চৈত্র_শেষে #নাজমুন_বৃষ্টি #পর্ব ৭

0
54

#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৭

“পড়াশোনার জন্য সময়?এমনিতে একবছর পিছিয়ে পড়েছিস। কোনোমতেই ইন্টারটা দিয়েছিলি।”

এইবার অনু থমকালো। তার বাবা পড়াশোনার কথা বলছে। আর সে কিনা বিরূপ জিনিস ভেবে নিচ্ছিলো! সে তো এতক্ষন এটার জন্যই ভাবনায় পড়েছিল। অবশ্য, তারই বা দোষ কিসের! বাবার কথার ধরণটা তো ভিন্নই ছিলো।

“বাবা, তুমি কখন থেকে এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছো?”
“এইতো এখন থেকেই। যাই হোক, তোমার অপ্রিয় পড়া কিন্তু আবার শুরু করা লাগবে। বাবার কথা শুনবে তো?”

“হ্যাঁ, সব শুনবো।”
মেয়ের কথা শুনে আনিস মিয়া হাসলেন। হেসে জানালেন,
“আজকে ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। তুমি ফ্রেস হয়ে নাও গিয়ে।” বলেই তিনি বেরিয়ে যেতে গিয়ে অনুর ডাকে ফিরলো,
“কিছু বলবি?”

“বাবা তুমি আজ অফিসে যাওনি যে?”
“তোকে দেখে ছুটি নিয়েছি। এইবার তাড়াতাড়ি গোসল করে নেয়। আমি আসছি।” বলেই তিনি চলে গেলেন।

আর অনু উঠে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি খুলতেই দেখতে পেল তার বিয়ের আগের সব ড্রেস গুলো সারি সারি সাজানো গুছিয়ে রাখা আছে। তা দেখেই অনু মলিন হাসলো। এই বাবা আছে বলেই সে আরেকটা প্রাণ পেয়েছে যেন।
অনু আলমারিতে থাকা কাপড়গুলোর উপর হাত বুলালো। এটা আজকে নয়। অনুর যখন বিয়ে হয় তখন একদিনের জন্য আসলেও অনু কাপড় আনতো না। আনিস মিয়া মেয়ের কাপড় জিনিস সবগুলো খুব যত্নের সহিত গুছিয়ে রাখতেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রতি ঈদে আরেক মেয়েকে সাথে সাথে অনুর জন্যও জামা বানিয়ে নিয়ে এসে আলমারিতে রাখতেন। অনুর বিয়ের পরেও তিনি একই কাজ করে যেতেন। কারণ অনু শশুরবাড়িতে সবসময় শাড়ীই পড়তো। এখানে আসলেও যদি শাড়ি পড়তো তবে আনিস মিয়া রেগে জানাতেন,
“এখানে তুমি আমার আগের মেয়ের মতোই থাকবে। এখানের জিনিস আছে পড়ার। তুমি ঐগুলোই পড়বে।”
অনু হাসলো। পৃথিবীতে এই বাবা আছে বলেই জীবনটা এতো সুন্দর। অন্তত অনুর তো তাই মনে হয়।
রাহেলা বেগম এজন্য অনুকে একটু বেশিই অপছন্দ করেন। অনুকে নিয়ে আনিস মিয়ার অতি যত্নটা তার আদিক্ষেতা মনে হয়। উনি এটা বাড়াবাড়ি হিসেবেই নেন।
অনু আলমারির কাপড়ের নিচে ডেস্কটা খুলল । বিয়ের পরে এই ডেস্কটা তার সেরকম করে আর খোলা হয়নি। কারণ এই ডেস্ক এ সে তার প্রয়োজনীয় সব সার্টিফিকেট সব পছন্দের জিনিসগুলো রাখতো। যেগুলো এই দুইবছরে তার মনেও পড়েনি। সে তো ভুলেই বসেছিল তার সার্টিফিকেট পড়াশোনার কথা। কারণ বিয়ের পরে সেই সম্ভবনা একদমই ছিল না।
আদিত্যর সাথে যখন বিয়ে হয় তখন অনু উচ্চমাধ্যমিক দিবে। বিয়ের পরে পরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার তারিখ ছিল কিন্তু আদিত্যর মা একদম রাজি ছিল না। মায়ের সম্মতিতে আদিত্যও অনুর বিপক্ষে গিয়ে জানিয়েছিল তার মা যা বলবে তাই হবে।
আদিত্য আর তার মায়ের মন রক্ষার্থে অনুও আর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরী হয়নি। কিন্তু সেসময় আনিস মিয়া এক প্রকার জোর জবরদস্তি করে অনুকে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
যেহেতু বিয়ের প্রথম প্রথম তাই আদিত্যও আর অনুর বাবার বিপক্ষে যায়নি কিন্তু সে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো তার মাকে রাজি সে করাতে পারবে না। তখন আনিস মিয়া বাধ্য হয়ে আছিয়া বেগমের সাথে বসে অনেক ঝামেলা শেষে অনুকে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।
আনিস মিয়া চেয়েছিলেন, মেয়েকে তার কাছে রেখে ভালোভাবে মন দিয়ে পরীক্ষাটা দেওয়াবেন কিন্তু আদিত্যর মা রাজি ছিল না।
অনু পরীক্ষার দিনও সকাল সকাল উঠে রান্নাবান্না সব সেড়েই পরীক্ষা দিতে যেত। যদিও সেই অভ্যাস তার আগে থেকে ছিল বলেই হয়ত তেমন একটা সমস্যা হয়নি কিন্তু পড়ায় মনোনিবেশটা সে ঐভাবে দিতে পারেনি। আর প্রথম পরীক্ষাটাতেও কেউ তার সাথে যায়নি। আদিত্য তখন মায়ের চোখে খারাপ হওয়ার ভয়ে অনুকে একাই পাঠিয়েছিল।
সেদিন অনুর প্রথমবারের মতো খারাপ লেগেছিলো। কারণ বিয়ের আগে এরকম পরীক্ষায় আনিস মিয়া মেয়ের সাথে সবসময় যেতেন। উনার যত জরুরী কাজই থাকুক না কেন উনি মেয়েকে দিয়ে আর নিয়ে আসতেন। কিন্তু আদিত্য সেটা করেনি, সে তার অফিসের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে।
যদিও পরের পরীক্ষা গুলো আনিস মিয়াই নিয়ে গিয়েছিলেন অনুকে। কারণ মেয়ের থেকে উনি স্বভাব সুলভ জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরীক্ষা কেমন দিয়েছে। তখনই যখন জানতে পেরেছে অনু একা গিয়েছে তখন তিনি অনেক রাগারাগী করেছিলেন। পরেরদিন থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তিনি মেয়েকে তুলে নিতেন আর দিয়েও যেতেন। মেয়ে পরেরবাড়ি গেলেও তিনি তার আদর্শ বাবার কাজটি করতে ভুলেননি। অনু জানে, ঐসময় বাবা তার উপর রেগে ছিল কিন্তু অনু বুঝেও কিছু বলতে পারেনি কারণ সে নিজেই আদিত্যকে বেছে নিয়েছিল।

