#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৯।
মেহতাবের দুহাত পেছন থেকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখা। কপালে তার গাঢ় ভাঁজ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণত্বের মাত্রা ছাড়িয়েছে। রেনু চেয়ে আছে ভীত দৃষ্টিতে। ভাইজানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত সে। ভয়ও পাচ্ছে খুব। সাহস করে চটপট সব বলে দিলেও এখন আতঙ্কিত সে। ইশফাকের দৃষ্টি স্বচ্ছ। নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে মেহতাবকে দেখছে। মেহতাব ইশফাকের দিকে চায়। জোরে নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘ইশফাক, তুমিও কি রেনুকে ভালোবাসো?’
ইশফাক সহ বাকি দুই রমণীর নেত্রে পৃথিবী কাঁপানো বিস্ময়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পল চেয়ে রইল ইশফাক। মেহতাব হয়তো উত্তরের অপেক্ষায়। তাই বলল,
‘আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছি, ইশফাক।’
ইশফাক নীরবতা ভাঙার প্রস্তুতি নেয়। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে সহসা স্বচ্ছল স্বরে বলে উঠল,
‘জি ভাইজান, আমিও রেনুকে ভালোবাসি।’
রেনু আপ্লুত হলো। চোখের দৃষ্টি ছলছল হয়ে উঠল যেন। এই সাহসটুকুই তো চেয়েছিল সে। তনুকাও খুশি এতে। ভালোবাসা স্বীকার করে নেওয়ার মাঝেও এক অদ্ভুত সুখ আছে, আর এই সুখ ভালোবাসা অন্তরে লুকিয়ে রাখলে পাওয়া যায় না।
মেহতাবের নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া। রেনু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ভাইকে দেখছে। তার মুখ থেকে কিছু শোনার আশায় চিত্ত জুড়ে জোয়ার-ভাটা হীন নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইশফাকেরও তাই। উদগ্রীব দেখাচ্ছে তাকে। মেহতাব খানিক সময় নেয়। এই সময়ে অনেক ভাবে সে। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ইশফাকের জীবনী দর্শন করে আসে। হিসেব মিলিয়ে নেয় বরাবার, সাথে মেলায় নিজের লাভ লোকসানও। অতঃপর অনেক ভেবে চিন্তে সে নিভু স্বরে বলে,
‘কাল বিকেলে মহলে আসবে। বাড়ির সকলের সামনে আমি তোমাদের বিয়ের তারিখ পাকাপাকি করব।’
আচমকা মনে হলো, এ যেন মেঘ না চায়তেই বৃষ্টির আবির্ভাব। মেহতাবের এহেন স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণ প্রথমে ঠিক হজম হলো না কারোর। কথাখানা বোধগম্য হতে সময় নিল বেশ। রেনুর খুশি ধরছে না। হাতে চাঁদ পেলেও এত খুশি হতো না সে, আজ যতটা হয়েছে। ইশফাকের চোখ মুখ ঝলমল করছে। খুব করে ইচ্ছে করছে একবার মেহতাবকে জড়িয়ে ধরতে। এত সহজে এমন অমূল্য রত্ন পেয়ে যাবে আশা করেনি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিয়েছিল, অথচ চাঁদ যে এত শীঘ্রই তার আকাশে এসে ধরা দিবে তা ছিল তার কল্পনাতীত।
মেহতাব রেনুর দিকে তাকায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘ভেতরে যা। বিয়ে না হওয়া অবধি আর লুকিয়ে দেখা করতে আসবি না, বুঝেছিস?’
রেনু সভ্য মেয়ের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। মেহতাব বলল,
‘বিবিজান, তুমিও এবার ঘরে যাও।’
তনুকাও তাই করল। ইশফাক দাঁড়িয়ে রইল একা। এবার ইতস্তত দেখাচ্ছে তাকে। মেহতাবের মুখোমুখি অপ্রস্তুত হচ্ছে বোধ হয়। তাও দ্বিধা কাটিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ, ভাইজান।’
মেহতাব তাকে আপাদমস্তক পরখ করে বলল,
‘তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি, ইশফাক। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙেছ। আগে জানলে রেনুকে কখনোই তোমার সামনে আসতে দিতাম না।’
ইশফাক আহত হলো এই কথার বাণে। বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে বলল,
‘এভাবে কেন বলছেন, ভাইজান? আমার প্রতি বিশ্বাস না থাকলে আমাকে এক্ষুনি তাড়িয়ে দিতে পারেন, কিংবা মৃত্যুদণ্ড দিলেও মাথা পেতে নিব আমি।’
‘তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আমার বোন কষ্ট পাবে। আর আমি চাইনা ও কষ্ট পাক। ওর কথা ভেবেই কেবল আমি রাজি হয়েছি। নয়তো আমি কখনোই তোমার হাতে আমার বোনকে তুলে দিতাম না।’
ইশফাকের ভীষণ আত্মসম্মানে লাগল কথাটা। সে মেহতাবের মতো ধনী না হোক অন্তত মনটা ছোট নয়। মেহতাবের মতো এত নির্দয় নয় সে। যদিও আজকাল তার হয়ে কাজ করতে করতে অনেকটাই সেই পথে চলে গিয়েছে সে, তাও অন্তরে এখনো যথেষ্ঠ ভালোবাসা আছে, মায়া, মমতা, প্রেম সবই আছে। সে নিঃসন্দেহে রেনুকে ভালো রাখতে পারবে। তবে মেহতাব কেন এভাবে বলছে?
