#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১৩
নিস্তব্ধ গভীর রাত। বাসার সবাই ঘুমে বিভোর। কিন্তু অনু ঘুমাতে পারছে না। কেমন যেন ছটপট লাগছে তার। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো। পাশেই তিথি বেগোরে ঘুমাচ্ছে। অনুর মন খুলে কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। হুট্ করে গরম লেগে উঠল। মনে হচ্ছে চারদিক থেকে ভ্যাপসা গরমে ঘিরে ধরেছে। অনু খাট ছেড়ে উঠে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। জানালা খুলতেই মৃদু বাতাস গায়ে এসে লাগলো। অনু চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করলো কিন্তু তবুও রুমের ভেতর দমবন্ধ লাগছে তার।
নির্জন গভীর রাতে সে ছাদে উঠে গেল। আজ বহুবছর পরে এভাবে রাতে ছাদে উঠেছে সে। সেই মাধ্যমিকের সময় নিয়মিত উঠা হতো। কেউ একজন রাতের আকাশ ভালোবাসে শুনে সেও তখন এই অভ্যাসটি করেছিল। অথচ অনু ছিল ভীষণ ভীতু। অন্যদের তুলনায় তার দ্বিগুন ভয় কাজ করতো। তবুও সে ভয়কে দূরে রেখে অভ্যাসটি করেছিল।
অনু হাসলো। কী বোকা ছিল তখন।
কাউকে ভালোবেসে তার পছন্দ অপছন্দ সব নেওয়া যায় তা অনু নিজেকে না দেখলে জানতোই না। যদি ভালোবেসে সব পছন্দ অপছন্দের নেওয়া যায় তবে আদিত্য কেন নিলো না? আদিত্য কেন অনুর পছন্দগুলোকে মেনে নিল না! অনু তো ঠিকই আদিত্যর মন অনুযায়ী নিজেকে বদলে নিয়েছিল তবে আদিত্য কেন উল্টোটা হলো! তবে কী একেকেজনের ভালোবাসা একেকরকম? না কি সেই ভুল! আদিত্য কোনোদিন ভালোইবাসেনি অনুকে! ভালোবাসলে অনুর পছন্দ অপছন্দ সব মেনে নিতো আর কারোর মিথ্যা অপবাদ শুনে সম্পর্ক অবনতিও করতো না।
অনু চোখ মুছে নিল। এখনো সে আদিত্যকে নিয়ে ভাবছে! সে কী পা’গ’ল?সে কী দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে?
অনুর কান্না পেল। নিজের দুঃখগুলো কারোর সাথে ভাগ্ করে নেয়ার কান্না। আদিত্যর জন্য তার কোনো বান্ধবীর সাথে এখন যোগাযোগ নেই যে মন খুলে কথা বলবে। হাজার বাবা থাকুক কিন্তু দিনশেষে সব কিছু বুঝিয়ে কাউকে হাল্কা হতে হয়। যেটা অনু পারছে না। মনের ভেতর কোথাও জানি চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কেন হচ্ছে অনু জানে না! আদিত্য তার ভালোবাসা হলেও প্রথম ভালোবাসা ছিল না। প্রথম ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ এক তরফা। যে সবসময় তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। কেন এসবকিছু এখন মাথাচারা দিয়ে উঠছে সে জানে না।
অনুর মানসপটে সেই দিনগুলো ভেসে উঠল।
তখন নানুরবাড়ি গেলে সবাই একসাথেই যাওয়া হতো। সবাই বলতে অনুর মায়ের ভাই বোন সবাই। এমনিতে সবাই একেক জায়গায় থাকতো কিন্তু বছর শেষে সবার ছুটিতে নানুরবাড়ি একসাথে মিলিত হতো। তার মধ্যে অনুও থাকতো। অনুকে তার বাবা গিয়ে দিয়ে আসতো। একটা জিনিস খারাপ লাগতো সব কাজিনের পরিবার থাকলেও অনুর কোনো পরিবার থাকতো। তার মায়ের মৃত্যুর পরে বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে মনোমালিন্য হওয়াতে সম্পর্ক ঝুলে যায়। অনুর জন্য কোনোমতে জোড়া লাগা ছিল। অনুর পরিবার না থাকা সত্ত্বেও কেউ অনুকে সেই খারাপ লাগার সুযোগটা দিতো না।
অনুর মনে পড়ে এখনো। যেদিন শেষবার সবার সাথে মিলেছিল। তারপর থেকে আর যাওয়া হয়নি আর কথাও হয়নি।
সেদিন মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। অনু স্কুল থেকে পরীক্ষা শেষে ফিরেই বাবার কাছে বায়না ধরেছিলো যাতে নানুরবাড়ি দিয়ে আসে। কিন্তু আনিস মিয়া সংকোচে কাউকে ফোন করেনি। ঠিক সেদিনের পরেরদিন ছোটমামা কল করে জানিয়েছিল, সবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। সেই সুবাদে নানুরবাড়ি যাচ্ছে অনুকেও যাতে দেয়। অনুর সেদিন কী যে খুশি তা মনে পড়তেই অনু হেসে উঠে। পরেরদিন আনিস মিয়া অনুকে দিয়ে আসেন।
সেদিন এতো খুশির কারণ সে বুঝতে পারেনি। সবেমাত্র মাধ্যমিকের কিশোরী বলে কথা। পরে বুঝতে পারলো সে প্রেমে পড়েছে। আর সেই লোকটি আর কেউ নয়। যাকে সব কাজিনরাই ভালোবাসে, পছন্দ করে। যে সবার মধ্যমনী। তাকেই অনু ভালোবেসে ফেলেছে। অনু বুঝতে পারেনি ঐটা আদৌ ভালোবাসা না কি ভালো লাগা! সে জানতো না এর সমাপ্তি কী হবে!