অনু ঐদিনই কিছুটা অনুধাবন করেছে যে সে হয়ত ভুল করেছে। বাবার মতো কেউ হয় না। আর আদিত্য তো একদমই নয়।
এমন জানলে অনু কোনোদিন লেখাপড়াটা ছেড়ে দিতো না। বাবার কথানুযায়ী সে পড়াশোনার পেছনে লেগে থাকতো। তাহলে আজ হয়ত এতো গ্যাপ পড়তো না!
অনু চোখ মুছে ফেলল। সেসব এখন স্মৃতি। সে বুঝেও তখন বুঝলো না। না বোঝার ভাণ করেছিল। এখন আর এসব মনে করেও লাভ নেই। তিক্ততাপূর্ণ স্মৃতি গুলো তাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছু দিবেই না।

অনু তার পরনের শাড়িটার উপর হাত বুলালো। এই শাড়িটায় শেষ যে আদিত্যর বাড়ি থেকে এনেছে। আর কিছু সে আনেনি। হয়ত এটাই তার শেষ স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।
অনু জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইল। সে আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়ালো। যেন কাউকে প্রশ্নঃ করছে, “কেন করলে আদিত্য এমনটা? আমি তো ভালোই বেসেছিলাম তোমাকে। আর তুমিও তো বেসেছিলে। তবে কেন হলো এমনটা! ভালোবেসে এক হয়েও চিরজীবন থাকতে পারলাম না কেন?”

অনুর চোখ ভিজে উঠলো। যে মানুষটা এতদিন তার পুরো মন প্রাণ জুড়ে ছিল সেই মানুষটার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই সেটা অনু ভাবতে পারছে না।
বিয়ের পরে যখন প্রথম এখানে এসেছে তখন অনুর এক অন্যরকম খুশি লেগেছিলো। ঐদিকের খুশি আর এদিকের খুশি। কিন্তু খুশি বেশিক্ষন থাকতো না কারণ আদিত্য একদিন হওয়ার আগেই তাকে নিয়ে যেত। তার জন্য একটু মন খারাপ হলেও আদিত্যর এতো যত্ন ভালোবাসাতে অনুর ভালো লাগতো।
অনুর এখনো মনে হচ্ছে, আদিত্য আসবে। এসে জানাবে, “তুমি তো জানো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না। তবে কেন ছেড়ে এলে আমায়। চলো আমার সাথে যাবে।”
অনুর চোখ গড়িয়ে জল নির্গত হলো। নিজেরই অজান্তে আদিত্য তার সব স্মৃতিতে রয়ে গেল। অনু হাসলো। আজ থেকে বাপেরবাড়িতে সে অনেকদিন থাকবে, একেবারের জন্য এখানেই থাকবে। অনু তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য আর কেউ বায়না ধরবে না। সে বায়না ধরার মানুষটাই পাল্টে গেল!

