তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন (সূচনা পর্ব)

0
245

“এইই এই মেয়ে, তুমি বিয়েবাড়িতে এটা কি ড্রেস পড়ে এসেছো? আর তুমি জামিল সাহেবের স্টেপ ডটার ত্রিশা না? ”

জীবনে প্রথম কোনো বিয়েতে এসে অচেনা এক মহিলার কাছে এরকম প্রশ্ন শুনে ত্রিশা আৎকে উঠলো। ভীষণ অনাকাংখিত এই প্রশ্নটিই ও যতই এড়িয়ে যেতে চায় ততই প্রশ্নটি ওর সামনে হানা দেয়। মহিলাটার আপাদমস্তক অর্নামেন্ট দিয়ে আবৃত। দেখে মনে হচ্ছিলো সে অর্নামেন্টের দোকান সাথে করে এনেছে। ত্রিশার মনে হচ্ছিলো মহিলাটা তার শরীরের সাথে করে লাগিয়ে গহনা ফেরি করে বেড়াচ্ছে।

ত্রিশা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছিলো না দেখে মহিলার পাশে ওরই বয়সের একটা মোটু ছেলে বলে উঠলো,

” তোমরা তো অনেক আধুনিক ফ্যামিলি ভেবেছিলাম, এখন তো তোমাকে দেখি একটা ক্ষ্যাত”
বলেই সেই মোটু খ্যাক খ্যাক করে হেসে দিলো।

” নাহ! আপনি যাকে ভাবছেন আমি সে না”
বলে ত্রিশা নিজের সুদীর্ঘ কোঁকড়ানো কেশগুচ্ছ উড়িয়ে দৌড়ে পালালো।

ত্রিশার বয়স আঠারো। কিন্তু আঠারো বছরের কৌশরী শরীরের ভেতরে সে একটি আট বছরের শিশুসুলভ মন মাটি চাপা দিয়ে রাখে। চঞ্চল ও উড়ুক্কু মনটা এককক্ষে আবদ্ধ থাকে সর্বদা কেননা সৎ বাবার সংসারে তার বাস। সৎ বাবা জামিল শেখ এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্বনামধন্য ব্যাবিসায়ী জামিল শেখ ত্রিশাকে কোনোদিনই কোথাও যাওয়ার অনুমতি দেয় না। পরাধীনতার শিকড়ে আটকে থাকা ত্রিশা আজ বহু কষ্টে বান্ধবীর বড়বোনের বিয়েতে আসার সুযোগ পেয়েছে।
বিয়ে বাড়ির নিয়ন বাতির সাজসজ্জা, নানা পদের ব্যঞ্জন, পাত্র পাত্রীর জৌলুস, ফটোসেশন ও ডিজে লাইটের আলো, মেহমানদের চাকচিক্যময় বেশভূশা আর অলঙ্কারের নিক্ক্বণ শব্দের মধ্যে নিজেকে সে সিন্ড্রেলার মতোই কালিযুক্ত ও নগন্য মনে করলো। কিন্তু সিন্ড্রেলার মতো কোনো যাদুকর মা তার নেই, যে তাকে তার যাদু দন্ডের ছোঁয়ায় সাধারণ থেকে প্রিন্সেস বানিয়ে দিবে।

ঝাপসা চোখে ত্রিশা নিজের পোশাকের দিকে তাকালো। একটা পুরাতন হয়ে যাওয়া লেহেঙ্গা ও একটা পুরাতন চুমকি খচিত শিফনের ওড়না শরীরের একপার্শ্ব দিয়ে মোড়ানো। বিয়েবাড়ির সবার চেয়ে মলিন পোশাক হলেও এটাই ওর সর্বোচ্চ ভালো পোশাক!

