#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন
পর্ব : ৫
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
ববিতা শেখের বাড়ির চারতল বিশিষ্ট সুরম্য অট্টালিকার কোনো স্থানে সামান্য অসুন্দর দেখালেও সেটা সুন্দর করতে চলে আসে পাঁচ জন!
বাড়ির নাম ‘রেইনবো টাওয়ার’।
চারতল বিশিষ্ট, সাতরঙ্গা এ বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। বাহারী ফুল সেখানে শোভা বিলায়। ববিতা শেখ সকাল থেকেই এসব সামলাতেই ব্যস্ত থাকে। মালী, চাকর-চাকরানী, গাড়োয়ান, দাঁড়োয়ান সবাই তারই কথায় উঠে বসে। তার পরনে সবসময়ই থাকে দামী শাড়ি। আর শরীর ভর্তি অলংকার। মাথার সাদা চুলগুলো তিনি পরম যত্নে লাল রং করে রাখেন। চোখে ভারী চশমায় স্বর্ণের চেইন লাগানো থাকে। একটা পানদানি আর পিকদানী হাতে তার একজন পার্সোনাল চাকরানী সবসময় তার পেছনে পেছনে থাকে।
অযথাই হাঁক ডাক করে তিনি বাড়িসুদ্ধ মানুষজনের মধ্যে ত্রাশ সৃষ্টি করতে পছন্দ করে।
একমাত্র ছেলে জহিরের একাধিক বিয়ে ও পরকিয়া প্রেমের খবরে সে গর্ববোধ করে।
তার মতে ” ধনী ও স্বামর্থবান পুরুষ মানুষের একাধিক বিয়ে করা সুন্নত!”
আর তার মতে, ইচ্ছে করলে পুরুষ মানুষ একাধিক রক্ষিতাও রাখতে পারে।
সে প্রায়ই বান্ধবী ও প্রতিবেশিদের সাথে আলাপে বলে থাকে ,
“খোকা আমার( জামিল) এত টাকা কামাই করলো জীবনে, আর দুই চারটা রক্ষিতা? এটা আর এত খারাপ ভাবার কি হলো? এই সব তো পুরুষ মানুষের স্বৈর্য বির্যের প্রতীক!”
তার এসকল যুক্তিকে মনে মনে কেউ না মানলেও, মুখে কেউ তার সামনে অস্বীকার করে না।
তার দুই কণ্যা ইন্দু ও বিন্দু বিয়ের পর থেকে স্বামিসহ বাবার বাড়িতেই থাকে। ইন্দুর এক ছেলে থাকলেও বিন্দুর কোনো বাচ্চা নেই। ইন্দু ও বিন্দু দুজনের স্বামী যথাক্রমে পাভেল ও নয়ন দুজনেই তাদের সম্মন্ধি জহির শেখের ব্যবসায় টুকটাক কাজকর্ম করে আর বাড়িতেই বসে থাকে সারাক্ষণ। দুই বোনের বয়সই ত্রিশের কোঠায়। কিন্তু সারাক্ষণ এমনভাবে থাকে যেনো আঠারো বছরের যুবতি। ঝকঝকে, টকটকে কাপড় আর সারাদিনই মেকাপ মুখে লাগিয়ে বসে থাকে। দেখতে হাস্যকর আর জোকারের মতো দেখালেও কেউ তাদেরকে কিছু বলার সাহস পায় না। আজব দুই ক্যারেক্টার এই ইন্দু আর বিন্দু। বড় লোকের বখে যাওয়া মেয়েরা যেমনটি হয় এরাও তেমনটি। ত্রিশার সৌন্দর্য্যে এরা দুজনই বেশ জ্বলতে থাকে।
কয়েকদিন আগেও ত্রিশা ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়েছিলো। কাপড় নাড়তে নাড়তে ওড়না টা বুকের উপর থেকে সরে যাচ্ছিলো। ইন্দু ঈর্ষাকাতর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। কখনো ত্রিশাকে ছুঁয়ে না দেখলেও সেদিন এসেছিলো ওর শরীরের মাপ নিতে। ভ্রু দুটি কুঁচকে বলেছিলো,
” এই তোর বুকের মাপ কতো রে? তোর ফিগার আয়শা টাকিয়ার মতো হলো কিভাবে রে? ও তো শুনেছিলাম প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলো বলে…”
এদিকে আয়শা টাকিয়া কে? তা না জানা ত্রিশা লজ্জায় আর সংকোচে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে ত্রিশা।
আর প্রায়ই বিন্দু ত্রিশাকে জিজ্ঞেস করে,
