#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৪
দরজা ধাক্কানোর শব্দে অনু মাথা তুলে তাকালো। জানালার বাইর থেকে আর আলো আসছে না। মুহূর্তের মধ্যে যেন চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। কখন যে রাত হয়ে গেল তা সে খেয়ালই করতে পারলো না। মনে হচ্ছে, দিনটি খুব তাড়াতাড়িই চলে গেল। আজ প্রথমবারের মতো সন্ধ্যায় ছাদেও উঠা হয়নি অনুর। হয়ত আর কোনোদিন হবেও না।
আদিত্য দ্বিতীয়বারের মতো ডাকতেই অনু চোখ মুখ মুছে দাঁড়িয়ে পড়লো। হুট্ করে বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়লো। বাবার কথাগুলো উপদেশ বাণী মেনে নিয়ে সে মনোবল বাড়ালো। না একদম দুর্বল হলে চলবে না। দেখাতে হবে সে দুর্বল নয়। এতেই তো মানুষ শিক্ষা পাবে। যত নরম দেখানো হবে ততো দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মানুষ মজা নিবে।
অনু উঠে দাঁড়িয়ে চোখমুখ ভালো করে মুছে নিয়ে দরজা খুলল।
দরজা খুলতেই আদিত্যকে দেখে অনু সরে দাঁড়ালো।
আদিত্য মাথা নিচু করে অনুকে বলল,
“আমার উপর রাগ করে আছো?”
আদিত্যর এমন নরম সুরের কথা শুনে অনুর এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করলো তাকে জড়িয়ে ধরতে। ইচ্ছে করলো আদিত্যর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করতে যে কেন এমনটা করলো! কিন্তু অনু নিজেকে সামলালো।
সে দায়সারা জবাব দিল, “না।”
আদিত্য বোঝানোর ভঙ্গিতে আরো কয়েক পা এগিয়ে এসে শুধালো,
“আসলে অনু তুমি যা ভাবছো তা না।”
“আমি কী ভাবলাম?”
“এগুলো আমার হাতে ছিল না অনু। আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।”
আদিত্যর শেষকথাটা শুনে অনু নিঃশব্দে হেসে জবাব দিল,
“তাহলে জেনে বুঝেই করেছো। স্বীকার করছো!”
আদিত্য মাথা আরো নুইয়ে ফেলল।
অনু আবারো জিজ্ঞেস করল,
“এমন কিসের বাধ্যবাধকতা তোমার? যে আমাকেই সবার সামনে খারাপ করতে হবে!”
আদিত্য বুঝাতে নিচ্ছিলো কিন্তু অনুর শান্ত শক্ত কণ্ঠ শুনে সে চোখ তুলে তাকাতেই চমকালো। সে ভেবেছিল অনু কেঁদেকেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলবে। অথচ অনু কিনা একদম শান্ত!
আদিত্য অনুর এমন তেজী রূপ আগে দেখেনি। তার খারাপ লাগলো অনুর জন্য। মেয়েটা অতিরিক্ত কষ্ট থেকে এমনটা হয়নি তো? তার এতদিনের দেখা অনু তো কোমলমতি! তাহলে এই কোন অনু!
আদিত্য মনের ভাবনাকে আড়ালে সরিয়ে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো,
“আচ্ছা বাদ দাও, চলো খাবে। ”
আদিত্যর বলতে দেরি অনুর হেঁটে যেতে দেরি হলো না। আদিত্য ভেবেছিল অনুর জবাব না হবে। আদিত্যর বুঝানো লাগবে। আর সেখানে অনু কিনা এক বাক্যতে খেতে যাচ্ছে!
