষয়টা ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে সামলাতে হবে। তারজন্য আগে জানতে হবে যে অনামিকা কি কি বলেছে।
গাড়িটা মৌনির বাসার সামনে দাঁড়াতেই মৌনি বাকশূণ্য হয়ে চলে গেলো বিল্ডিং এর ভেতরে। একপলকও নিভ্রর দিকে তাকালো না। হয়তো নিজের ঝড়টা নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে।নিভ্র নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে থাকলো সেপানে। মৌনির অবস্থাটা ঠিক আন্দাজ করতে পারলোনা সে। এর জন্য প্রয়োজন অনামিকার সাথে একটু কথা বলার।
৩৪.
–”মৌনিকে পালাতে তুই সাহায্য করেছিলি মৃধা?”
গোসল সেরে সবেমাত্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৃধা চুল মুছছিলো। আচমকাই শুনতে পেলো রিদানের গম্ভীর গলা। বুকটা ধক করে উঠেছে মৃধার। অনেকটা চিন্তায় ; অনেকটা আতঙ্কে।একবুক সাহস নিয়ে পিছে ফিরলো । রিদানের চিরচেনা সেই মোহনীয় মুখ। তবে এই মুখের আড়ালে রিদানের আদৌ কি কোনো ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা আছে?
–”কি হলো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। মৌনিকে পালাতে তুই help করেছিলি?”
মৃধা অকপটে প্রতিউত্তরে বললো ,”হ্যাঁ।”
সত্যটা না বলে মৃধার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না। দুপুর পেরিয়ে বিকেল ঢলে পড়েছে। সেই সাথে সূর্যের আলোর তীব্রতাও হয়েছে মৃদু। এমতাবস্থায় রিদানের প্রতিক্রিয়া মৃধা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলো না। রিদানকে এখন মনে হচ্ছে রহস্যময় থেকেও বেশি রহস্যময়।
রিদান মৃধার উত্তর শুনে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। হয়তো নিজের রাগ দমানের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ডান হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিতেই রিদানের কপালে সেই কাটা দাগটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। রিদানের ৮ বছর বয়সে মায়ের ক্রোধের শিকার হয়ে এই দাগটি হয়েছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে বিক্ষিপ্ত কন্ঠে মৃধাকে বলে উঠলো,
–”কেনো করলি এমন?”
–”কারন মেয়েটার সাথে তুমি ঠিক করছিলে না।”
–”কি ভুল করেছিলাম আমি?”
চিৎকার করে বলে উঠলো রিদান। রাগের তীব্রতাটা এতই বেশি যে কপালের রগটা ফুলে উঠেছে। ফর্সা মুখটা হয়ে উঠেছে লালচে ধরনের। মৃধা পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি মেঝের দিকে।
–”ওই মেয়েটাকে আমি বারবার সাবধান করেছিলাম যে রাজনীতির জালে পড়ো না। আমরা আমাদের কাজ করবো আর মেয়েটা নিজের। বাট ও কি করলো? মিনিস্টার জহির শেখের এগেইন্সট প্রুফ কালেক্ট করলো। আমি বলেছিলাম ওগুলো আমার হাতে দিয়ে দিলেই ও বেঁচে যাবে। কিন্ত না। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো চট্টগ্রামে।”
এতটুকু বলেই থেমে গেলো রিদান। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। মৃধা একটা মৃদু হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো রিদানের কাছে। তারপর চোখে চোখ রেখে বললো……….
