তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন পর্ব ৬ #জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

0
61

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ৬

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

আহনাফ ক্লাশে প্রবেশ করার আগেই ক্লাশের মেয়েরা তাদের ব্যাগে রাখা ছোটো আয়না- চিরুনি দিয়ে নিজেদের চেহারা আর চুল ঠিক আছে কিনা সেসব দেখতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার তুলি দিয়ে মুখে কমপ্যাক্ট পাউডারও মাখে। শুধুমাত্র ত্রিশা এর ব্যতিক্রম। বরাবরের মতো ত্রিশার মধ্যে এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

সব মেয়েদের উদ্দ্যেশ্য হ্যান্ডসাম স্যারকে যদি একবার প্রেমের জালে ফেলা যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে!
এসব মেয়েদের দলে ত্রিশারই প্রিয় দুই বান্ধবী স্নিগ্ধা আর ঊষাও অন্যতম।

রাত্রি আর ত্রিনার বয়ফ্রেন্ড আছে বলে তারা এসব করতে সাহস করে না, কিন্তু মনে মনে তারাও আহনাফ স্যারকে পছন্দ করে। তা মাঝে মধ্যে ওদের কথায়ই প্রকাশ পায়।

তবে স্নিগ্ধা আর ঊষা আহনাফের জন্য বলতে গেলে দিওয়ানা।
আহনাফকে পাওয়ার জন্য এরা একে অপরের সতীন হতেও রাজী।
আহনাফ যখন ক্লাশের ঠিক দরজায়, তখনো স্নিগ্ধা আর ঊষা সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত!

ত্রিশা এদের দুজনকে একটা ধমক দিয়ে বললো,

” থামবি তোরা? স্যার যদি এসে তোদেরকে দিয়ে কান না ধরায়..!”

ঊষা ত্রিশাকে একটা ভেংচি কেটে বলে, ” কান ধরালে সবার সামনে এক্কেবারে কিস দিয়ে দিবো বুঝলি?”

ত্রিশা চুপ হয়ে যায়, মনে মনে ভাবে, “মেয়ে দুটো বলে কি! মাথা মুন্ডু ঠিক আছে নাকি?”

ত্রিশাকে আরো দু’ বার ভেংচি কেটে ওরা সাজগোজ বন্ধ করে।

আহনাফ ক্লাশে ঢুকতেই একটা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রান শ্রেণিকক্ষকে শীতল করে দিলো।

স্নিগ্ধা ফিসফিস করে ঊষাকে বলে, ” এই স্যার কি পারফিউম মাখে রে? পাগল হয়ে গেলাম রে..!”

বলতেই আহনাফ স্নিগ্ধার সামনে এসে কড়া ধমকের স্বরে বললো,

“শ্যানেল, আমার পারফিউমের ব্রান্ড শ্যানেল, হ্যাপি? নাউ টেইক ইউর পেন এন্ড পেপার, হারি!”

স্নিগ্ধা আর ঊষা এদিকে স্যারের ধমক খেয়েও মিটিমিটি হাসতে থাকে। ধমক যেনো ওদের কাছে অগ্রাহ্য।
স্যার যে ওদের কথা শুনে ওদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, তাতেই ওরা যেনো মহাখুশি।

অন্যদিকে ক্লাশের অপর দুষ্টু মেয়ে বিভা; আহনাফের একথা শুনে আহনাফকে বলে উঠে,

” থ্যাংক ইউ স্যার, পারফিউমের নামটা বলার জন্য, আমার ও এই ব্রান্ডটা অনেক পছন্দের, এই ব্রান্ডের পারফিউম অনেক কড়া আর সেএক্সি হয় স্যার! তাই না?”

বলে জিহবায় একটা কামড় দেয় সে।

আহনাফ জানে বড়লোক বাবার বখে যাওয়া এই মেয়ে বিভা, ভীষণ ই দুষ্ট আর বদের হাড্ডি। একে অন্যভাবে শায়েস্তা করতে হবে। তাই ওর কথাকে গায়ে না মেখেই তার লেকচার দেওয়া শুরু করে।

” স্টুডেন্ট, তোমাদেরকে গতকাল একটা সূত্র পড়িয়েছিলাম, মনে আছে?”

