প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৫।

0
48

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।

সূর্যখানা উঁকি দিয়েছে সবে। বাইরে পরিষ্কার আলো। বাগানের গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। একটু আঁড়ালেই দাঁড়ান দুইজন মানব মানবী। জরুরি আলোচনা চলছে হয়তো তাদের মাঝে। চোখে মুখে দারুণ চিন্তার ছাপ। কপালেও ভাঁজ পড়েছে বেশ। এরপর পরিবেশটা আরেকটু ফকফকা হতেই পুরুষ লোকটি দ্রুত চলে গেল মহলের ভেতর।

ইশফাক ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়। দীঘির জলে গোসল সেরে বিচার মহলে যেতে হবে। তাই দ্রুত সব কাজ সারে। গোসল শেষ করে গায়ে গামছা জড়িয়ে তার কক্ষ বরাবর আসতেই তনুকাকে দেখতে পায়। এই অসময়ে তার ঘরের সামনে তনুকাকে দেখে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে সে। গামছাটা ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে ইতস্তত সুরে বলে,

‘বউমনি, আপনি?’

তনুকা ফিরে তাকায়। সদ্য গোসল সারা ইশফাককে দেখে আবার উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায় সে। বলে,

‘আপনি কাপড় পরে আসুন; কথা আছে।’

ইশফাক কথামতো দ্রুত কাপড় গায়ে বাইরে এল। জিজ্ঞেস করল,

‘কিছু হয়েছে, বউমনি?’

তনুকা আবার চাইল। কিঞ্চিৎ হাসল সে। ভদ্রতা দেখাতে ইশফাকও হাসল ক্ষীণ। তনুকা বলল,

‘আপনি নাকি আপনার ঘরে গোলাপ লাগিয়েছেন?’

ইশফাক আঁতকে ওঠে। এমন ভাবে তাকায় যেন, চোখ তার এখনই বেরিয়ে আসবে। এই কথা বউমনি কী করে জানল? তনুকা তার ভীত মুখশ্রী দেখে হাসল খুব। বলল,

‘ভয় পাবেন না, রেনু সব বলেছে আমায়।’

ইশফাক ঢোক গিলে। এই রেনু মেয়েটা দেখি আস্ত এক আহাম্মক। এভাবে বউমনিকে সব বলে দিল? এবার বুঝি সত্যিই জান যাবে তার। তনুকা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘বললাম তো, ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আমি কাউকে কিছু বলব না। আপনি স্বাভাবিক থাকতে পারেন।’

ইশফাক কী বলবে বুঝতে পারছে না। মাত্রাধিক অস্বস্তি আর লজ্জায় রা হারিয়েছে। তনুকা ফের জিজ্ঞেস করে,

‘রেনুর জন্য নাকি গোলাপ গাছ লাগিয়েছেন? ও আমাকে দেখতে পাঠাল।’

‘রেনু পাঠিয়েছে?’

‘জি।’

ইশফাক বিস্মিত হয়। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,

‘কোনো গাছ আমি লাগাইনি, বউমনি। ওটা শুধু রেনুকে খুশি করতে বলেছিলাম।’

তনুকা এক পল ভেবে প্রশ্ন করে,

‘সত্যিই লাগাননি?’

‘না। বাগানে এত গাছ থাকতে ঘরের ভেতরে লাগিয়ে কী লাভ?’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। বলল,

‘হ্যাঁ, তাও ঠিক।’

‘দয়া করে এটা রেনুকে জানাবেন না। মেয়েটা কাল খুশি হয়েছিল, আমি ওর খুশি নষ্ট করতে চাই না।’

তনুকা নিমিষ কিছুক্ষণ চেয়ে বলল,

‘রেনুকে ভালোবাসেন?’