সেই বিয়ে বাড়িতেই স্টেজ থেকে অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে একজনের সাথে গল্প করছিলো আহনাফ সিদ্দিক। পেশায় ত্রিশারই কলেজের লেকচারার, বয়স সাতাশ। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, উচ্চতা পাঁচ ফিট এগারো। বলিষ্ঠ, সুঠাম, পেশিবহুল পেটানো দেহ।
ত্রিশার চোখে পানি থাকায় দৌড়ে আসার সময় সে কলেজের ন্যাশনাল ক্রাশ ওরফে আহনাফ সিদ্দিককে ধাক্কা লাগিয়ে দিলো। আহনাফের হাতে ছিলো বোরহানির গ্লাস। আর ধাক্কা খেয়ে সেই গ্লাসের তরল প্রথমে আহনাফের কারুকাচিত সাদা পাঞ্জাবীতে এবং পরে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। আহনাফ রেগে আগুন হয়ে গেলো কিন্তু মানবতার খাতিরে কিছুই প্রকাশ করলো না। তার রাগের কারন শুধু গ্লাস ফেলে দেওয়াই নয়, বরং ত্রিশা ঐ মহিলাকে যা বলেছে সেটাও। প্রচন্ড ন্যায়বাদী আহনাফ সিদ্দিকের মিথ্যে কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।
আহনাফ ঈশারায় ত্রিশাকে কাছে ডাকলো। ভীরু পায়ে সে আহনাফের কাছে এলো। আহনাফ সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,

” আমি যতদূর জানি তোমার বাবার নাম জামিল শেখ, শহরের গন্যমান্য ব্যবসায়ীদের একজন, আর তুমি ঐ ভদ্র মহিলাকে তা অস্বীকার করলে কেনো?”

নিজের কলেজের স্যারের মুখে এরকম প্রশ্ন শুনে সে আরো ভড়কে গেলো। জবাবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে ত্রিশা কেঁদেই দিলো। ওর মনে ভয় হতে লাগলো এখন স্যার যদি বাবাকে বলে দেয় যে সে নিজের বাবাকে মানুষের সামনে অস্বীকার করেছে বা স্যারকে ধাক্কা মেরে তার কাপড় নষ্ট করে দিয়েছে, তাহলে তো বাবা তাকে মেরেই ফেলবে। সাথে মা কেউ মারবে খুব। এখন কি করবে সে?

” স্যরি স্যার, প্লিজ, মাফ করুন”
বলতেই চোখে পানি চলে এলো ওর। আর কিছুই বলতে পারলো না।
তাই আহনাফই স্বেচ্ছায় ওকে বললো,
” ঠিক আছে, যাও যাও”

আহনাফ ভেবেই কূল পেলো না, মেয়েটা পাগল নাকি? আমি এমন কঠিন কি জিজ্ঞেস করেছি যে, প্রশ্ন শুনে এভাবে কাঁদে? তাছাড়া পাঞ্জাবী নষ্ট করেছে, সেজন্যতো কিছু বলিইনি।
আহনাফ ভাবতে লাগলো, এই মেয়েটাই কলেজের একমাত্র মেয়ে যে কোনোদিন ওর সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্ঠা করেনি, কোনোদিন ঢং করে ন্যাকা ন্যাকা কন্ঠে গায়ের উপর ঢলে পড়ে কোনো পড়া বুঝিয়েও চায়নি। সাদামাটা একটা কলেজ ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে একটা আধাছেঁড়া জুতা আর ব্যাগ নিয়ে মেয়েটা কলেজে আসে। মহিলাটা তো প্রশ্ন করলো স্টেপ ডটার এর কথা, তাহলে কি মেয়েটা জামিল শেখের স্টেপ ডটার অর্থাৎ সৎ মেয়ে?
হতে পারে! সেজন্যই মেয়েটার প্রতি এত অযত্ন! হয়তো এই সত্য স্বীকার করে নেওয়ার মতো সৎ সাহস মেয়েটার মধ্যে নেই বলেই মেয়েটা দৌড়ে পালিয়েছে। আহারে! মেয়েটার নিজের বাবা নেই! আর মেয়েটা নিশ্চয় ভীষণ লজ্জিত হয়েছে, ভেবে সে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটার প্রতি সমবেদনায় তার মন ভরে গেলো।