–”মামা তোমার চোখে অন্ধপট্টি দিয়ে রেখেছে দাভাই ! নিজের চোখ খুলো। সবকিছু বোঝার চেষ্টা করো।”
মৃধার কথায় রিদান অবাক হয়ে তাকায় মৃধার দিকে। মৃধার শ্যামবর্ণের চোখে দেখা যাচ্ছে একরাশ তীক্ষ্ণতা।
–”এভাবে অবাক হয়ে তাকানোর কিছুই নাই। আমি সত্যই বলছি। মামী মারা যাওয়ার পর থেকে মামাই তোমার জন্য সবকিছু ছিলো। আর সেই সুযোগটা লাগিয়েই তোমায় দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করেছে সে। যতই সে আমার মায়ের ভাই আর আমার মামা হোক না কেন ; একজন বাবা , একজন মিনিস্টার , একজন দায়িত্ববান মানুষ হতে ব্যর্থ সে। সাথে তোমাকেও পাষাণ বানিয়ে রেখেছে।”
–”মুখ সামলে কথা বল মৃধা।”
–”এতদিন মুখ সামলেই কথা বলেছি দাভাই ! আর না।”
চিৎকার করে বলে উঠলো মৃধা। আর সহ্য করতে পারছে না। রিদানকে তার ভুল ধরিয়ে দিতেই হবে।
–”তুমি ভালোমন্দ বিবেচনা না করে অন্ধভক্তের মত মামার প্রতিটা কথা শুনেছো। সাথে তোমার স্বার্থ তো আছেই। শত শত বস্তি উজাড় করেছো , খুন খারাপি , মামার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তাকে কখনোই তুমি ছেড়ে দিতে না। কত মানুষের কাছ থেকে তার বাবা, ভাই , মা ছিনিয়ে নিয়েছো বলতে পারবে? আফসোস ! আজও তুমি এর শাস্তি পাবে না।রাত বিরাতে বারে ড্রিংক করে উন্মাদের মতো সেখানকার থার্ড ক্লাস মেয়েদের সাথে ফূর্তি করতে তখনও মামা তোমায় কিছু বলেনি। সত্যি কথা কি জানো?মৌনি আপুর জন্য তোমার যেই আচরণ ছিলো তাতেই বুঝতে পারি তুমি পশুর থেকেও অধম। তোমাকে কখনোই ভালোবাসা যায়না।”
রিদান স্তব্ধ। শেষ কথাটি তীরের মতো গিয়ে যেন তার হৃদয়ক্ষরণ করেছে।
–”আর কি যেন বলছিলে? মৌনি আপুর কথা , তাই তো? তবে শুনে রাখো। মৌনি আপু আজ তোমার করা একটা ভুলের জন্যই সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছে।”
–”ত-তুই কিভাবে জানিস !”
–”ড্রিংক করে যেদিন ঘরে মাতলামি করেছিলে সেদিন। তোমাকে তো তোমার ভুলের মাসুল দিতেই হবে। কি করেছিলো আপু তোমার? যে মামার কথা শুনে না জেনে না বুঝেই এত ভয়ঙ্কর রোগের একটা ডোজ দিয়ে দিলে?”
–”আমি আ-আমি আসলে……………”
রিদান বাকরুদ্ধ। মৃধার প্রতিটা কথাই ঠিক। হ্যাঁ মৃধা ঠিক করেছে মৌনিকে পালতে সাহায্য করে। আর রিদান যেটা করেছে সেটা ভুল। বিশাল একটা ভুল।
সময় চলে যাচ্ছে নিজগতিতে। বিকেল ঢলে আস্তে করে নামছে সন্ধ্যা। তবে দুজনের মধ্যেই এই লম্বা সময় ছিলো গম্ভীরতা। রিদান ভারসামহীনভাবে সোফায় বসে আছে। চোখের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। আর মৃধাও বেশ নীরব। তখনই রিদান বলে ওঠলো ,
–”আমি ভুল করেছি রে মৃধা। আমি কখনোই কারও ক্ষমাযোগ্য মানুষ না !”
রিদানে অস্ফূটকন্ঠ শুনে বেশ অবাক হলো মৃধা। ও স্পষ্ট দেখতে পারছে রিদানের চোখে-মুখে হতাশা।মৃধাকে অবাক করে একটা চরম কাজ করে ফেললো রিদান। মৃধার কাছে গিয়ে আচমকা জরিয়ে ধরলো ওকে।
মৃধা এবার বরফের ন্যায় শক্ত হচ্ছে আছে। চোখ-মুখ হয়ে উঠেছে ফ্যাকাশে। কেনা মৃধা কখনোই কল্পনাই করতে পারেনি রিদান নিজ থেকে ওকে জরিয়ে ধরবে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে তাই বলে ওঠলো,
–”দা-দা-দাভাই ! ক-কি করছো?”
–”আমি কি সত্যিই কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না মৃধা?মা মারা যাওয়ার পর বাবার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই তো বাবা যা বলতো তাই করতাম। আমি……….আমি এসব ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। কখনোই রাত বিরাতে বার, ড্রিংক এসব নিয়ে পড়ে থাকবো না। তবুও একথা বলিস না যে আমি কারও ভালোবাসা পাবো না।”
রিদানের জড়ানো কন্ঠ। মৃধা যেন এখনও স্তব্ধ হয়ে আছে এসব শুনে। তবে রিদান কি সত্যই এসব ছেড়ে দেবে?ভাবতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো মৃধার। রিদানকে আর এই অন্ধকার জগতে রাখবে না। নিয়ে যাবে সেখান থেকে বহু দূরে……………….
৩৫.