যদিও আদিত্য মায়ের কাছ থেকে শুনেছে অনু দুপুরে খেয়েছে এবং খুব ভালোভাবেই খেয়েছে। সে মায়ের কথায় সেসময় অনেকটা বেশি চমকিয়েছে। কারণ বিয়ের পরে থেকে কোনোদিন অনু আদিত্যকে ছাড়া আগে খায়নি। আর সেই অনু কিনা এভাবে খেয়ে নিলো! কিন্তু আদিত্যর তবুও মনের কোথাও জানি অনুর জন্য খটকা লাগলো। তার মনে হলো, অনু হয়ত এটা সবার সামনে এমনিতে দেখানোর জন্যই নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত সে আসলে খায়নি।
দুপুরে সেসময় আদিত্য রিহি রুমে ঢোকার পরপরেই বের হয়ে গিয়েছিল। আর দুপুরে খাওয়ার ইচ্ছে তার হয়নি। সে মাত্রই ফিরেছে। আর ফিরেই অনুর নামে একগাদা কথা শুনেও সে অনুর সাথে খাবে বলেই ডাকতে এসেছে।
আদিত্য দ্বিতীয়বার চমকালো যখন অনু টেবিলে বসে নিজেরটা নিয়ে ভালোভাবেই খাচ্ছে। আর অনুকে দেখতে বেশ স্বাভাবিক লাগছে। আদিত্য কেঁপে উঠল এমন রূপ দেখে। তার মনে হলো অতিরিক্ত কষ্ট অনু এমন হলো না তো?এজন্যই কী অনু দুনিয়াবী কোন ধ্যান নিচ্ছে না?
অনুর এমন খাওয়া দেখে আদিত্যর মনে খটকা লাগলো। তার মনে হলো অনু কী ভুলে গেল কিছুক্ষন আগে ঘটনা! না, অনু তো এতো সহজে কোনো কিছু ভোলার মেয়ে নয়। তাহলে!
আদিত্যর ভয় হলো। সে এতদিনের নরম অনুর সাথে এই অনুকে মিলাতে পারছে না। কিন্তু যায় হোক, লাভ তো তারই। অনু যত তাড়াতাড়ি মেনে নিবে তারই তো ভালো হবে। এক বাক্যতে সব মেনে নিলে তো তারই কোনো বেগ পোহাতে হবে না। অনুকে ভালোভাবে তার দুর্বলতা বুঝিয়ে মায়ের কথা মেনে নেওয়া যাবে।
অনু বেশ ভালোভাবেই খাওয়া শেষ করলো। খাওয়ার শুরু থেকে সে এক মুহূর্তের জন্যও কোনোদিকে তাকায়নি। আপনমনে খেয়ে সে রুমে চলে এলো। রুমে এসেই সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দিয়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এতক্ষনের করা সব নাটকগুলো কান্নারূপে ধলা পেকে বেরিয়ে আসছে যেন। কান্নার হিচকি উঠতেই সে মুখ চেপে ধরলো। তার আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে সে কী করবে! কীভাবে বাঁচবে সে!
দরজায় নক করার আওয়াজ পেতেই অনু কান পেতে শুনার চেষ্টা করলো। আদিত্য ডাকছে।
“অনু তুমি ঠিক আছো? এতক্ষন কী করছো?”
অনু কল বন্ধ করে চোখমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আসতেই আদিত্য জানালো, “আমি একটু মায়ের রুমে আছি।” বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আর অনু নিজের বালিশটা নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো। এই রুমে সে কিছুতেই থাকবে না। গেস্ট রুমটা আছিয়া বেগমের রুমের পরেই। সে গেস্ট রুমে যেতে গিয়ে আছিয়া বেগমের রুম থেকে তাদের কথোপকথন শুনে থেমে গেল। রুমের দরজাটা ভিড়ানো। অনু হাসলো। ঘরে অনু ছাড়া আর কেউ নেই। তবুও তারা দরজা ভিড়ে দিয়েছে। তার মানে নিশ্চই অনুর কথায় হবে। অনু রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতার চেষ্টা করলো। যদিও এটা করা উচিত না। কিন্তু অনুর
এইমূহুতে এতো উচিত অনুচিত দেখার ইচ্ছে নেই।
সে শুধু চাইছে আদিত্যকে নিয়ে সে যা ভাবছে কোনোভাবেই তা যেন ভুল হয়। কিন্তু অনেক প্রমান থাকা সত্ত্বেও সে এটাই ভাবতে চাইছে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছু কথোপকথন কানে আসছে।
আদিত্য বলছে,
“কিন্তু মা, এতদিন অনু আছে এই বাসায়। কীভাবে বলি যে তুমি চলে যাও। মায়াও তো হচ্ছে।”
“আমি জানি না। তুই কী করবি!”
