#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১৮
সময় থেমে থাকে না। আপনগতিতে স্রোতের মতো চলতে থাকে। জীবনে যা ঘটবে ঘটুক সময় আপনমনে বয়ে যেতে থাকবে।
অনু খোলা চুলে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে দেখতে আরো দুইমাস পেরিয়ে গেল। এই দুইমাস সে নিজের সাথে যুদ্ধ করে বাস্তবে মন দিয়েছে।
“এই অবেলায় এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে! ক্লাস শেষ?” অনু ফিরে তাকালো। এই মানুষটা প্রতিদিন অফিস করে এসেও অনুর খবর নিতে মোটেও ভুলে না। অনু মলিন হাসলো। হেসে জবাব দিল,
“এমনি আসলাম। হ্যাঁ শেষ হয়েছে। তুমি কবে ফিরলে অফিস থেকে।”
“এইতো মাত্রই।”
অনু এগিয়ে গেল।
“মাত্রই ফিরে আমার খবর নিচ্ছ?”
“আমার মেয়ের খবর আমি নিবো না তো কে নিবে?”
অনু হাসলো।
“মন খারাপ?”
অনু লুকালো না। বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে শুধালো,
“একটু।”
“আবারো মানুষের কথায় কান দিচ্ছ?”
“বাবা আমি কী আসলেই খারাপ না কি আমার ভাগ্যটাই এমন!”
“একদম এই কথা বলবে না। আমার মেয়ে খারাপ না। কিন্তু যারা তার মর্ম বুঝেনি তাদের ভাগ্য খারাপ।”
অনু চুপ করে রইল। প্রতিদিন ক্লাস করতে যাওয়ার সময় গ্রামের রাস্তায় সবার মুখোমুখি হতে হয়। পারার প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে শুরু করে মোড়ের চায়ের দোকান পর্যন্ত। তাকে দেখলেই কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করা লাগবেই। ও জবাব দিয়ে চলে আসলেই ফিসফিস কণ্ঠ যেন বেড়ে যায়। অনু পারছে না এভাবে। তার ভীষণ অস্বস্তি হয়।
“একটা কাহিনী তুমি বারবার পড়লে সেটার প্রতি ওই প্রথমবারের মতো আর আকর্ষণটা কী থাকে?” আনিস মিয়ার কথায় অনু তাকালো। এখানে কাহিনীর কথা কেন আসছে!
“তোমাকে গল্পের মতো হতে হবে। এসব কিছুকে পাত্তা দিবে না। প্রতিদিন নিয়মমাফিক একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি হলে তখন আর সেই ঘটনার প্রতি কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তোমারও আর কোনো অস্বস্তি রাখা উচিত না। মানুষ বলবেই। তাই বলে ঐগুলোকে পাত্তা দিয়ে তুমি কেন থেমে থাকবে?” বলেই আনিস মিয়া একটু থেমে মেয়ের দিকে তাকালেন,
“শোন মা, মানুষের কথায় পাত্তা দিতে গেলে জীবন গঠন হবে না। সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে হলে চারদিকের সব খারাপগুলো ভালোরূপে গ্রহণ করতে হবে। সেই খারাপগুলোকে জেদ হিসেবে নিয়ে জীবন গঠন করতে হবে। এতেই জীবনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।”
অনু এগিয়ে এসে আনিস মিয়াকে জড়িয়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি এভাবে আমার সাথে রয়ে যেও বাবা।”
“বাবা আছি সবসময়”
অনু আনিস মিয়াকে শক্ত করে ঝাপ্টে ধরলো। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।
——–
পেরিয়ে গেল আরো কয়েকটা দিন। সারাদিন ক্লাস করে এসে শুতেই বিকেল নেমে এলো। অনু শোয়া থেকে উঠে গোসল সেড়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। পড়ন্ত বিকেলের এই সময়টা অনুর বড্ড প্ৰিয়। এই সময়টা ছাদে দাঁড়ালে অনুর সারাদিনের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই মুছে যায়। খোলা সদ্য ভেজা চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। মেডিকেলের ক্লাসও নিয়মমাফিক চলছে। অনু তার কথা রেখেছে। সম্পূর্ণ ধ্যান সে পড়াশোনায় রেখেছে।
অনু উঠানের দিকে তাকিয়ে রইল। গেট দিয়ে কোনো একটা গাড়ি ঢুকতে দেখেও সে ধ্যান দিল না।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। ধীরে ধীরে সময় বাড়ছে।
“অনু মা?”
পেছন থেকে হঠাৎ অতিপ্ৰিয় এক কণ্ঠস্বর শুনে অনুর ধ্যান ভাঙলো।
সে দ্রুত পেছনে ফিরে সালিহা আন্টিকে দেখেই চমকে উঠল।
“আন্টি তুমি?”
সালিহা বেগমের অভিমানের ঝুড়ি যেন ভেঙে পড়লো। তিনি এগিয়ে এসে অনুকে জড়িয়ে নিতে নিতে আদুরে কণ্ঠে শুধালো,
” আমাদের ভুলে কীভাবে থাকিস তুই? সে যে এসেছিস আর একটু দেখতেও যাসনি। কেন?”