ইশফাকের কষ্ট হয় খুব। মেহতাব সেখান থেকে চলে আসে। ইশফাকও নিজ ঘরে ফিরে যায়। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সহসাই। ভাবে, কত মানুষ তো কত কিছু করেছে তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, সে না হয় তার আত্মসম্মানটাই খোয়ালো, তাতে কী আসে যায়।
________
বিছানা ঝেরে তনুকা হেলান দিয়ে বসে। মেহতাব তখন আলমারি খুলে কিছু একটা করছিল। তনুকা চেয়ে বলল,
‘আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হয়েছি, মেহতাব।’
মেহতাব চাইল। বলল,
‘এই ব্যাপারটা তুমি আগেই জানতে, তাই না?’
তনুকা নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার দেখা বাগানের ঐ ছায়ামূর্তিগুলো তবে ওরাই ছিল?’
‘হু।’
‘আগে বলোনি কেন আমায়?’
‘উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।’
‘যদি সেই উপযুক্ত সময় আসার আগেই কোনো অঘটন ঘটে যেত?’
‘কী ঘটতো?’
‘বিবি, রেনু এখন নিত্যান্তই এক কিশোরী, অন্যদিকে ইশফাক পুরো দুস্তর এক যুবক। রেনুর রাত বিরেতে তার সাথে এই হুটহাট দেখা করাটা নিশ্চয়ই মঙ্গল কিছু বয়ে আনত না। এইটুকু নিশ্চয়ই তুমি বুঝো?’
তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,
‘ইশফাক ভাই ভালো। আমার মনে হয় না উনি তেমন কিছু করতেন বলে। আমি উনার চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি।’
‘আর আমার চোখে দেখনি?’
তনুকা থমকায়। নিষ্পলক চোখে মেহতাবকে দেখে। কেমন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সে চেয়ে আছে যেন। তনুকার অস্বস্তি হয়। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে চট করে বিছানায় শুয়ে বলে উঠে,
‘লাইট’টা অফ করে এসে শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।’
মেহতাবও আর কথা বাড়াল না। তনুকা যে ব্যাপারটা উপেক্ষা করছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে। তার ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার হাসি ফুটে। করুক উপেক্ষা, কতদিন চলবে এসব? একদিন ঠিক শেষ হবে। দিন যে এবার ফুরিয়ে আসার পালা।
__________
‘মেহতাব।’
মেহতাব তাকাল। মেঝো কাকাকে দেখে প্রশ্ন করল,
‘কিছু বলবেন, কাকা?’
রমেজ মজুমদার একবার সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখলেন। তারপর মেহতাবের কাছে গিয়ে বললেন,
‘একটা কথা জানার ছিল।’
‘জি, বলুন।’
‘ওমরের কোনো খবর জানো?’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘উনার খবর আমি কী করে জানব?’
‘না, আসলে তোমাদের বিয়ের পর থেকেই নিখোঁজ ও।’
‘নিখোঁজ হলে পুলিশের কাছে যান, পুলিশ কেইস করুন। আমাকে বলে তো কোনো লাভ নেই, আমি তো আর নিখোঁজ মানুষকে খুঁজে বের করতে পারব না।’
রমেজ মজুমদার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যতই মেহতাব মুখে বলুক না কেন সে কিছু জানে না, রমেজ মজুমদার নিশ্চিত, ওমরের খোঁজ একমাত্র মেহতাবই দিতে পারবে। তাও সেটা মুখে প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র সাহস নেই উনার। তাই বিচারমহল থেকে বেরিয়ে তিনি ঘাটের কাছে গেলেন।
সকালের উষ্ণ রোদ। সেখানে ছিল রাদাভও। কোমরে হাত রেখে ঘাটসহ আশেপাশটা ভালোভাবে পরখ করছে সে। মতিব মজুমদার তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। রাদাভ কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকায়। মতিব মজুমদারকে দেখে ফিচেল হাসে। বলে,
‘কী ব্যাপার, হঠাৎ এখানে?’
‘এমনিতেই। তুমি এখানে কী করছো?’
‘ঐ তো দেখছি, সামনের জমি-জমা আর এই দিঘী কিছুদিনের মধ্যেই আমার হতে চলছে যে।’
রমেজ মজুমদার কপাল কুঁচকে বললেন,
‘মানে?’
রাদাভ হাসে। বিদ্রুপের হাসি সেটা। অতঃপর বলে,
‘আজ যদি আমি মেহতাব মজুমদারের মতো অনেক জমির মালিক হতাম তবে, তনুকাও আমার হতো। কিন্তু, আফসোস! হলো না। তাই ভেবেছি যে করেই হোক অনেক জমি জমার মালিক বানাতে হবে নিজেকে তবে, আমিও খুব সহজে আপনার সুন্দরী রূপবতী মেয়ে, তনুকা মজুমদারকে নিজের করে নিতে পারব।’
রমেজ মজুমদার রেগে যান খুব। অতি মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাদাভকে মারার জন্য হাত তুলতেই রাদাভ সহস্তে চেপে ধরে তা। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
‘খবরদার আমার না হওয়া শ্বশুর, আমাকে এখন আর আগের মতো দুর্বল ভাববেন না। আপনার এই হাতকে এই মুহূর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে আমার। তাই সাবধান, এমন ভুল আর দ্বিতীয়বার করবেন না। নয়তো আমি ভুলে যাব, আপনি আমার বাবার ভাই আর আমার ওয়ান এন্ড ওনলি প্রেমিকা তনুকার একমাত্র বাবা।’
এক ঝটকায় রমেজ মজুমদারের হাত নামিয়ে রাদাভ চলে যায় সেখান থেকে। রমেজ মজুমদারের চোখ থেকে অগ্নি ঝরছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করলেন। ভাবলেন, খুব শীঘ্রই এর একটা বিহিত করে তবেই ক্ষান্ত হবেন তিনি; এর আগে না।
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️