এবার মূল ঘটনায় আসা যাক। আজ ত্রিশার বান্ধবী রাত্রির বোন রত্নার বিয়ে। রাত্রি, রত্নার বাবা শহরের একজন ব্যবসায়ী। তিনি রাত্রির কলেজের সকল শিক্ষকদেরই রত্নার বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছেন। বস্তুত:পক্ষে রত্নাও ঐ একই কলেজেরই একজন প্রাক্তন ছাত্রী। তাই তার সব শিক্ষকদেরই দাওয়াত করা হয়েছে। তবে আহনাফ সিদ্দিক একজন নতুন শিক্ষক। সদ্যই পয়তাল্লিশ তম বিসিএস এর একজন শিক্ষা ক্যাডার দিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। গনিত ছিলো তার বিষয়। তুখোড় মেধাবী আহনাফ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতো। অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতো। একবার সরকার দলের নেতা কর্মিদের দের হাতে মার খেয়ে পা ভেঙ্গে, মাথা ফাটিয়ে একমাস ঘরে বসে ছিলো। একমাত্র ছেলে হওয়ায় মা তাকে মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি কাটালো যেনো আর কোনোদিন রাজনীতি না করে। উপায় না পেয়ে মায়ের মাথায় হাত দিয়ে মায়ের কথামতো দিব্যি কাটলো। সেবার বছরই অনার্স শেষ হলো। পঁয়তাল্লিশ তম বিসিএস এর ফরম ফিল আপ করে একে একে প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইবায় একবারের চেষ্ঠায় উত্তীর্ণ হলো। শিক্ষা ক্যাডার পেলো। বার বার একই পদে চেষ্ঠা করার ধৈর্য্য তার ছিলো না। তাই, ভার্সিটি লাইফের প্রেমিকাটাও ওকে ছেড়ে দিলো মেজিস্ট্র‍্যাট স্বামি পেয়ে। যে একসময় সরকারের সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, তার সরকারী প্রসাশনে চাকরি করে সরকারের গোলামী করার ইচ্ছে হলো না। নিজের জেলা শহরেই সরকারি কলেজে নবনিযুক্ত গণিত শিক্ষক এখন আহনাফ। কলেজে নিয়োগ পেয়েই সবার মন সে কেড়ে নিয়েছে। অভিনব কায়দায় পাঠদান। চমৎকার বাগ্মিতা, বন্ধুসুলভতা ও গণিতকে তিনি এমনভাবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরেন যেনো তা কোনো ছেলে ভুলানো গল্প। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অত্র কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের সবচেয়ে পছন্দের শিক্ষকে পরিণত হলেন। সেই সাথে একদল ছাত্রীর ক্রাশ। এর কারন তিনি অসম্ভব রকম হ্যান্ডসাম। তার চশমার ফ্রেম থেকে শুরু করে পায়ের জুতা সবকিছুই অত্যন্ত ক্লাসি ও রুচিশীল। সেই সাথে নজরকাড়া গায়ের রং ও উচ্চতা। পেশিবহুল স্থুল দেহ। কিন্তু তার কাছে পাত্তা পাওয়া কোনো মেয়েরই এ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে গণিত বিষয়ে যদি কেউ তার সাথে আড্ডা দিতে চায় তবে তিনি অল এভেইলএবল। কিন্তু এরকম কঠিন বিষয় গণিত নিয়ে কে ই বা তার সাথে আড্ডা দিতে যাবে! তাই তিনি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে কিছু ছাত্রী অকারনেই তার কাছে রং ঢং করে ম্যাথ বুঝার নাম করে তাকে ঈশারায় প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আহনাফ এসকল বিষয়ে ভীষনই স্ট্রিক্ট। কখনো কোনো মেয়ে তার কাছে পাত্তা পায় না। আহনাফ প্রাইভেট পড়ায় বিশ্বাসী নয়। যে ম্যাথ বুঝবে সে ক্লাশেই বুঝবে। প্রাইভেট পড়ানো আর শিক্ষা নিয়ে ব্যাবসা করা একই কথা বলে মনে করেন তিনি।