“আমার মনে হচ্ছে অনু বুঝেছে। অনু চালাক। তারপরেও ওকে আমি কীভাবে বের হয়ে যেতে বলি! মনুষ্যত্ব বলে তো একটা কথা আছে।”
“আমিও জানি না। বিয়ের দুবছর গড়াতে চলল একটা সন্তানের মুখ দেখাতে পারলি না । আমিও আর ভাবতে চাই না। রিহির মাকে কথা দিয়েছি। উনি সাফ জানিয়ে দিয়েছে। ওই মেয়ে এখানে থাকলে উনি নিজের মেয়ে দিবে না। আর আমিও উকিলের সাথে কথা বলেছি। পেপার আমার আলমারির উপরের তাকে আছে। নিয়ে ওই মেয়েকে দেয়। সে যেন সাইন করে চলে যায়।”
অনু যা ভাবলো তাই হলো। কিছু ভুল প্রমাণিত হলো না । তার আর আদিত্যর জবাব শুনতে ইচ্ছে হলো না। আদিত্য দুদিকে
দুটো রূপ বজায় রেখে চলতে দেখে তার ঘৃণা হলো। মুখোশের আড়ালে মানুষটার কথা সে আর ভাবতে চাইলো না। সে রুমে চলে এলো।
অনু রুমে এসেই দরজা বন্ধ করে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। কী থেকে কী হয়ে গেল সে বুঝে উঠে পেল না। আজকের দিনেই তো অনুর সন্দেহ হলো আর আজকের দিনেই কিনা একসাথে সব বের হয়ে এলো! তার আড়ালে এতো ঘৃণ্য নাটক চলছিল আর সে কিনা টেরই পেল না! এই কিনা সেই আদিত্য!
অনু শাড়ীর আঁচলে মুখ চেপে ধরলো যাতে কান্নার আওয়াজ বাইরে না আসে। বাবা সবসময় বলতো, “নিজের দুর্বলতা অন্যকে প্রকাশ করতে নেই এতে অন্যরা অসময়ে সুযোগ নিবে।”
অনু মুখ চেপে “বাবা ” বলে কেঁদে উঠল। আজ বাবাকে ভীষণ করে মনে পড়ছে। এই মানুষটা মা মা’রা যাওয়ার পরে থেকে অনুর একমাত্র আপন। আদিত্য আসার পরে ভেবেছিল বাবার পরে বুঝি কেউ হাত বাড়ালো তার দিকে! কিন্তু না…সে ভুল ভেবেছিল।
মানুষ পাল্টায়। সময়ের সাথে সাথে আগের সেই মানুষ আর থাকে না। হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
অনুর বড্ড বেশি কান্না পাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত সে জানে না। সে মোবাইল হাতড়ে বাবার নাম্বারে কল দিল। ফোন বেজে গেল কিন্তু ধরলো না। অনু ফোন রেখে দিল।
ওইপাশ থেকে অনবরত দরজা ধাক্কাচ্ছে আদিত্য। অনুর দরজা খুলতে ইচ্ছে করলো না। অথচ এতদিন সে নিজেই চাইতো আদিত্য একটু তার কাছে আসুক আর আজ সে নিজেই অবজ্ঞা করছে! পরিস্থিতির সাথে সাথে মানুষ বদলায়।
আজকের রাতটাই সে এই বাসায় কাটাবে। একটু নিজের মতো শেষদিনটা কাটাক। আর তো কোনোদিন ফিরে আসা হবে না।
অনু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তা দেখেই আদিত্য হাসলো।
অনুর ঘৃ’ণা হলো।
“কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ, এখানে এসে শুয়েছো যে!” আদিত্যর কথায় অনুর বিরক্ত লাগল। আদিত্যর এমন বহুরূপীটা অনু নিতে পারছে না। সে বিরক্তের সহিত জানালো,
“এতে তো তোমারই ভালো। গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।” আদিত্য বুঝতে পারেনি অনু হুট্ করে এমন কথা কেন বললো! তার সন্দেহ হলো, অনু কিছু শুনে যায়নি তো! তবু সে ঘাটলো না। আর জোরও করলো না। এতে অনুর খারাপ লাগলো। আদিত্য আজ তাকে এমনি মুখের উপর ডাকতে এসেছে। সত্যিকারেই সে আগাছা হয়ে পড়ে আছে এই সংসারে। কিন্তু সে তো এতো নিচু হয়ে থাকার পাত্র নয়। তার কী আত্মসম্মান নেই! লাগবে না আর এই সংসারে থাকার। অনু বিড়বিড় করে আওড়ালো, “ভালোবাসা মাই ফু’ট। আত্মসম্মান আগে।”
