#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।
তনুকা দ্রুত পায়ে ঘরে গেল। মেহতাবকে ঘরে না পেয়ে গেল বারান্দায়। তনুকার উপস্থিতি টের পেয়ে চাইল মেহতাব। জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপার? এভাবে ছুটে এলে যে?’
তনুকা শ্বাস টানল। অস্থির সুরে বলল,
‘আমি বাগানে কাউকে দেখেছি।’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘কাকে?’
‘চিনতে পারিনি। ছায়া দেখেছি কেবল।’
‘হয়তো কোনো ভৃত্যের ছিল।’
‘না না, মহলের ভেতর ছিল সবাই। আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করে এসেছি।’
‘আহা বিবি, তাহলে হয়তো প্রহরী বা ইশফাক ছিল।’
‘উনাদের মধ্যে কেউ এই সময় মাটিতে উবু হয়ে বসে কী করবেন?’
মেহতাব বুঝল না। বলল,
‘মানে?’
তনুকা বলল,
‘সেই ছায়ামূর্তিটা তখন মাটিতে বসে কিছু একটা করছিল, আমি স্পষ্ট দেখেছি।’
মেহতাব চিন্তিত হলো। সে বলল,
‘আচ্ছা, আমি দেখছি। তুমি দাঁড়াও এখানে।’
মেহতাব ঘর ছেড়ে বাইরে এল। তনুকা বারান্দাতেই দাঁড়ান। বাগানের অভিমুখে মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে। তার পাশের লোকটা ইশফাক। কথা বলছে দুজন। মেহতাব হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বলছে। দূর থেকে তাদের মুখাবয়বের প্রতিক্রিয়া ঠাহর করা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদে মেহতাব আবার ঘরে ফিরে। তনুকাও তার নিকটে যায়। জিজ্ঞেস করে,
‘পেলেন কিছু?’
‘খোঁজ নিয়েছি, বিবি। সেই সময় বাগানে কেউ ছিল না। তুমি হয়তো ভুল দেখেছ।’
তনুকা বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘একটা মানুষ আর কত ভুল দেখবে, বলুন তো? সেই প্রথম থেকেই একই কথা বলে আসছেন, আমি ভুল দেখছি। অথচ, আমি জানি আমি যা দেখছি তা স্পষ্ট। কিন্তু, আপনি মানতে নারাজ।’
‘তবে তুমি যা দেখছ তা আমি কেন দেখতে পাচ্ছি না বলো তো? এতক্ষণ তো আমিও বারান্দাতেই ছিলাম; কই, কিছুই তো দেখলাম না।’
তনুকা দু কদম এগিয়ে এল। মেহতাবের অতি নিকটে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমার কি মনে হয় জানেন তো, আপনি হয়তো ইচ্ছে করেই দেখতে চান না। নয়তো আপনার মতো অমন তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা কারোর আছে না কি?’
মেহতাব হাসল। বলল,
‘আমার তো মনে হয়, আছে। কেউ একজন ভীষণ ক্ষমতাধর, সে আমার এই তীক্ষ্ণ চোখকেও অনায়াসে ফাঁকি দিয়ে চলছে।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কে সে?’
মেহতাব কাঁধ উঁচু করে বলল,
‘কী জানি।’
‘মজা করছেন আমার সাথে?’
‘হয়তো।’
মেহতাব বিছানায় বসল। তনুকা তার দিকে চেয়ে রইল এক ধ্যানে। এই লোকটাকে দেখে ক্ষুনাক্ষরেও কেউ টের পাবে না তার ভেতরে কী চলছে। এই সহজ হাসির আঁড়ালেও জটিল কোনো প্যাঁচ অবশ্যই আছে। যা এত সহজে ভাঙতে পারবে না তনুকা। তাকে আরো খাটতে হবে।
তনুকা এগিয়ে গিয়ে মেহতাবের শিউরে বসে। দু জনের পা ঝুলছে নিচের দিকে। মেহতাবের দৃষ্টি তনুকার ফরসা পায়ের পানে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি নূপুর পছন্দ করো?’