ক্লাশের সবাই একযোগে ” জ্বী স্যার ” বলে উঠলো।

এখন বিভার কাছাকাছি এসে আহনাফ জিজ্ঞেস করলো,

বিভা তাহলে বলো তো, ” সাইন এ প্লাস বি এর সূত্রটা? ”

বিভা আমতা আমতা করে বলা শুরু করে,

” স্যার..ইয়ে মানে, ইয়ে…মানে.. সূত্রটা আই গেস, আই গেস, সাইন এ প্লাস বি…তাইনা? সাইন এ প্লাস বি মানে… ”

বিভা ঢোক গিলতে থাকে।

“…সাইন এ প্লাস বি মানে সাইন এ ফর আহনাফ প্লাস বি ফর বিভা!”

এ কথা বলতেই গোটা ক্লাশ হেসে লুটিয়ে পড়ে।

আহনাফ রেগে আগুন হয়ে গেলো,

” ইউ আর ঠু মাচ বিভা! উঠে দাঁড়াও, আর কান ধরে ক্লাশের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো”

গোটা ক্লাশ স্তব্ধ হয়ে গেলো।

স্যারের পানিশমেন্ট শুনে বিভা কাঁদো কাঁদো হয়ে কান ধরে ক্লাশের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।

বিভাকে কান ধরে বাইরে দাঁড়া করানোয় গোটা ক্লাশ যেনো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসলো।
বিভার মতো গুন্ডি মেয়েকে কান ধরে দাঁড় করিয়েছে দেখে সবার পিলে পানি নাই হয়ে গেলো।

এবার আহনাফ ক্লাশের একদম লাস্টের বেঞ্চিতে মলিন সাদা স্কার্ফ মাথায় দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসা ত্রিশার দিকে একপলক তাকালো।
মনটা তার দুলে উঠলো যেনো। এই সে মেয়ে, যে গতরাতে ভালো লাগার আশ্বাস দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিলো এ মন। ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়েছিলো আহনাফের মনে। এত সহজ, সরল, শান্ত আর নি:স্পাপ এই মেয়ে! সাদা, মলিন পোশাকেও এত স্নিগ্ধ সুন্দর তার আর কাউকেই কোনোদিন লাগেনি।
আচ্ছা, এতদিন কেনো সে মেয়েটাকে লক্ষ্য করেনি? নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিলো সে।

মনে মনে এসব সাতপাঁচ ভেবে সে আবার পড়ানো শুরু করলো। ক্লাশে পিনপতন নিরবতা। সবার চোখ আহনাফের পানে নিবদ্ধ। আহনাফ বোর্ডে তিনটি ভিন্ন সাইজের বৃত্ত এঁকে নিলো। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের মাপও পাশে লিখে দিলো। তারপর বলা শুরু করলো,

” আসলে তোমরা যতটা কঠিন ভাবছো, এই ট্রাইগোনোমেট্রিক ইকুয়েশন গুলো এতটা কঠিন কিছু নয়, সবকিছু একদম রুপকথার গল্পের মতোই সোজা। আমার মনে হয় তোমাদের একদম ব্যাসিক থেকে শুরু করা উচিত। বৃত্তের পরিধি আর ব্যাসের অনুপাত সবসময় ই একটা ধ্রুব বা স্থির সংখ্যা হয়, তা তোমরা জানো? ”

গোটা ক্লাশ একযোগে ” হ্যাঁ” বললো।

স্যার ত্রিশাকে উদ্দ্যেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো।

” ত্রিশা বলো তো, বৃত্তের পরিধী ও ব্যাসের অনুপাত কত? ”

বিভাকে কান ধরিয়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে দেখে ত্রিশার ভীষণ ভয় হচ্ছিলো, সে ভয়ে ভয়েই বললো,
” স্যার, থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফোর ওয়ান সিক্স”

” আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি এই বোর্ডে এসে তা প্রমাণ করে দেখাও তো”

