#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৮।
রেনু জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই ইশফাক পিছিয়ে যায়। কপালে তার সূক্ষ এক ভাঁজ প্রস্ফুটিত হয়। সেই ভাঁজ ইঙ্গিত করছে, রেনুর আচরণে এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত সে। ইশফাকের এহেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া রেনুকে কষ্ট দেয়। সে অভিমানে গাল ফুলায়। ইশফাক সেসব অগ্রাহ্য করে বলে উঠে,
‘আপনার ভাইজানের হাতে আমার প্রাণ যাওয়া না অবধি আপনি বোধ হয় ক্ষান্ত হবেন না, তাই না?’
রেনুর ফুলানো গালযুগল আরো ফুলে যায় যেন। অভিমানের পাল্লা ভারী হয়। ভেজা সুরে বলে,
‘একটু সাহসী হলে কী হয়, ইশফাক? ভাইজানের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে আমাকে চাইতে পারবেন না?’
‘না।’
নির্দ্বিধায় নাকচ করল ইশফাক। রেনু বিধ্বস্ত নয়নে চাইল। আহত হলো তার ক্ষুদ্র হৃদয়। ব্যথিত সুরে বলল,
‘এই আপনার ভালোবাসা? এইটুকু সাহসও আপনার নেই?’
ইশফাক নির্বাক রয়। মেহতাবকে সে যতটা কাছ থেকে দেখেছে তা আর কেউ দেখেনি। তাই কেউ এই নিয়ে ঠিক অবগতও নয় যে, সেই মানুষটা ঠিক কতটা ভয়ংকর। ইশফাক জানে সেটা। আর জানে বলেই তার সাহস হচ্ছে না। রেনু উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। সিক্ত চোখের দৃষ্টি তার। ইশফাক মাথা নোয়াল। মৃদু আওয়াজে বলল,
‘অনেকক্ষণ হয়েছে, রেনু; এবার আপনার ফেরা প্রয়োজন।’
রেনু ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘আমি যাব না।’
‘জেদ করবেন না। কেউ দেখে ফেললে বিপদ।’
‘হোক বিপদ। আমি আপনার মতো ভীতু না, বুঝেছেন?’
ইশফাক ক্ষীণ হাসল। এগিয়ে এসে চট করে রেনুর গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, বুঝেছি আপনি অনেক সাহসী নারী। কিন্তু, সব জায়গায় সাহস দেখানো ঠিক না। আপাতত মহলে ফিরে যান। এখন কেউ দেখে নিলে, সব সাহস একদম ফুঁস হয়ে যাবে।’
রেনু হাসল। লজ্জা ঝরে পড়ছে যেন সেই হাসিতে। হাত কচলাতে কচলাতে সে বলল,
‘গাল টেনে বুঝি আদর করলেন আমায়?’
ইশফাক বিষম খায় যেন। ইতস্তত সুরে বলে উঠে,
‘বাজে না বকে মহলে যান তো। রাত হয়েছে অনেক।’
রেনু অতি ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হলো। অস্ফুট সুরে বলল,
‘আমি জানি, এটাই আপনার আদর।’
ইশফাক কিছু বলার আগেই দ্রুত পা চালাল সে। বেশ কয়েক কদম হেঁটে সামনে গিয়েই আচমকা থমকাল। সামনে দাঁড়ান মানুষটাকে দেখে পিলে চমকে উঠল তার। গায়ে কাটা দিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো হৃদকম্পন থেমে গিয়েছে তার। গলা শুকিয়ে ওঠেছে। দু কদম পিছিয়ে গিয়ে শরীর শক্ত করে দাঁড়ায়। ঢোক গিলে কম্পিত সুরে বলে উঠে,
‘ভ-ভাইজান, তত-তুমি?’
মেহতাব চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে। প্রশ্ন করে,
‘এত রাতে এখানে কী তোর?’
প্রশ্ন শুনে প্রাণপাখি যেন ফুরুৎ করে উড়ে যেতে চায়ল। রেনু শান্ত রাখল নিজেকে। যুতসই উত্তর সাজানোর চেষ্টা চালাল। কিন্তু, পারল না বোধ হয়। ধরা পড়া চোরের মতো চুপসে যাওয়া মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল কেবল। মেহতাব প্রশ্ন করল ফের,
‘কীরে, কিছু বলছিস না কেন?’