তনুকা মেহতাবের দৃষ্টি অনুসরন করে একবার তার পায়ের দিকে তাকায়। পরে বলে,
‘না, নূপুর আমার পছন্দ না।’
মেহতাব অবাক চোখে চেয়ে বলল,
‘নূপুর তোমার পছন্দ না? অথচ আমি জানি, নূপুর তোমার ভীষণ পছন্দ।’
‘কী করে জানলেন? কে জানাল এই কথা?’
মেহতাব ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
‘বলেছিলাম না, তোমার সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি। শুনো, কাল তোমায় নূপুর কিনে দিব। খালি পা মানাচ্ছে না একদম।’
তনুকা কিছু বলল না। এত সব ঝামেলার মাঝেও লোকটার হৃদয়ে এত হৃদয়বৃত্তি কোথ থেকে আসছে কে জানে? মেহতাব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার আচমকা প্রশ্ন করল,
‘আমার ভাইকে তোমার কেমন লেগেছে?’
তনুকা ভড়কে যায় এহেন প্রশ্নে। অপ্রস্তুত ভঙিতে বলে,
‘কেমন লাগার কী আছে? আপনার ভাই যেহেতু ভালোই হবে।’
মেহতাব হাসল তার উত্তর শুনে। বলল,
‘আমার ভাই মানেই যে ভালো হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। খারাপও হতে পারে।’
তনুকা মাথা নোয়াল। কেন যেন এসব নিয়ে কথা বলার কোনো আগ্রহ পেল না সে। মেহতাব নিজ থেকেই বলল,
‘আমার আশেপাশের শত্রু সংখ্যা বাড়ছে, বিবিজান। তাই বলে কিন্তু আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। তবে, দুশ্চিন্তা আমার একটা আছেই। আর সেটা হলে তুমি। জানো, এখন অবধি আমার নিকট সবথেকে মূল্যবান বস্তু আমার এই ক্ষমতা; এই ক্ষমতা ধরে রাখতে আমি সব করতে পারব। তবে, যদি ক্ষমতাকে তোমার সাথে তুলনা করা হয়, আমার কাছে তুমিই শ্রেষ্ঠ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে কেবল আমার বিবিজান।’
তনুকা বাকরুদ্ধ। নির্নিমেষ চাহনি তার। মেহতাবের কথার সুরে হারিয়ে গিয়েছে। সত্যিই মানুষটা এত ভালোবাসে তাকে? তাকে পেতে সবকিছু ছেড়ে দিতে পারবে? এত ভালোবাসা? তনুকা বিস্মিত। মেহতাব বলল,
‘কিছু কি বলতে চাও, বিবি?’
তনুকা পলক ফেলে অন্যদিকে চাইল। অনেকক্ষণ ভাবল, সে আদৌ কিছু বলতে চায় কি না। কিন্তু, জবাব পেল না কোনো। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘না।’
উত্তর পেয়ে আশাহত হলো মেহতাব। তবে কি কোনোভাবেই সে তার বিবিজানের মন পাবে না? সব কষ্ট বৃথা যাবে তার?
__________
‘আমার মাধ্যমিকের পর আমরা বিয়ে করব।’
‘অসম্ভব।’
‘কেন অসম্ভব?’