” মুখে কি মাখিস রে ত্রিশা? তোর গায়ের রং তো দিনকে দিন ফর্সা হচ্ছে রে! প্রেম টেম করিস নাকি? ছেলেদের শরীরের টাচ না লাগলে শরীর এতো ফর্সা হয় কেমনে? নাকি অন্য কিছু? ”
এসব কথা শুনে ত্রিশা লজ্জায় বাঁচে না।
লজ্জায় মাথা নত করে ” না ” শব্দটা উচ্চারন করে সে ভোঁ দৌড়।
ওদিকে কনকচাপাও ত্রিশাকে সাবধান করে দেয় যেনো পাভেল আর নয়নের সাথে বেশি কথা না বলে, পাছে আবার ইন্দু বিন্দু কি না কি বানিয়ে বলে ওদের নামে। কারন গাড়ির লাইসেন্স না থাকলেও চলে না, কিন্তু ইন্দু বিন্দুর মুখের কথার কোনো লাইসেন্স নেই।
জহিরের সাথে বিয়ের পর কনকচাপার এই সংসারে আরো দুটো ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছে। ছেলে দুটোর নাম ধ্রুব ও মুগ্ধ। ধ্রুবর বয়স আট আর মুগ্ধর ছয়।
ধ্রুব আর মুগ্ধর সাথে ত্রিশা নিজের আকাশ পাতাল পার্থক্য খুঁজে পায়। ওদেরকে যেখানে ববিতা মাথায় তুলে নাচায়, তেমনি ত্রিশাকে ছেঁড়া পাপশের সমানও কদর দেয় না।
তবে ছোট্ট মুগ্ধ ত্রিশাকে খুব ভালোবাসে।
এই বাড়িতে এতগুলো লোকের মধ্যে শুধু ইন্দু ও বিন্দুর স্বামী পাভেল ও নয়ন ই শুধু ত্রিশার পড়াশোনার খবর নেয়। কোনো গৃহশিক্ষক না থাকায় পাভেল আর নয়ন ই মাঝে মাঝে ত্রিশার পড়াশুনার দেখভাল করে। এমনকি স্কুল,কলেজের গার্ডিয়ান মিটিং এও এই পাভেল আর নয়নই কনকচাপার হয়ে অংশগ্রহন করে। যদিও সবই হয় ববিতা শেখ আর তার দুই মেয়ের অগোচরে।
কনকচাপা মানা করার পরো এই মানুষ দুটো ছাড়া ত্রিশার আর আপন বলতে কেউ নেই। আর কনকচাপা সারাদিন ব্যস্ত থাকে এতগুলো মানুষের রান্না সামলাতে যদিও বাড়িতে ডজন খানেক কাজের লোক আছে, তবুও ববিতা কখোনো কাজের লোকের হাতের রান্না খায় না। জহির ও একই দলে। কনকচাপার হাতের রান্নার এ বাড়িতে খুব কদর। মাঝে মাঝে জহির তার পার্টনার ও ক্লায়েন্টদেরও এ বাড়িতে দাওয়াত করে থাকে কনকচাপার হাতের রান্না খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু কনকচাপা এটা আঁচ করতে পারে যে তাকে রান্নার কাজে ব্যস্ত করে রাখাই জহিরের আসল উদ্দ্যেশ্যে। ব্যবসায় সিদ্ধহস্ত জহির কোনো দিক থেকেই তার খাতায় লস নামক বস্তুটি ঢুকতে দেয় না। কনকচাপাকে বিয়ের সময় তার বাবা ও ভাইকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা সে দিয়েছিলো। তাছাড়া কনকচাপা প্রতি মাসেই তার বাবা, মা ও ভাইয়ের খরচের টাকাও জহিরের কাছ থেকে নিয়েই দেয়। তাই বিনিময়ে রান্নাঘরের কাজটুকু সে হাসিমুখেই করে থাকে।
কিন্তু ত্রিশা এসব কিছু জানে না বলেই নিজের মা কে সবসময়ই ভুল বুঝে এই বলে যে, মা ওকে মোটেও সময় দেয় না। কনকচাঁপাও নিজের এ দোষ অকপটে স্বীকার করে নেয়। মেয়েকে নিজের অস্বচ্ছল বাবা মায়ের কাছে না রেখে নিজের কাছে রেখেই বা সে কি দিতে পেরেছে? শুধু অযত্ন আর অবহেলাতেই সৎ বাবার ঘরে সে বড় হচ্ছে। জহির মানুষের সামনে নিজেকে জাহির করার জন্য ত্রিশাকে নিজের নাম দিয়ে ভালো স্কুল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু ভেতর ভেতর কোনোদিনও সে কোনোদিন ত্রিশাকে সামান্য সমিহও করেনি।
.