রেনু ঢোক গিলছে পরপর। মেহতাবের চোখের দৃষ্টি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়। হয়তো সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে। তাও রেনুর উত্তরের অপেক্ষায় সে। রেনুর নীরবতায় এক পর্যায়ে অত্যধিক বিরক্ত হয়ে মেহতাব ধমকে ওঠে। উচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, কথা বলছিস না কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো?’
রেনু শরীর অসাড় হয়ে আসছে যেন। উত্তরে কী বলবে সে? সত্য বললে আজ যে প্রাণ যাবে নির্ঘাত। রেনু ভয়ে ঘামছে রীতিমতো। মেহতাবের চোয়াল শক্ত হয়। সে এগিয়ে আসে একদম। কন্ঠস্বর শক্ত করে ফের একই প্রশ্ন করে,
‘রেনু, চুপ করে না থেকে উত্তর দে। এত রাতে এখানে কী তোর? কী লুকাচ্ছিস তুই?’
মেহতাবের এইটুকু সুরই ছোট্ট দেহের রেনুকে মৃত্যুর পথযাত্রী বানাতে যথেষ্ঠ। সে নিশ্চল, নির্বাক। উত্তর তো জানা নেই, কী বলবে? তবে, ভাগ্য ভালো সে সময়ই তার সম্মুখে এসে হাজির হয় তনুকা। ঘরে গিয়ে মেহতাবকে না পেয়ে ঘটনাস্থলে তার এই আগমন। আর তার এই অকস্মাৎ আগমনেই এই মুহূর্তে রেনুকে একটু শ্বাস ফেলার ফুরসতটুকু দেয়, নয়তো শ্বাস ফেলার কথা বেমালুম ভুলে বসেছিল সে। তনুকা ভাই বোনের মুখের ভাবমূর্তি দেখেই ধারণা করে নেয়, চোর হয়তো ধরা পড়েছে। তাও নিশ্চিত হতে মেহতাবকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে? এই সময় আপনারা দুজন এখানে?’
মেহতাব তার দিকে তাকায়। গম্ভীর সুরে বলে উঠে,
‘এই সময় রেনুর এখানে আসার কারণটা তুমিও বোধ হয় জানো তাই না, তনু?’
তনুকা অপ্রস্তুত হয়। রেনুর দিকে তাকায়। রেনু অসহায় চোখে ঢোক গিলে। তনুকা বুঝে উঠতে পারে সবটা, ইশারায় আশ্বস্ত করে তাকে। অতঃপর বলে,
‘না তো, আপনি কীসের কথা বলছেন?’
‘রেনু কি এখানে ইশফাকের সাথে দেখা করতে এসেছে, তনু?’