এমন প্রশ্নে ভড়কাল ইশফাক। ইতস্ততও হলো ভীষণ। কথা ঘুরাতে বলল,

‘আপনি এখন মহলে যান, বউমনি। ভাইজান উঠার সময় হয়েছে যে।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি।’

‘অন্য কোনোদিন দিব, আজ থাক।’

‘ঠিক আছে। তবে, সেই অন্য কোনোদিন কেবল এই এক প্রশ্নের উত্তর দিলেই চলবে না, আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এখন থেকেই তাই প্রস্তুতি নিতে থাকুন।’

তনুকা মহলের দিকে পা বাড়াল। ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে ভাবল, সে আবার ধরা পড়ে গেল না তো?

________

ডাইনিং এ খেতে বসেছে সবাই। আজ অনেকদিন পর ছোটো কাকাও বসেছেন সবার সঙ্গে। মেহতাবের নিষেধের পর তিনি আর বসেননি। আজই প্রথম বসেছেন। বরাবরের মতোই বড়ো কেদারাতে মেহতাবের স্থান। সে আয়েশ করে বসেছে তাতে। রাদাভ বসেছে তার উল্টো দিকের চেয়ারে। ভাইকে নির্নিমেষ চেয়ে দেখছে। এর মাঝেই খাবার সব বাড়া শেষ। সকলে বসে পড়েছে। তনুকা বসে আছে রাদাভের মুখোমুখি চেয়ারটাতে। তার পাশেই রেনু। মেয়েটা তাড়াতাড়ি খাচ্ছে, আজ স্কুলে যেতেই হবে। আর কিছুদিন পর থেকে যে মাধ্যমিক শুরু। তনুকার খাবার গতি অতিশয় ধীরস্থির। রাদাভ খাওয়ার মাঝেই বলল,

‘তোমার লোকদের মাঝে কি কাউকেই এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভাইজান?’

মেহতাব একপলক চাইল। জবাব দিল,

‘একজনকে তো মৃ ত পেয়েছে তবে, অন্যজন এখনো নিখোঁজ।’

‘পুলিশ এখনো একটা জলজ্যান্ত মানুষকে খুঁজে বের করতে পারছে না। কেমন ভাবে কাজ করছেন উনারা? তুমি তাগাদা দিচ্ছ না?’

‘যতটুকু তাগাদা দেওয়ার দিচ্ছি। এরপর বাকিটা উনাদের হাতে।’

‘আমার মনে হয় কি, আমাদের সিকিউরিটি আরেকটু বাড়ানো উচিত।’

‘হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।’

এইটুকু বলে মেহতাব ছোট কাকা মতিব মজুমদারের দিকে চাইল। ভ্রু কুঁচকাল সঙ্গে সঙ্গে। বলল,

‘কাকা, আপনি কার অনুমতিতে আবার টেবিলে বসেছেন?’

আচমকা এমন প্রশ্নে নিবৃত্ত দেখাল মতিব মজুমদারকে। তিনি কী বলবেন বুঝতে পারেন না। তাই বোকার মতো হেসে বললেন,

‘না, আসলে ঐ রাদাভ বলেছে, তাই।’

রাদাভ জিজ্ঞেস করল,

‘কেন ভাইজান? ছোট কাকা আমাদের সাথে বসে কেন খেতে পারবেন না?’

রাহীলা সুযোগ পেলেন। নাক মুখ ছিটকে বললেন,

‘আমাদের কি আর এই সংসারে কোনো দাম আছে? আমরা তো এই সংসারের ফেলনা কেবল, তাই তো এত অবহেলা।’

মেহতাব মুখের খাবারটা গিলে সোজা হয়ে বসল। রয়েসয়ে বলল,

‘নিজেদের কাজে-কর্মেই ফেলনা হচ্ছেন; কেউ জোর করে আপনাদের ফেলনা বানাচ্ছে না।’

অপমানে মুখ থমথমে হলো রাহীলার। আর কোনো কথা বললেন না। মেহতাব বলল,

‘রাদাভ বলেছে বলে আর কিছু বললাম না। পরের বার যেন আমার কথার কোনো হেরফের না হয়।’