.
পরের দিন ত্রিশার ঘুম ভাঙ্গলো সকাল নয়টায়। দশটায়ই কলেজে ওর ক্লাশ। বেশি রাত করে ঘুমানোর কারনে উঠতেই পারেনি ও। গতরাতে আহনাফ স্যার কল দিতে বলেছিলো মনে হতেই ও আতঙ্কিত হয়ে গেলো৷ মনে মনে বললো,
“এখন কি হবে? স্যার হয়তো ভুল বুঝবে? কিন্তু আমার ফোন কই যে কল দিবো?”
তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে কলেজের জন্য তৈরি হয়ে দে ছুট। নিচে নামতেই ববিতা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” এতক্ষণে উঠেছে জমিদারের নাতনি, কই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ছোটো দুই ভাইকে একটু পড়াবে, আর তার ঘুম থেকে উঠারই খবর নাই”
ত্রিশা জানে যে, ওর ছোটো দুই ভাই ধ্রুব ও মুগ্ধ কে পড়াবার জন্য রোজ সকালে টিচার আসে। তাহলে ওকে কেনো বকাবকি করা হচ্ছে?
ত্রিশা কখনো ববিতার সামনে মুখ উঁচিয়ে কথা বলার সাহস পায় না। কারন একবার মুখ উঁচিয়ে কথা বলার জন্য অনেক মেরেছিলো। কনকচাপাও সাহস পায় নি ফেরানোর। পরে পাভেল আর নয়ন এসে ছাড়িয়েছিলো৷ ঐ ঘটনার পর থেকে সে ববিতার সামনে মুখ উঁচিয়ে কথা বলে না। তাই মাথা নিচু করেই বললো,
” দাদী, ওদের টিচার?”
ববিতা আদেশের স্বরে বললো,
” ওদের টিচার আর আসবে না, তুমিই প্রতিদিন সকালে ওদেরকে পড়াবে আগামীকাল থেকে”
একথা শুনে বিরক্ত হলেও ত্রিশার কিছুই করার ছিলো না। ওর নিজের পড়াই ও পড়ে শেষ করে সময় পায়না আর সেখানে ভাইদের পড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবুও ত্রিশা ‘না’ শব্দটি ব্যবহার করলো না।
বরং আস্তে করে “আচ্ছা” বলে চলেই যাচ্ছিলো।
ঠিক তখনই কনকচাঁপা একটা টিফিন বাটি টুপ করে মেয়ের ব্যাগে পুরে দিলো। মেয়ে তার সকালে না খেয়ে গেলো, দুপুরে কিছু খাওয়ার টাকাও দেওয়া হয়না, তাই দুপুরের টিফিনটা অন্তত: তুলে দেওয়া যাক। ত্রিশা কিচ্ছুটা না বলে হনহন করে বেরিয়ে পড়লো।
গেইট দিয়ে বের হতেই ওর আরো দুই বান্ধবী তৃণা, ঊষা ও স্নিগ্ধা এসে হাজির। ওদের ফ্রেন্ড গ্রুপে মূলত পাঁচ জন মেয়ে ত্রিশা, রাত্রি, তৃণা, ঊষা ও স্নিগ্ধা।
ওদের গ্রুপকে সবাই “স্টার জলসা পার্টি” নামেই জানে।
কারন এরা সবাই স্টার জলসার মতোই নাটকবাজ!