আধাঁরে ঢেকে গিয়েছে ঢাকা শহর। প্রতিটার ঘরের বৈদ্যুতির আলো ঢাকা শহরকে করে তুলেছে মায়ার এক নগরী। বারান্দায় রেলিং ঘেষে হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে মৌনি। এই মায়ার শহরকে আজ ওর বিষাক্ত মনে হচ্ছে। বুকে রয়েছে চাপা এক হাহাকার। ওই মেয়ের কথাগুলো মনে পড়তেই মৌনির অস্থির লাগতে শুরু করে। নিভ্রকে অবিশ্বাস করার ব্যাপার না এটা , এটা হলো মনের অন্তর্দ্বন্দের ব্যাপার।
ওই মেয়েটার কথাগুলো ভাবতেই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মৌনি। এককথায় প্রচন্ড হিংসে হচ্ছে। নিভ্রর সৌন্দর্য নিয়ে কেউ কথা বললেই মৌনি সেটা সহ্য করতে পারবে না আর ওই অনামিকা নামের মেয়েটা কি অবলীলয় না ”I Love You” বলে দিলো !
হঠাৎ কোথেকে ঝড়ের গতিতে বারান্দায় মৌনির নিকট আসলো নিভ্র। কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে। শার্টের উপরের দিকের কয়েকটা বোতাম খোলা। চুগুলোও বড্ড এলোমেলো দেখালো যা ওর শুভ্র মুখের সাথে বড্ড বেশি অমানানসই।
মৌনির প্রথমে মনে হয়েছিলো যে ওর হয়তো পুনরায় দৃষ্টিভ্রম হয়েছে তাই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিতেই নিভ্র উচ্চস্বরে বলে উঠলো ,
–”মোবাইল কোথায় তোমার?কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে?”
মৌনি আড়চোখে নিভ্রর দিকে তাকালো। তারপর সরল ভঙ্গিমায় বলে ওঠলো ,
–”একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম। তাই মোবাইল ভাইব্রেট করে রেখেছি।”
নিভ্র বুঝতে পারলো মৌনি স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও মনে চলছে উথাল পাতাল ঝড়। বাড়িতে রাত্রি আর রোদেলাও ছিলো বিধায় একটু দুশ্চিন্তামুক্ত ছিলো নাহলে এই পাগলী মেয়েটাকে কিছুতেই একা রাখা সম্ভব না। নিভ্রও মৌনির পাশে বসে পড়লো। বাকা চোখে মৌনির দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর উদাসীনতায় ভরা মুখ। একটা লম্বা শ্বাস ফেললো সে।
–”অনামিকা আমার ব্যাচমেট মৌনি । আমরা একসাথেই সাইকোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিগ্রি নিয়েছি।”
–”আমি কি একবারও জানতে চেয়েছি?”
মৌনির কঠোর গলা। ওর টলোমলো চোখের দিকে তাকিয়ে নিভ্র একগাল হাসে। তারপর মৌনির কাঁধে আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো সে।
–”তোমার মুখ বলছে এককথা আর মন বলছে অন্যকথা। হাজার চেষ্টা করো কিন্ত কখনোই তোমার সত্যিকারের ফিলিংস আমার থেকে লুকোতে পারবে না তুমি।”
–”মিথ্যে কথা।”
–”কি মিথ্যে কথা?”
–”আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। তবুও বলেন তো আমি এখন কি ভাবছি?”
ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ মৌনির দিকে তাকিয়ে থাকলো নিভ্র।তারপর বললো,
–”হিংসায় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছো তুমি। অনামিকা আমায় কল দিয়ে প্রোপোজ করেছে এটা তোমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছেনা।”
–”একমিনিট ! আপনি কিভাবে জানলেন যে ওই মেয়েটা এগুলো বলেছিলো?কল তো আমি রিসিভ করেছিলাম।”
–”অনামিকার সাথে আমি দেখা করে এসেছি?”
নিভ্রর কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো মৌনি। তারপর জোরালো গলায় বলে উঠলো ,
–”কি?”
–”অনামিকার সাথে আমি দেখা করে এসেছি।”
এবার যেন চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেলো মৌনির। রাগে , বিক্ষোভে নাকি কষ্টের এর উত্তর ওর জানা নেই। নিভ্রর বুকে কিল ঘুষি মারতে মারতে বললো ,
–”আপনি কেনো ওই মেয়েটার কাছে গিয়েছেন?আপনি জানেন না , অন্য কোনো মেয়ের সাথে আমি আপনাকে সহ্য করতে পারিনা।”
কান্না করতে করতে একপ্রকার হিচকি তুলে ফেলেছে মৌনি। একটা বাচ্চা যেমন তার প্রিয় জিনিসকে অন্যর নিকট সহ্য করতে পারে না মৌনির ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তেমনই। নিভ্র তাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় রেলিং ঘেঁষে মৌনির দিকে তাকিয়ে আছে। মৌনিকে এতটা অস্থির হয়ে যেতে দেখে শেষে বললো,
–”Relax মৌনি ! আগে আমার কথাটাতো শুনো। আগেই আমায় কিল-ঘুষি মারা শুরু করে দিয়েছো। নিজের ডাক্তারসাহেবকে মারতে তোমার একটুও কষ্ট হয়না বুঝি?”
