প্রাণেশ্বর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪২।

0
63

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।

এমন ভয়ানক কুৎসিত মৃত্যু রাদাভ লাস্ট একটা সিরিজে দেখেছিল হয়তো, আজ আবার দেখছে নিজের চক্ষু সম্মুখে। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছে তার। পেট উগলিয়ে খাবার সব গলায় আটকে আছে। একটু ফুরসত পেলেই যেন বেরিয়ে আসবে। সে কস্মিনকালেও ভাবেনি যে, মেহতাব মজুমদার এত জঘন্য ভাবে মানুষ খু ন করতে পারে।

মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। শরীরে লেপ্টে থাকা র ক্তগুলো টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বলে উঠে,

‘আজকের এই ঘটনা যেন আমার বিবিজানের কান অবধি না যায়। যদি যায় তবে, ভাই বলে কিন্তু তুই মাফ পাবি না।’

ইতিমধ্যেই রাদাভের গলা শুকিয়ে কাঠ। খাবারগুলো দলা পেঁকে গলাতেই আটকে আছে যেন। চোখের সামনে র ক্তের এই বন্যা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। তারপর শরীরের এই খন্ড খন্ড অংশগুলো। রাদাভ আর নিতে পারল না। সে মুখে হাত চেপে দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মেহতাব এই কান্ড দেখে বিরক্ত হয়। বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

‘এই সাহস নিয়েই এসেছে আবার মেহতাব মজুমদারকে পরাজিত করতে; বোকা ছেলে!’

রাদাভ যতক্ষণে বেরিয়ে আসল ততক্ষণে মেহতাবের সব কাজ শেষ। রাদাভ বেরিয়ে দেখল ঘর একদম চকচকে ফকফকে। মেহতাব নিজেও একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। একটু আগেই যে এই মেঝে র ক্ত আর মানুষের খন্ড বিখন্ড শরীরে অংশেতে ভেসে যাচ্ছিল তা এখন ক্ষুনাক্ষরেও টের পাবে না কেউ। রাদাভ রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

‘এসব কে পরিষ্কার করেছে, ভাইজান?’

‘করেছে কেউ, তোর জেনে কাজ নেই।’

রাদাভ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। মেহতাব বলল,

‘আমার কথাটা মনে থাকবে তো, তনু যেন কিছুই জানতে না পারে।’

রাদাভ মাথা কাঁত করে জানাল,

‘হ্যাঁ, মনে থাকবে।’

‘চল এবার, বেরুতে হবে।’

মেহতাব ঘর ছেড়ে বের হলো, তার পেছন পেছন বের হলো রাদাভও। আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখল একবার। তেমন কোনো বাড়ি ঘর নেই। বেশ গাছপালা দিয়ে বেষ্টিত জায়গাটা। পুরোনো ভাঙা ঘর, ঘরের ভেতর যে এত বিদঘুটে সব কাজ হয় বাইরে থেকে দেখে তা বোঝা মুশকিল। রাদাভকে নিয়ে মেহতাব তার গাড়িতে বসল। ইশফাক আসেনি বলে, মেহতাব’ই ড্রাইভিং সিটে বসেছে। রাদাভ স্তব্ধ। ঘটনাগুলো এখনো মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। মেহতাব তাকে একবার পরখ করে বলল,

‘কীরে, এখনো ভয় পাচ্ছিস?’

রাদাভ চাইল। উত্তরে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘উনাকে না মা রলেও পারতে, ভাইজান। ভাবি একদিন না একদিন ঠিকই জানবেন।’

‘জানুক তবে, সেটা যেন তোর মুখ থেকে না হয়।’

রাদাভ নিশ্বাস ফেলল। চোখ বোজে হেলান দিল সিটে। আর কিছু আপাতত ভাবতে পারছে না সে। মেহতাবের এই রূপ সে কখনোই ভুলতে পারবে না। আজ এক ভয়ংকর মেহতাবকে দেখেছে সে।

_____

মেহতাব আর রাদাভ যখন বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন তনুকাও সেই ঘরেতেই ছিল। তাদের উপস্থিতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। রাদাভ কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। মেহতাব এসে সোফায় বসল। তনুকা বুঝতে পারছে না কিছু। রাদাভকে অদ্ভুত লেগেছে। তবে, মেহতাবকে ফুরফুরে লাগছে যেন। সে তাই মেহতাবকে জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা? নাস্তাও করে যাননি।’

‘একটা জরুরি কাজ সেরে এলাম। নাস্তা খাবার টেবিলে দাও, আমি আসছি।’

তনুকা আর প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ পেল না। মেহতাবের কথা মতো নাস্তার আয়োজন করতে গেল সে।

আজ সকালে গোসল সেরে বের হয়নি বলে মেহতাব এখন গোসল সেরেছে কেবল। গায়ে গামছা জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভেজা চুল মুছছে এক হাতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তা ইশফাকের মহলের দিকে। ইশফাক তার বিশ্বস্ত সহকারী। সে তাকে কখনোই ঠকাবে না, এইটুকু সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। তবে, তনুকা কেন কাল ইশফাকের ঘরে গিয়েছিল? কেন সত্যি বলতে পারছিল না সে? আর কত কিছু লুকিয়ে যাবে? সে কি বোঝে না, যত মিথ্যে তত বিপদ। মেহতাব মজুমদার যে মিথ্যে মোটেও পছন্দ করে না।

মেহতাব চুল মুছে ঘরে ফিরে। আলমারি খুলে একটা পাঞ্জাবী বের করে গায়ে দেয়। তারপর হাঁক ছাড়ে, “বিবিজান, বিবিজান” বলে। তনুকা রান্নাঘরে ছিল। মেহতাবের ডাক কানে যেতেই ঘরে আসে সে। তার রান্নার প্রয়োজন না থাকলেও আজকাল সে রাঁধছে। ঘামে সিক্ত শরীরে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা খুলে মুখ মুছে, অতঃপর জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে? ডাকছিলেন কেন?’