ত্রিশা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছিলো। কোনোক্রমে হেঁটে বোর্ডের সামনে গিয়ে স্যারের হাত থেকে মার্কার নিয়ে বুঝাতে শুরু করলো।
মার্কার নেওয়ার সময় আহনাফের হাতের আলতো স্পর্শ তার হাত ছুঁয়ে গেলো।
আহনাফের মনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেলো।

ত্রিশা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলা শুরু করলো,

” স্যার, এই বৃত্তের পরিধিকে যদি নিজেদের ব্যাস দিয়ে ভাগ করি, তাহলে প্রতিবারই একই সংখ্যা অর্থাৎ তিন দশমিক এক চার এক ছয় হবে, যেমন এখানে প্রথম বৃত্তের পরিধী এক্স ও ব্যাস ওয়াই। এক্স কে যদি ওয়াই দ্বারা ভাগ করি তাহলে প্রত্যেক বারই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা থ্রি পয়েন্ট ওয়ান ফোর ওয়ান সিক্স হবে”

ত্রিশা আরো বেশি উদাহরন দিয়ে বর্ণনা করতে পারতো কিন্তু এটুকু বলেই থেমে গেলো। গতরাতে স্যারের যেসকল ঝাড়ি খেয়েছিলো, তাতে স্যারের প্রতি ওর ভয় বেড়ে গিয়েছে। অবশ্য স্যারকে কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়নি বলে লজ্জায় ওর সংকোচ বেড়ে গিয়েছে।

তবে এটুকুতেই আহনাফ ত্রিশাকে বাহবা দিলো,

” ভালো বলেছো ত্রিশা! এবার নিজের আসনে গিয়ে বসো”

নিজের আসনে গিয়ে বসতেই আহনাফ বলে উঠলো,
” এবার কেউ একজন এসে সাইন এ প্লাস বি এর ইকুয়েশন এক্সপ্লেইন করো প্লিজ, যা আমি গত ক্লাশে তোমাদের পড়িয়েছিলাম”

ক্লাশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র নিলয় এলো ইকুয়েশন ব্যাখ্যা করতে।

নিলয় ইকুয়েশন ব্যাখ্যা শেষ করতেই আহনাফ পড়ানো শুরু করলো।

ক্লাশের সকল ছেলেমেয়ে মুগ্ধ নয়নে স্যারের কথা শুনছে আর নোট ডাউন করছে।

তবে একজন বাইরে দাঁড়িয়ে রাগে ও ক্ষোভে দাঁত কটমট করছিলো। আর মনে মনে বলছিলো,

” আমাকে পানিশ করে, স্যারকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে, জানে না তো আমি কে? কার মেয়ে?”

সে আর কেউ নয়, বরং বিভা।

.

.
কলেজের ক্লাশ শেষ হতে বিকেল চারটা। এর পর ত্রিশার চার বান্ধবী বিভিন্ন বিষয় প্রাইভেট পড়লেও ত্রিশা বাড়ি চলে যায়। কারন ওকে কোনো প্রাইভেট দেওয়া হয়নি। কনকচাপা অনেক বলেও একটা প্রাইভেট দেওয়ার জন্য জহির কে রাজী করাতে পারেনি।

ওদিকে ত্রিনা সবাইকে জোর করতে লাগলো, আজ প্রাইভেট না পড়ে যেনো রবির আমন্ত্রনে যায় সবাই। রবি আজ কলেজের সামনে ” টেস্টি ট্রিট” রেস্টুরেন্টে সবাইকে থাকতে বলেছিলো।

ঊষা ত্রিনাকে বাহবা দিয়ে বললো,

” অন্তত: মাসে একবার হলেও রেস্টুরেন্টে খেতে পারার জন্য তোর মতো একটা বয়ফ্রেন্ড চাই ই চাই রে ত্রিনা”

ত্রিনা চোখ মিটিমিটি করে হেসে বললো,

” শুধু কি ট্রিট? সাথে গিফট ও আছে রে জানু”

বলেই নিজের ব্যাগ খুলে দেখালো রবি ওর জন্য সুন্দর একটা ড্রেস আর ইয়ারিং নিয়ে এসেছে।

ত্রিনা ড্রেস টা বুকে জড়িয়ে হেসে বললো,

” রবি দেখতে কালো হলে কি হবে, হি ইজ মাই ব্লাক ডায়মন্ড”

স্নিগ্ধা মুখ কালো করে বললো,

” বারে! তোর বয়ফ্রেন্ডকে আমরা আবার কবে কালো বললাম?”