নিভ্রর নিঃসংকোচ কন্ঠ। মৌনি তবুও কান্না করা থামালো না। অভিমানি সুরে বললো,
–”আপনি খারাপ হয়ে যাচ্ছেন । ওই মেয়েটা কেনো আপনাকে পছন্দ করবে?আপনি আগে বলেননি যে আপনি শুধু আমার মালাইয়ের কৌটা? অন্য কোনো বিড়াল আমার জিনিসে নজর দিতে পারবে না।”
নিভ্র শুধু পারছে না হোঁ হোঁ করে হেসে উঠতে মৌনির বাচ্চামো কথা শুনে। কান্নার কারনে নাক দুটো টমেটোর মতো লাল দেখাচ্ছে মৌনির। নিভ্র কিছুক্ষণ লোভনীয় চোখে মৌনির নাকটার দিকে তাকিয়ে ছিলো পরন্তু ঘোর কাটে মৌনির জড়ানো কন্ঠে…………..
–”ওই মেয়েটার কাছে কেনো গিয়েছিলেন আপনি?”
–”ওকে বলতে যে আমি শুধু আমার মৌনিপরীর মালাইয়ের কৌটো।”
দুষ্টুমির ছলে বলে উঠলো নিভ্র। মৌনি এবার কাদোঁ কাদোঁ স্বরে বললো,
–”দুষ্টুমি করেন না প্লিজ। বলেন না কেনো গিয়েছিলেন?”
মৌনিকে এতটা আবেগী হতে দেখে সচেতন হলো নিভ্র। ভুলে গেলে চলবে না যে মৌনির ”সিজোফ্রিনয়া” রোগ আছে।যদিও মৌনি আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছে তবুও কথা আছে না ”All is well so End is well” ! এখন যদি তীরে এসে তরী ডুবে যায় তবে ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে। তাই নিভ্র বলে উঠলো,
–”যা সত্য তাই বলেছি। অনামিকা আমার ফ্রেন্ড ছাড়া কিছুই না।”
মৌনি এবার বলে উঠলো , ”ওই বজ্জাত মেয়েটার সাহস কি করে হলো যে আমার ডাক্তারসাহেবের দিকে নজর দেয়? তুমি এত সুন্দর দেখেই তো ওই বদগুলা তোমার প্রেমে পড়ে তাইনা ! আজ তোমার সৌন্দর্য আমি সব শুষে নিবো।”
এরপর মৌনি যা করলো নিভ্র হয়তো কল্পনায়ও ভাবেনি যে এমন কিছু করবে। আচমকা নিভ্রর কোলে উঠে নিভ্রর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো মৌনি।
নিভ্র যেন স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে। নিভ্র চাইলে পারবে মৌনিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলতে কিন্ত এমন কিছু করলে আরও হাইপার হয়ে পড়বে ও। মৌনি ওর ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে ফেলছে তবুও যেন শান্ত হচ্ছে না। এমনভাবে নিভ্রর কালো ঘন চুলগুলো আকঁড়ে ধরেছে যা রীতিমতো ছিঁড়ে যাওয়ার মতো উপক্রম।
বেশ কিছুক্ষণ পর নিভ্রর ঠোঁটজোড়া থেকে সরে চুলগুলো আরও বেশি এলোমেলো রে দিলো। তারপর মৌনি বললো ,
–তোমার এমন বিক্ষত ঠোঁট আর পাগলাটে চুল দেখে কোনো মেয়ের সাহস হবেনা তোমার প্রেমে পড়ার।
নিভ্র অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নিষ্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মৌনির পাগলামির দিকে। রাতের গহীনে ঢাকার শহর ক্রমে নির্জীব হয়ে উঠেছে।বাতাস বইছে হু হু করে।নিভ্র বুঝে গিয়েছে নিভ্র আজ বাসায় যেতে পারবে না। সারাটারাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতে হবে মৌনিকে বুকে নিয়ে।
~চলবে
গল্পের প্রয়োজনের খাতিরেই মৌনি চরিত্রটা একটু ভিন্ন। স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলা মৌনির পাগলামি বৈশিষ্টটাই গল্পের মাধুর্য ধরে রেখেছে। যারা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে মৌনি আর নিভ্রর চরিত্রটা এতটা ভিন্ন কেনো , আশা করি উত্তর পেয়ে গিয়েছেন। গল্পের থিমটা যেহেতু ভিন্ন ; চরিত্রগুলো তো একটু আলাদা হবেই।
Previous part https://www.facebook.com/kayanaAfrin/posts/221704816417890