প্রশ্ন শুনে তনুকা আর রেনু দুজনেই চকিত হয়। মেহতাব যে এত শীঘ্রই এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে এইটুকু ভাবনায় ছিল না তাদের। তাই হজম করতে কষ্ট হয়। তনুকা উত্তর না দিয়ে রেনুর পানে চায়। রেনু চোখের ইশারায় অনেক আকুতি মিনতি করে ফেলে যেন, তনুকা এই মুহূর্তে কিছু না বলে। তবে, মেহতাব ছাড়ার পাত্র না। তার শকুনেরর চোখ ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। রেনু বা তনুকার কাছ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে সে গলা উচিয়ে ইশফাককে ডাকল সঙ্গে সঙ্গেই।
ঘরে দোর দেওয়া ইশফাকের কানে আচমকা মেহতাবের ডাক যাওয়া মাত্রই বুকের ভেতরে ধক করে উঠে তার। ভেবে নেয়, আজ সব শেষ। বক্ষঃস্থলের কম্পন তীব্র হয়। তবে, অদ্ভুত ভাবে কোনোপ্রকার ভয় কাজ করছে না তার মধ্যে। রেনুর মিষ্টি, মায়াবী, আদুরে মুখখানা দৃশ্যপটে ভাসছে বারংবার। মেয়েটার জন্য মৃত্যুর আগে অন্তত একবার বুক ফুলিয়ে বলে যাবে যে, সে তাকে ভালোবাসে। সকলের সামনে বলে যাবে সে। ভয় আর দ্বিধাহীন সেই কন্ঠ থাকবে। সেই প্রস্ততি নিয়েই ইশফাক ঘর ছেড়ে আজ বেরিয়ে আসে। মা বাবাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছিল। মোহন লাল মজুমদার কুড়িয়ে এনে বড়ো করেছিলেন তাকে। তারপর একটু বোঝ হবার পর থেকেই মেহতাবের গোলামী করে চলছে। আর আজ সে তার এক বিশ্বস্ত সহকারী। এমন অনেক কিছুই সে জানে যা একবার ফাঁস হলে মেহতাবের ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গেই ধুলোয় মিশে যাবে। অথচ সে বেঈমানী করেনি কখনো আর ভবিষ্যতেও করবে না। যদি এই ভেবেও মেহতাব আজ রাজি হয়ে যেত। ইশফাক এই দোয়াটাও করে নেয়। বলা তো যায় না, কখন কোন দোয়া লেগে যায়।
মেহতাবের ঠিক মুখোমুখি ইশফাক। মাথা নোয়ানো তার। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। ভয় দেখা যাচ্ছে না কোনো। তারই অপর পাশে রেনু দাঁড়ান। ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। অথচ একটু আগে এই মেয়েই কত বড়ো বড়ো কথা বলছিল। তনুকা নীরব চোখে দেখছে দুজনকে। তার মুখে কোনো রা নেই। অপেক্ষা করছে মেহতাবের অভিব্যক্তির। মেহতাব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে,
‘রেনু এত রাতে তোমার কাছে কেন এসেছিল, ইশফাক?’
ইশফাক চোখ বোজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্ত করার যত আয়োজন। তারপর স্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
‘যেহেতু তিনি এসেছিলেন সেহেতু আসার কারণটাও তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’
মেহতাব সঙ্গে সঙ্গেই রেনুর দিকে তাকায়। রেনু চোখ নামিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মেহতাব একই প্রশ্ন তাকেও করে। কিন্তু, বরাবরের মতোই নীরব ভূমিকা পালন করছে সে। মেহতাবের রাগ হয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
‘মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলিনা, রেনু। নয়তো আজ চুপ থাকার অপরাধে গা থেকে তোর চামড়া তুলে নিতাম।’
রেনু কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলে সে। তনুকা ব্যস্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। শান্ত করানোর চেষ্টা করে। ধীর সুরে বলে,
‘আজ সব বলার সময় এসেছে, রেনু। আর লুকিয়ে রেখো না। বলে দাও সব।’
রেনুর কান্নার মাত্রা বাড়ে বরং। মেহতাবের রাগও বাড়ে তাই। ইশফাক ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
‘এই আপনার সাহস, রেনু? কিছুক্ষণ আগেও না বলছিলেন আপনি খুব সাহসী? তবে, প্রমাণ করুন, আপনি সাহসী। কাঁদছেন কেন? সাহস নিয়ে বলুন, কেন এসেছিলেন আমার কাছে?’
রেনু কান্না থামায়। বিস্মিত চোখে দেখে ইশফাককে। ইশফাকের চোখের দৃষ্টি নিরেট শূণ্য। আশ্চর্য, সে ভয় পাচ্ছে না কেন? রেনু অবাক হয়। চট করে কোথ থেকে যেন তখন এক বুক সাহস এসে ভরে করে তার ভেতর। সে মেহতাবের দিকে তাকায়। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। অতঃপর গম্ভীর সুরে বলে উঠে,
‘আমি ইশফাককে ভালোবাসি, ভাইজান। আর ভালোবাসি বলেই এই রাত বিরেতে তাকে একটু দেখতে ছুটে আসি। আর আজ রাতেও এখানে আসার কারণটাও তাই। আমি ভালোবাসি ইশফাককে। এটাই সেই কারণ, যেটা জানার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছ তুমি।’
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️