অনু আবারো মোবাইল হাতে নিল। সে আনিস মিয়ার নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবাকে মনে পড়ছে ভীষণ। এই সময় বাবার আদেশ বাণী গুলো তার ভীষণ প্রয়োজন। অনু দ্বিতীয়বারের মতো আবারো কল লাগালো। কিন্তু এই রাতে মানুষটাকে টেনশন দিতে ইচ্ছে হলো না তার। তাই দুই রিং পড়তেই সে কল কেটে দিল। পরপরই আনিস মিয়া কল দিলেন।
“মা।”
“বাবা।”
আনিস মিয়া মেয়ের এমন কণ্ঠে বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে। তিনি মেয়ের নীরবতায় বললেন,
“বাবাকে বল, হালকা হবি।”
“বাবা যদি আমি তোমার কাছে ফিরে যায় তুমি কী আগের মতো আমার দায়িত্ব নিবে?”
অনুর এমন কথায় আনিস মিয়া চমকালেন। তবু তিনি নিজেকে শান্ত করে উত্তর দিলেন, “বাবা সবসময় আছি আর থাকবো তোর সাথে।”
বাবার এমন কথায় অনু শান্তি পেল।
“ঘুমিয়ে পড়ো বাবা।” বলেই সে কল কে’টে দিল।
ভোর ৪টা।
ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগতেই অনুর শীত শীত অনুভূতি হলো। সে গায়ে উড়না জড়াতে নিতেই দেখল ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাতে সে ইচ্ছাকৃত ভাবেই খোলা জানালার পাশে ঘুমিয়েছে যাতে তাড়াতাড়ি আলো ফুটলেই তার ঘুম ভেঙে যায়।
সে নিঃশব্দে আছিয়া বেগমের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। উনার ঘুম ভারী তাই উঠবে না।
অনু নিঃশব্দে সরাসরি আলমারি খুলে ডিভোর্স পেপারটা নিয়ে রুমে চলে এলো। ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন সে নীরব রইলো। এরপর তড়িঘড়ি সাইন করে ফেলল। সাইন করে সেটা টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে রেখে দিল। আর পাশে অনুর এতদিনের মোবাইলটাও রেখে দিল। এই মোবাইলটা আদিত্যই তাকে দিয়েছিল। সে আদিত্যর কোনো জিনিসই নিয়ে যাবে না।
বের হওয়ার আগে অনু শেষবারের মতো আদিত্যর রুমে গেল। এতদিন এটা তাদের রুম ছিল। আর আজ থেকে এই রুম, ঘর, সংসার সবকিছু থেকে সে বিচ্ছেদ নিয়ে নিলো। অনু নিশাচরের মতো সম্পূর্ণ ঘর ঘুরে দেখলো শেষবারের মতো। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে। এতদিনের সংসারে এই ঘরটা তার অনেক শখের ছিল। কত যত্নে এই ঘরে সে রান্না করতো। পুরো ঘরে ছোটাছুটি করতো। আদিত্য অফিস যাওয়ার সময় অনু এক দৌড়ে রুমে যেত আরেক দৌড়ে রান্নাঘরে আসতো। সেই চিত্রগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই অনুর অশ্রু আটকাতে পারলো না। সে নাক টেনে সযত্নে তা মুছে নিল। আজ থেকে অনু মুক্ত।
অনু এক কাপড়েই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সে পেছনে ফিরে শেষবারের মতো বাড়িটির দিকে তাকালো। অশ্রুমাখা চোখে বিড়বিড় করে আওড়ালো, “তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক চিরতরে শেষ হলো।”
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক করা হয়নি,ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অঅনুরোধ রইল।)