_______

বিচার মহলের নিস্তব্ধ পরিবেশ। মেহতাবের কপালে হাত। চোখ বোজা। তার পাশের একটা চেয়ারে রাদাভ। বিরক্ত ভঙিতে বসে আছে কেবল। এই চেয়ারখানা মোটেও পছন্দ হয়নি তার, মুখের ভাবমূর্তি তাই বলছে। জনগনের অভিমুখে একজন ছেলে দাঁড়ান; অপর পাশেই কালো বোরকা পরিহিতা এক মেয়ে। মেয়েটির পুরো শরীর বোরকার আঁড়ালে হলেও চোখ দুটি দৃশ্যমান। সেই চোখের শ্রান্ত দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে, সে এই মুহুর্তে ঠিক কতটা ভীত। মেহতাব চোখ মেলে তাকায়। ছেলে মেয়ে দুইজনকে পরখ করে বলে,

‘বিয়ের পরও অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক এক ঘৃণ্য অপরাধ। এর শাস্তিও ভয়ানক। আমি চাই না আমার গ্রামে এইসব জঘন্য অপরাধ আর হোক। আজ এই মেয়ের শাস্তি দেখে প্রত্যেকে শিক্ষা নিবে যে, পরকীয়ার শাস্তি কতটা ভয়ংকর। ভবিষ্যতে এমন কাজ করার আগে হাজারবার ভাববে সবাই। এখন আপনারাই বলুন, আপনারা কী চান; মেয়েটা শাস্তি পাক?’

উপস্থিত সকলে সমস্বরে বলে উঠে,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চাই।’

এমনকি মেয়ের পরিবারের মানুষও একই কথা বলে। মেহতাব নিশ্বাস ফেলে। ইশফাককে হুকুম দিয়ে বলে,

‘উনাকে নিয়ে বড়ো মাঠের মাঝখানে বাঁধো।’

মেয়েটি ভয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। অনেক আকুতি মিনতি করে, তাও মন গলে না পাষাণ জমিদার মেহতাব মজুমদারের। সবকিছুর ছাড় হলেও, কোনো বিশ্বাসঘাতকের ছাড় তার কাছে নেই। তার হুকুম মতোই করা হলো সব। মেয়েটাকে বাঁধা হলো মাঠের মাঝখানে। মেহতাব গাছের ছায়ার নিচে আরাম করে বসেছে। এবার হুকুম দিয়েছে, পাথর নিক্ষেপ করার। উপস্থিত গ্রামবাসী বিদ্বিষ্ট মনে তাই করল। একের পর এক নিক্ষিপ্ত পাথরে ক্ষত বিক্ষত হলো মেয়েটার শরীর। র ক্তে রক্তিম হলো সারা গা। একসময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল মেয়েটা। মেহতাব উঠে দাঁড়াল এরপর। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

‘এবার বাড়ি যান আপনারা। মনে হচ্ছে না আর বাঁচবে বলে। মা রা গেলে দাফনের ব্যবস্থা আমি করব। আর মেয়েটার পরিবারের লোকেরা যেন কোনো আফসোস না করে। কোনো পাপীর জন্য কখনো আফসোস করতে নেই।’

মেহতাবের কথা মতো অজ্ঞান অবস্থাতেই মেয়েটাকে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া হলো। কোথায় নিয়ে গিয়েছে সেটা মেহতাব আর ইশফাক ছাড়া কেউ জানে না। রাদাভ ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

‘মেয়েটাকে মে রে ফেলার কি খুব দরকার?’

মেহতাব চেয়ে জবাব দেয়,

‘অবশ্যই। আমার গ্রামে কোনো বিশ্বাসঘাতকের জায়াগা নেই।’

শেষের উক্তিতে যেন একটু কঠিন শোনাল মেহতাবের স্বর। রাদাভ আর ঘাটাল না। যা খুশি সে করুক, তাতে তার কী? কেবল তার উদ্দেশ্য সফল হলেই হলো।

চলবে…..

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here