সারাদিন অনু খুশিই ছিল। বারবার উঠানে এসে রাস্তার দিকে উঁকি মারতো। সেদিন নাহলেও অনেকবার সে রাস্তার ধারে এসেছিলো। কিশোরী মনের প্রথম অনুভূতি হলে এমনিতেও মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়। কিন্তু সারাদিন ফুরফুরে থাকলেও বিকেল হতে হতে সব উবে গেল। রাত নামতেই অনুর মন অন্ধকারে ঢেকে গেল।
সে খুশি ছিল কেউ একজনকে দেখবে বলে। তৃষ্ণার্থ কাকের মতো অপেক্ষায় সারাদিন কেটে গিয়েছিল। সব খালামনি আর মামা কাজিনরা আসলেও সালিহা আন্টি সেদিন তাড়াতাড়ি আসেনি। অথচ প্রতিবার উনিই সবার আগে থাকতো। আর কাজিনরা উঠানে ঢুকেই সাহিল ভাইকে দেখে খুশিতে নেচে উঠতো।
অনুর মনে পড়ে। সেদিন অনুর মনখারাপ কাটেনি। রিমা আপুর কাছ থেকে কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছিল যে সালিহা আন্টি আসেনি কেন! উত্তরে তিনি জানিয়েছিল, আসবে। অনুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্ঠায় ছিল। সবার জোরাজোরিতে সে খেতে বসেছিল। মনমরা হয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়েছিল। ঠিক সেসময় একজন বলে উঠল, সালিহা আন্টি এসেছে। অনু খাবারের প্লেট ঐভাবে রেখেই উঠানের দিকে দৌড়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারলো। গাড়ি থেকে সালিহা আন্টি নামতেই অনু আরেকটু উঁকি মারলো। কিন্তু যার অপেক্ষায় ছিল সে সেদিন আসেনি। ইনফ্যাক্ট আর কোনোদিনই আসেনি।
সালিহা আন্টি এগিয়ে এলো। সালিহা আন্টির সাথে আসা গাড়িটি ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। অনু প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো। সালিহা আন্টি এগিয়ে এসে অনুর গালে হাত রেখে শুধালো,
“কিরে মা!”
অনু দৌড়ে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলো,
“আন্টি তুমি একা এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
সালিহা আন্টির কথায় অনুর খারাপ লাগলো। তার মানে সাহিল ভাইয়া এইবার আসেনি। তার কষ্ট হলো। সে নিজেকে সংযত করে আবারো প্রশ্ন করলো,
“সাহিল ভাইয়া একা থাকবে ওখানে?”
অনুর কথায় সালিহা বেগম হেসে দিলেন। তিনি হেসে শুধালেন, “দেখো মেয়ের কথা!এখন থেকে তো ও একাই থাকবে।”
অনু কিছু বুঝতে পারলো না। সে প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই পাশ থেকে রিমা বলে উঠল,”আরে তুই জানিস না? সাহিল ভাইয়া তো স্কলারশিপ পেয়েছে। বাইরে পড়তে চলে গিয়েছে।”
অনু চমকে তাকালো। তার বুক ধক করে উঠল। রিমা অনুর হাত ধরে এক কোণে নিয়ে এসে অনুর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। এরপর জানালো। এটা সাহিল ভাইয়া দিয়েছে অনুর জন্য। অনু কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা নিল। সে বুঝতে পারলো না, কী আছে কাগজে! আর সাহিল ভাইয়া তাকে আলাদা করে কী লিখবে! তাহলে কী তিনি কিছু বুঝে ফেলেছিল আগেরবার!