‘আপনার ভাইজানেরা মানবেন না।’
‘আমি মানাব তাঁদের।’
‘পারবেন না, অযথা ঝামেলা বাড়বে।’
‘সব ঝামেলা সহ্য করে নিব আমি। আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন, তাহলেই হবে।’
ইশফাক অসহায় চোখে চাইল। বলল,
‘পারব না আমি, রেনু। বোঝার চেষ্টা করুন।’
‘মানুষ চাইলে সব পারে। আপনিও পারবেন। আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করবেন না।’
‘আপনার ভাইজানদের আপনি চিনেন না, জানে মে’রে ফেলবেন আমাদের।’
‘মে’রে ফেলুক, ম’রার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনাকেই চাইব।’
‘আপনি বড্ড নাছরবান্দা, রেনু। আপনার জন্য সারাক্ষণ আমাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়; মনে হয়, এই বুঝি আপনার ভাইজান দেখে ফেললেন আমাদের।’
‘আপনার কলিজা তো এইটুকু, এইজন্যই এত ভয়।’
ইশফাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনি ভেতরে যান। এখন মহলে আবার আপনার ছোট ভাইও আছেন। বিপদ দ্বিগুণ। ভেতরে যান দ্রুত।’
‘আমি কল চেপে দিচ্ছি, আপনি হাত ধুয়ে নিন।’
‘না, আমি পারব।’
‘আহা, বললাম তো আমি করব।’
রেনুর জবরদস্তিতে পরাস্ত হয়ে ক্ষান্ত হলো ইশফাক। রেনু কল চাপতে আরম্ভ করল অর ইশফাক হাত ধুতে। রেনু জিজ্ঞেস করল,
‘এই সময় মাটি দিয়ে কী করছিলেন আপনি? আপনার পাজামা আর পায়েও মাটি লেগে আছে।’
ইশফাক জবাবে বলল,
‘আমার ঘরে ফুল গাছ লাগিয়েছি একটা।’
রেনু খুশি হয়ে বলল,
‘তাই? কী ফুল।’
‘গোলাপ।’
রেনু আবেগাপ্লুত সুরে বলল,
‘আমার পছন্দের ফুল। ধন্যবাদ।’
ইশফাক হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘আপনার পছন্দের জানলে লাগাতাম না।’
রেনু ভেংচি কেটে হাসল। বলল,
‘বুঝি বুঝি, আমি সব বুঝি।’
ইশফাক বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
‘বেশি বুঝেন আপনি, যান ভেতরে যান।’
রেনু এগিয়ে গিয়ে ইশফাকের নাক টেনে দিল ভো দৌড়। ইশফাক হতভম্ব তার কাজে। নাকে হাত বুলিয়ে বিরবির করে বলল,
‘আস্ত এক বাঁদর হয়েছে মেয়েটা।’
নাচতে নাচতে অন্দরে গিয়ে ধাক্কা খেল তনুকার সাথে। বাবার মৃ’ত্যুর পর আজই রেনুকে একটু হাসতে দেখেছে তনুকা। তারও ভালো লাগল তাই। জিজ্ঞেস করল,
‘কোথ থেকে ছুটে আসা হচ্ছে শুনি?’
রেনু সতর্ক দৃষ্টিতে একবার আশেপাশে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘কলপাড় থেকে।’
‘এইসময় কলপাড়ে কেন গিয়েছিলে?’
‘ইশফাক ছিল যে, তাই।’
‘মানে সব জায়গা ছেড়ে এখন কলপাড়ে গিয়ে প্রেমিকের সাথে দেখা করা!’
‘না না, দেখা করা না। উনি তো হাত ধুতে গিয়েছিলেন, আমি উপর থেকে দেখে সুযোগ বুঝেই চলে গিয়েছি। পরে আমি বউদের মতো করে কল চেপেছি, আর উনি হাত ধুয়েছেন। জানো, উনি না কি আমার জন্য গোলাপ গাছ লাগিয়েছেন। সেইজন্যই তো বেচারার হাত, পা, জামা সব মাটি ভরে একাকার ছিল।’
তনুকা হেসে কিছু বলতে গিয়েও থামল হঠাৎ। প্রশ্ন করল,
‘ইশফাক ভাই কি সেই মাটি ধুতেই কলপাড় গিয়েছিলেন?’
রেনু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ।’
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️