‘তুমি রান্না করছিলে?’

‘জি।’

‘কী প্রয়োজন? ভৃত্যরা আছে না?’

‘ইউটিউব দেখে নতুন রান্না ট্রাই করছিলাম।’

‘আপাতত সেসব বন্ধ রেখে ফ্রেশ হয়ে এসো, মনোহর নদীর পাড়ে যাব।’

‘এই দুপুরে?’

‘হ্যাঁ, দুপুরেই।’

‘আচ্ছা, রান্নাটা সেরে নেই তবে।’

‘উঁহু, রান্না সারতে সময় নিবে। আমার হাতে এত সময় নেই। চলো তাড়াতাড়ি।’

তনুকা একপ্রকার তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই মেহতাবের কথাতে রাজি হলো। মেহতাব জেদি ভীষণ, এখন যেতে হবে মানে এখনই যেতে হবে। এই ভর দুপুরে নদীতে কে নৌকা ভ্রমণে যায়, তা একমাত্র এই উদ্ভট জমিদার’ই বলতে পারবেন।
তনুকা কামিজ পরে ওয়াশরুম থেকে বের হতে মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘এটা কী পরেছ? শাড়ি পরে এসো।’

‘না, এই গরমে আমি এখন শাড়ি পরতে পারব না।’

মেহতাব তার কথায় পাত্তা না দিয়ে আলমারি খুলে তার পছন্দ মতো এক শাড়ি বের করে আনে। সেটা তনুকার হাতে দিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে,

‘যদি তুমি স্বেচ্ছায় পরতে না চাও তবে, আমি পরিয়ে দিব।’

তনুকা বিরক্ত ভীষণ। এই লোককে দিয়ে ভরসা নেই, দেখা যাবে সত্যি সত্যিই জোর করে শাড়ি পরাতে আরম্ভ করল। তাই বিপদ কাটাতে নিজেই চলে গেল শাড়ি পরতে।

সাদা রঙের শাড়িতে শুভ্র দেখাচ্ছে তনুকাকে। মেহতাব চেয়ে হাসল। তার হাসিতে ভাঁজ পড়ল গালে। আপ্লুত সুরে আওড়াল,
‘আমার বিবিজান, আমার শুভ্রতা।’

তনুকার শূন্য মুখ। মুখে প্রসাধনীর রেশ মাত্র নেই। তবে, মেহতাবের কথায় কপালে এক কালো টিপ লাগিয়েছে। নিরেট মুখে আজ তার নাকের ছোট্ট সাদা পাথরের নাকফুলটা যেন একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। মেহতাবের দৃষ্টি যাচ্ছে বারবার সেদিকেই। সময় বের করে একবার সেই পাথরে ঠোঁট ছোঁয়ান বড্ড আবশ্যক মনে হলো তার।

মেহতাব নিচে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তনুকা সিঁড়ির কাছে যেতেই রাদাভকে দেখে, সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে কথা বলছে ফোনে। তনুকা তার সম্মুখে দাঁড়াতেই সে কল কাটে। তাকে শুভ্র শাড়িতে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আপনার ভাইয়ের সাথে, নৌকা ভ্রমণে।’

রাদাভ জবাব দেয় না আর। তনুকা অযথাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো কিছু শোনার অপেক্ষা নয়তো এমনিতেই।

যদিও মেহতাব আম্বিরা বেগমকে জানিয়েছে তাও তনুকা তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বাইরে বের হয়। গাড়িতে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে মেহতাব। তার যেন আজ একটু বেশিই তাড়া। তনুকা তার পাশে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। তারা মহল ছেড়ে কিছুটা পথ আসতেই তনুকার মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হয়। আনমনেই শব্দের উৎস উদঘাটন করতে গিয়ে তনুকা সেখানে তার এক অতি পরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ দেখে। তনুকা আড়চোখে একবার মেহতাবকে দেখে নিয়ে মেসেজটাতে চাপ দেয়। পুরো লেখাটা চোখের সামনে আসতেই সে মনে মনে পড়ে, “আজ মেহতাবের সাথে একা কোথাও যেও না। আমার মন বলছে, আজই কোনো এক বিপদ ঘটবে।” মেসেজটা দেখে বিস্মিত হয় তনুকা। হঠাৎ বিপদের কথা কেন বলা হচ্ছে? আর মেহতাব তো স্বাভাবিক, তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না কোনো বিপদ ঘটবে বলে? তনুকা তুখোড় দৃষ্টিতে মেহতাবকে দেখে। মনে মনে ভাবে, “মেহতাব কি আজ একটু বেশিই স্বাভাবিক? উনার এই অতি স্বাভাবিকতাই আবার কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণ হবে না তো? নয়তো আজ আচমকাই এই ভর দুপুরে নদীতে নৌকা ভ্রমণের ইচ্ছে জাগল কেন তাঁর?”

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here