অন্যদিকে রাত্রির বাবা আজমিন ইসলাম ত্রিশার সৎ বাবা জামিল শেখের একজন বিজনেস পার্টনার।
তাই বিয়ে বাড়িতে আসার জন্য রাত্রির অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেন নি। ওদিকে ত্রিশা আসার পর থেকে রাত্রিকে খুঁজেই চলছে। কিন্তু রাত্রি সেইই ব্যস্ত, একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা। স্যারের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে বাড়ির তিনতলার একটা রুমে খুঁ সে রাত্রিকে পেয়ে গেলো। সব আয়োজন শেষ হলেও নতুন জামাইয়কে স্বাগতম জানানোর জন্য তাজা ফুলের মালা তৈরি করাই হয়নি। আর রাত্রি সেটাই করছিলো। ত্রিশাকে দেখা মাত্রই রাত্রি যার পর নাই খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরলো।

” তুই তাহলে এসেছিস ত্রিশা! যা খুশিই লাগছে আমার!”
বলেই ত্রিশার দিকে তাকালো। হালকা সাজেই বান্ধবীকে তার নায়িকাদের মতো সুন্দর লাগছিলো তবে ড্রেস টা বেশ পুরাতন তা রাত্রির নজর এড়ালো না। তাই ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

” এটা কি পড়েছিস রে জানু আমার? যা এক্ষুণি যা, তোর জন্য একটা ড্রেস কিনে রেখেছি আমি, পড়ে আয় শিগগির ”

রাত্রি জানতো যে জামিল শেখ ত্রিশাকে কোনো নতুন ড্রেস কিনে দেয়না, তাই নিজেই জমানো টাকায় ত্রিশার জন্য একটা ড্রেস কিনে রেখেছিলো। ত্রিশার হাতে একটা বড় প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে তাড়া দিলো রাত্রি। প্যাকেট খুলতে খুলতে ত্রিশা ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে। ভেতরে একটা চমৎকার লেহেঙ্গা দেখা যাচ্ছে। মনে মনে প্রাণের বান্ধবীকে ধন্যবাদ জানালো সে।

ত্রিশা বাথরুমের দরজা লাগিয়ে পড়নের লেহেঙ্গার সবগুলো বোতাম খুলে যেই না টান দিয়ে হাতে নিয়ে এসেছে ওর চোখ তো চড়কগাছ! উল্টোদিক হয়ে কাপড় পরিবর্তন করছে তারই কলেজের স্যার আহনাফ! আহনাফের পড়নে শুধু আন্ডারগার্মেন্টস ছাড়া আর কিছুই নেই। আহনাফ চমকে ত্রিশার দিকে তাকাতেই ত্রিশা দ্রুত তার উন্মুক্ত শরীর ঢাকতে ঢাকতে চেঁচিয়ে বলা শুরু করলো,

” প্লিজ স্যার, আমাকে দেখবেন না, প্লিজ!”

আহনাফের মেজাজ গরম হয়ে গেলো, সে ফিসফিসিয়ে বললো,

” এই মেয়ে বলে কি? আমি আগে ঢুকেছি এই বাথরুমে, আর তুমি কোন সাহসে ঢুকে পড়েছো এখানে? আমাকে নিয়ে একটা সিন ক্রিয়েট করার ইচ্ছে তোমার? আর আমাকে বলে যে, দেখবেন না প্লিজ! তোমাকে দেখতে আমার বয়েই গেছে! বাইরে বেরোও তারপর তোমার বিচার করছি ”

বলেই আহনাফ দ্রুত তার সব কাপড় পড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। ত্রিশা দ্রুত গেট লক করে দিলো। নতুন ড্রেস পেয়ে ত্রিশার যতটা খুশি লাগছিলো তার সবটাই নিমেষেই মিলিয়ে গেলো আহনাফের শাসানি শুনে। ড্রেস পরিবর্তন না করেই সে বাথরুমে বসে কাঁদতে শুরু করলো।

(চলবে)

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

(সূচনা পর্ব)

লেখিকা:

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here