——-
আদিত্যর এই অবস্থা দেখে আছিয়া বেগম শক্ত হলেন। না, ছেলেকে তিনি দুর্বল হতে দিবেন না। কিছুতেই ওই মেয়ের দিকে ঝুঁকতে দেওয়া যাবে না। অনেক কষ্টে সে এসব তাড়াতে পেরেছে। আর না।
আছিয়া বেগম আদিত্যর পিঠে হাত রাখলো।
আদিত্য চুপ রইল।

“আদিত্য বাবা কী হয়েছে তোর?”

আদিত্য মায়ের জবাব দিল না। সে উঠে সোজা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
আছিয়া বেগম ভয় পেলেন। তার মনে কোনো একটা আশংকা আসতেই তিনি জড়োসড়ো হয়ে গেলেন। না আর সেই ভুল সে করবে না। সবকিছুর উপরে তাদের সুখ আগে। আর সেই সুখ দিতে একমাত্র রিহিই পারবে। তাই তো রিহির সাথে বিয়ে দেবার ইচ্ছে। আসলে উনি আগে থেকেই রিহিকে বউ করে বোনের সম্পত্তির দিকে ঝুকেন। রিহি একমাত্র মেয়ে। রিহি বউ হয়ে আসলে আগে পরে সব সম্পত্তির মালিক আদিত্যই হবে। অনেক আগে থেকেই আছিয়া বেগমের ইচ্ছে এটাই ছিল। পরিকল্পনামাফিক তিনি রিহির পরিবারের সাথে ভালো খাতিরও গড়ে তুলেন। কিন্তু মাঝখানে অনু চলে আসায় সব গরমিল হয়ে যায়। তাই তো অনুকে তিনি একদম পছন্দ করেননি।
এইবার অনেক কষ্টে আছিয়া বেগম এই সুযোগ পেয়েছে। সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। এবং খুব তাড়াতাড়িই সব করতে হবে। কোনো গ্যাপ রাখা যাবে না। এই কিছুদিনের মধ্যেই করা লাগবে। যত গ্যাপ রাখবে ততো ক্ষতি। তিনি সাথে সাথে রিহির নাম্বারে কল দিলেন।
——-

সারাটা দিন অনু তাদের গেটের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। আজ আর অন্যবারের মতো আদিত্য এলো না। আদিত্য ফিরলো না। এসে জানালো না, “অনু আমি থাকতে পারছি না তোমাকে ছাড়া। প্লিজ চলো।”
অনুও হেসে ভাবের সহিত জানাবে, “দেখেছো আমার ক্ষমতা!”
আদিত্য হাল ছাড়ার ভাণ করে স্বীকার করবে, “হ্যাঁ মহারানী। দেখলাম। এইবার চলেন।”
অনুর চোখ ভিজে উঠলো। সে আরেকবার তাকালো গেটের দিকে। চারদিকে অন্ধকারে ঢাকা। অনুর মনে হচ্ছে, আদিত্য আর কিছুক্ষন বাদে আসবে। সে তাকিয়ে রইল। না, আদিত্য এলো না। আদিত্য কী তাহলে সত্যিই ভুলে গেল অনুর কথা! অনু হাসলো। সে তো সব কানেই শুনেছে তবু কেন আশা করছে সে! মানুষটা যে আর আগের মতো নেই! যেখানে সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গিয়েছে সেখানে আর কিসের আশা রাখছে সে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক করা হয়নি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। অনেকে বোনাস পর্ব চান, আসলে অনেক কষ্টে লিখালিখিতে ফেরা। এখনো পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। তাই তো একটা গল্পের পরপর এতো এতো মাস গ্যাপ যায়। দোয়া করবেন, যেন খাপ খাইয়ে নিতে পারি। এতমাস পরে ফিরেও যে সাপোর্ট দিচ্ছেন আপনারা এটাই শুকরিয়া। কৃতজ্ঞতা রইল। আপনারা আমার ভরসা, আস্থা সব। ভালোবাসা নিবেন 💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here