ত্রিশা নাটকবাজ না হলেও এদের সাথে মেশে বলে নামটা ওর ও হয়ে গিয়েছে।
যদিও বাকি চারজন মোটামুটি ভালোই দুষ্ট হলেও ত্রিশা একেবারেই চুপচাপ। সবাই জানে ত্রিশার নিজের বাবা নেই আর মায়েরও যত্ন নেওয়ার সময় নেই বলেই ওর এত দু:খ। তাই সবাই ওকে অনেক সাপোর্ট করে। সবাই জানালো রাত্রি আজ যাবে না, কারন গতরাতে ও সারা রাতই জেগেছে। একমাত্র বড় বোনের বিয়ে বলে কথা। গোটা এক সপ্তাহই রাত্রি আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই কয়েক দিন তাহলে রাত্রিকে সবাই মিস করতে যাচ্ছে। ত্রিশা বাদে বাকি সবারই সাইকেল আছে। ওরা সাইকেলে করেই যায়। তাই একে একে সবাই একেকদিন ত্রিশাকে লিফট দেয়।
ত্রিশাদের বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েরা সবাই প্রাইভেট কারে করে চলাফেরা করে সেখানে ত্রিশা সামান্য অটো ভাড়াও পায় না এটা আশেপাশের অনেকেই আফসোস করে। জামিল তার যেসকল স্ত্রী কে তালাক দিয়ে দিয়েছে, সেসব ঘরের সন্তানদেরো সে প্রাইভেট কার বা বড় বড় জিনিস গিফট করে তবে ত্রিশাকে কোনো কিছুই দেওয়া বারণ। কারন একটাই ত্রিশা অন্যের বংশধর, যেচে পড়ে তার কাছে চলে এসেছে।
বান্ধবীরা এক্ষেত্রে ত্রিশাকে ” বেচারি ত্রিশা” মনে করে। তবে ত্রিশা এসব নিয়ে নয়, তার দু:খ শুধু জীবনে বাবার আদর পেলো না এটাই।
সেদিন ত্রিশাকে সাইকেলে করে নিয়ে যাচ্ছিলো ত্রিনা। হঠাৎই ত্রিনার বয়ফ্রেন্ড রবি বাইকে করে হাজির হলো। রবি বিশাল ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ে। ত্রিশারও অনেক ইচ্ছা একদিন রবির মতো বুয়েটে পড়বে। অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। রবি এসেই ওদের তিনজনকে দেখে ” হাই ” বললো। ভার্সিটি ছুটি হলেই রবি বাড়ি চলে আসে। আর নিজের টিউশনির জমানো টাকায় ত্রিনার জন্য এটা ওটা কিনে আনে সাথে ওদের পাঁচ বান্ধবীকেই ট্রিট দেয়। সেদিনও কলেজ ছুটির পর পাঁচ তারকা কে ক্যাফেতে বিকেলের নাস্তার ট্রিট দিবে সেই খবর ই জানিয়ে গেলো রবি। তবে ত্রিশা বেচারি তো আর যেতে পারবে না। ওদিকে কলেজে ক্লাশের সময় হয়ে যাওয়ায় সবাই হাইস্পিডে প্যাডেল দিলো।
.
.
কলেজে ম্যাথ ক্লাশের ঘন্টা পড়লো। আহনাফ ক্লাশে ঢুকার আগে মেয়েদের মধ্যে যেনো উৎসব লেগে যায়।
“আহনাফ স্যার আসছে রে! আহনাফ স্যার আসছে, বলে একজন চেঁচিয়ে উঠলো। ”
ত্রিশার বুকের মধ্যে ধুকধুকানি বেড়ে গেলো!
(চলবে)