অনু মাথা নিচু করে ফেলল। আসলেই সে ভুল করে। প্রতিবার এসেই সে একই কর্মকান্ডগুলো করে। এই মানুষগুলো তাকে এতটা ভালোবাসে, তবু সেই সামান্য মূল্য অনু দিতে পারে না। কিন্তু সেইবা কী করবে! যত দূরে থাকবে ততো সে ভালো থাকবে।
অনু কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে জানালো,
“তুমি এখানে! এভাবে হঠাৎ! আমাকে একবার জানাতে পারোনি?”
“জানিয়ে আসার সময়টা নেই। সাহিলের বিয়ে। দাওয়াত করতে এলাম।”
সালিহা বেগমের এই একটা কথায় অনুর বুক ধক করে উঠল। এতদিন মনকে শক্ত করেও কেন এতো খারাপ লাগছে তার! এটা তো হওয়ারই কথা।
” তোর জন্য অনেকবছর পরে এই বাড়িতে পা রেখেছি। এটার মূল্য দিবি তো?আসবি তো? ”
“আসবো।”
“কখন জিজ্ঞেস করলি না তো!”
“কখন?”
“পরশু গায়ে হলুদ। এরপরেরদিন কাবিন। যদিওবা সাহিল কোনোটাতেই রাজি না। কিন্তু এভাবে কী থাকা যায়? বল? আমিও তো বুড়ো হচ্ছি। কোন সময় চলে যায়। ছেলেটাকে কে দেখে রাখবে সেই ব্যবস্থা তো করে যেতে হবে।”
“আন্টি এমন কথা বলো না। তোমরা অনেক বছর বাঁচবে। ”
“আচ্ছা, আপাতত এসব পরে। তুই কিন্তু কালই চলে যাবি।”
“চেষ্টা করবো আন্টি।”
সালিহা বেগম হুট্ করে এসে হাত ধরে অনুনয়ের সুরে জানালো,
“আসবি তো! আন্টির কথা রাখবি তো। কথা দেয়।”
অনু হাত ধরে ফেলল। মনে মনে আওড়ালো, “এই তুমি কী করলে আন্টি! আমি যে যেতে পারবো না।”
——
খাটে বইয়ের ছড়াছড়ি। সব বই উল্টে পাল্টে দেখে অনু মাথা চেপে ধরলো। আজ তার বইয়ে মন কেন যাচ্ছে না! সব ফেলে এসেও কেন এখনো পিছু ছাড়ছে না! কেন এতো খারাপ লাগছে!
অনু বই ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে এলো। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাত। অদূরে কোথাও কু’কু’র ডাকছে। অনুর হুট্ করে সব ভ’য়ং’কর লেগে উঠল। সবকিছু এতো বি’ব’ৎস কেন মনে হচ্ছে!
অনু জানালার গ্রিলে মাথা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আগে এই অন্ধকারে তাকাতে ভীষণ ভয় করতো। অথচ এখন খুঁজে খুঁজে অন্ধকারে যেতে ইচ্ছে করে। যেন সব কষ্ট আড়াল করে নিতে পারে।
কাঁধে কারোর হাত পেয়ে চমকে তাকালো অনু। পেছনে না ফিরেই বুঝতে পারলো আনিস মিয়া।
“বাবা, তুমি এখনো ঘুমাওনি?”
“আমার মেয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আর আমি ঘুমাবো?”
“তুমি কীভাবে জানো যে আমি ঘুমায়নি!”
“বাবারা সব বুঝতে পারে।”
অনু আনিস মিয়ার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার এই বাবা মানুষটা এতো ভালো কেন!
“কাল যাবি?”
“কোথায়?”
“সাহিলের বিয়েতে?”
আনিস মিয়ার কথায় অনু তাকালো। সে নিজের মনকে সামলে শক্ত করে উত্তর দিল,
“যাবো। কাল গিয়ে পরশু বিয়ে পড়ানো শেষে চলে আসবো। জানোই তো আমার পড়া।”শেষের কথাটা অনু ইচ্ছাকৃতভাবেই বলেছে যাতে বাবার চোখ ফাঁকি দিতে পারে।
আনিস মিয়া মেয়ের দিকে তাকালেন। তিনি কিছুটা হলেও মেয়ের মন বুঝতে পারলেন। তিনি জবাব দিলেন,
“বেশি পড়ার চাপ হলে যেও না।”
“না আমি যাবো। আন্টি এতো ব্যস্ততার মাঝে এখানে এসে দাওয়াত করেছে। এতো বছরের অভিমান ভুলে এসেছে। না গেলে কেমন দেখায়!”
“ঠিক আছে তোমার ইচ্ছে।”
অনু হাসলো। হেসে জবাব দিল,
“সবই তো আমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে বাবা। তবু কেন এতো অসুখী আমি!”
“আল্লাহ তোর কপালে অনেক সুখ দিক মা।”
“বাবা তুমি এভাবে রয়ে যেও আমার কাছে। তাতেই হবে। তাতেই আমি সব পেরিয়ে যেতে পারবো। তুমিই আমার একমাত্র সুখ।”
“আল্লাহ যদি চায় তবে অবশ্যই আছি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোর সাথে তোর এই বাবা আছে। নিজেকে একা ভাববি না। কোনোদিন ভেঙে পড়বি না।”
অনু এগিয়ে এসে আনিস মিয়ার বুকে মাথা রাখলো। এই মানুষটা আছে বলেই সে বারবার মনকে সামলানোর শক্তি পায়। এই মানুষটাই তার একমাত্র মানসিক শান্তি।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। অগোছালো হওয়ার জন্য দুঃখিত। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। ভালোবাসা নিবেন। )