ত্রিনা বললো,

” জানি জানি, আমার বয়ফ্রেন্ড কালো আর রাত্রির টা সাদা ফুরফুরা বলে তোরা সবসময় আমাকে ডাউন মিন করিস”

স্নিগ্ধা আর ঊষা দুজনেই মুখ বেজার করে ” না” বোধক মাথা নাড়লো।

ত্রিনা এবারে গর্ব করে বললো,

” ডাউন মিন করিস তাতে কি? আমার বয়ফ্রেন্ড পড়ে বুয়েটে আর রাত্রির টা জাতীয় ইউনিভার্সিটি তে, কারটা আগে?”

স্নিগ্ধা আর ঊষা দুজনের বলে উঠলো,

” হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবা তোর জনই বড় রে বান্ধবী, তোর জনই আগে”

ত্রিশাও বলে উঠলো,

” বুয়েট তো বুয়েট ই, এর সমান আর কি আছে? আর রবি ভাইয়া যে লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট! ওর সমকক্ষ আর কে হয়? রবি ভাইয়া…”

ত্রিশা রবির উদ্দ্যেশ্যে আরো কিছু বিশেষণ যোগ করতেই যাচ্ছিলো তখনি ঊষা ওকে থামিয়ে বললো,

” তুই তো দেখি রবি ভাইয়ের সেই লেভেলের ফ্যান, ওর প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ থাকিস সারাক্ষণ, ব্যাপারটা কি?”

জবাবে ত্রিশা বললো,

” প্রশংসা করার মতোই সে, তাই প্রশংসা করি”

ত্রিশার কথা শুনে ত্রিনা খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।

আসলে রবিও ত্রিশার মতো অনেক দু:খী। ছোটো বেলাতেই বাবাকে হারিয়েছে। তবুও শুধু নিজের চেষ্ঠা আর পরিশ্রমেই বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে। তাই রবি ত্রিশার কাছে এক আইডল। আর রবিও ত্রিশাকে ভীষণ ই সমীহ করে ” বোন” বলে সম্বোধন করে।

এবার দূর থেকে তারা সবাই রবিকে দেখতে পেয়ে বলতে লাগলো,

” রবি ভাইয়া জিন্দাবাদ! রবি ভাইয়া জিন্দাবাদ”

রবি হাসিমুখে কাছে আসতেই ত্রিনা নিজের ওড়না দিয়ে রবির মুখের ঘাম মুছে দিলো।

তিন বান্ধবীই চোখ পিটপিট করে হাসিমুখে এ দৃশ্য দেখতে লাগলো।

স্নিগ্ধা আর ঊষা রেস্টুরেন্টে ঢুকলেও ত্রিশা রবির কাছে অনুনয় করে বললো,

” আজ না ভাইয়া, অন্য একদিন যাবো, আজ বাসায় জরুরি কাজ আছে”

রবি ত্রিনা কে ভীষণই সমীহ করে।

সে ত্রিনাকে “বোন” বলে সম্বোধন করে বলল,

” এ পর্যন্ত একবারো তুমি আমার দাওয়াত গ্রহন করলে না বোন, নাও এই চকলেট গুলো তোমার ”

ত্রিশা খুশি হয়ে চকলেট গুলো নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

আর বাকিরা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলো।

ত্রিশা পাঁচ মিনিট হেঁটে যেতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আশেপাশে কোনো দোকানপাটও নেই। কাপড় ও ব্যাগ ভিজে যেতে লাগলো। আশ্রয়ের খোঁজে এদিক ওদিক দৌড় শুরু করলো। এমন সময় একটা ছাতা ওর মাথার উপর এগিয়ে এলো।

“একি? আহনাফ স্যার!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here