অনু চিঠিটা খুলল। খুলে পড়তে শুরু করলো,
“অনুপমা,তুমি এখনো ছোট। সামনে ভবিষ্যত পড়ে আছে। কোনো দিকে ধ্যান না দিয়ে ভালোমতো পড়াশোনা করিও। তোমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করিও। সামনের জীবন সুন্দর হোক।
ইতি সাহিল।”
অনু শিউর হয়ে গেল। তাহলে সাহিল ভাইয়া সব জানতো। জেনেও উনি চলে যাওয়ার সময় অনুকে বলা হয়নি। সবাইকে বলা হয়েছিল শুধু অনুই বাদ ছিল!
অনু হাতের ভেতর কাগজটা ঐভাবেই দুমড়ে মুচড়ে ফেলল। তার অভিমান হলো। কিন্তু সেই অভিমান কেউ ভাঙতে এলো না। এরপরেরদিনই অনু বাবাকে বলে চলে এসেছিল। প্রথম অনুভূতি সে সেদিনই ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে। আর কোনোদিন সাহিল ভাইয়ার সাথে তার দেখা হয়নি। সেই আগেরবারই শেষবার ছিল। অনুর জিদ কাজ করেছিল। সে ফিরেই আর যায়নি।
এরপর আরেকবার গিয়েছিল নানুরবাড়ি। রিমার মোবাইল ছিল, সোশ্যাল মিডিয়াতে নাকি সাহিল ভাইয়া স্টোরি দিয়েছে। কোনো একটা মেয়ের সাথে। রিমা আইডি সার্চ করে জানিয়েছিল, কী সুন্দর মেয়েটা! অনুও উঁকি দিয়ে দেখেছিল, ভারী মিষ্টি মেয়ে!
কাজিনমহলের সবাই সেই মেয়ের ছবি দেখে হুলুস্তুল কান্ড! সবাই বলাবলি করেছিল, “মেয়েটার সাথে ভাইয়ার হলে অনেক ভালো মানাবে। দুজনেই খাপে খাপ। ভাইয়ার সৌন্দর্যের কাছে এরকম মেয়েই মানানসই।”
সেদিন অনুর টনক নড়লো। আসলেই তো। সাহিল ভাইয়ার পাশে একটা সুন্দর মেয়েই মানাবে। আর কেউ তো না। কিসের সাথে কী মেলাচ্ছে সে!
সেদিনের পরে অনু বাড়ি এসে পুরোপুরি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। সেই অনু ঘরে এসেছে আর ওখানে যাওয়া হয়নি। পরেরবার থেকে একইভাবে সালিহা আন্টিরা সবাই অনেক জোরাজোরি করতো। যেহেতু তারা আনিস মিয়ার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য এই বাড়িতে আসতো না তাই সবাই ছুটিতে নানুরবাড়ি গেলে অনুকে ডাকতো কিন্তু অনু যায়নি। পরেও আর কোনসময় যাওয়া হয়নি। এরপর তাদের সম্পর্ক হাল্কা হয়ে যায়। কারণ মাঝখানে এতদিন অনুই সম্পর্কের সেতু হয়ে জোড়া লাগিয়েছিল। যেখানে অনুই যায়নি সেখানে আর সম্পর্কও শেষ হয়ে গেল। এমনিতেও জোরালো ছিল না সেখানে অনু না যাওয়াতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এরপরেই একদিন আদিত্যর সাথে পরিচয় আর বিয়ে। এসবের জন্য ভুলেই বসেছিল সেই দিনগুলি। যদি না সালিহা আন্টি যোগাযোগ করতো।
অনু চোখ মুছে নিল। কতদিন পরে সবার সাথে দেখা হবে! হয়ত সবাই ভালো অবস্থায় থাকবে শুধু অনু বাদে। হয়ত সবাই নিজের একটা একটা করে ভালো স্থান গড়ে তুলেছে! শুধু অনুই পারলো না! নিজের জন্য হাসলো অনু। তার তো এটাই প্রাপ্য ছিল!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(রিচেক করা হয়নি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। রিচ একদম শেষ। ৯৭% ডিক্রেস। এরকম হলে পেজ রিস্কে চলে যাবে। প্লিজ ২কে কমেন্ট পূরণ করে দিতে পারবেন? অনুরোধ রইল।)