প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১৬

0
62

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬

ফাটা বাঁশের চিপা বলা হোক বা মাইনকার চিপা তৌসিফ পরলো দু’টোর মাঝ বরাবর। না বেরুতে পারছে না টিকতে। দরজা কপাট আটকে ওর মুখোমুখি বিছানায় পা ভাজ করে বসেছে পৌষ। চোখ মুখে তার উপচে পড়া দুত্যি যার পুরোটাই ছড়াচ্ছে তৌসিফ’কে বড় মাপের এক আইক্কা ওয়ালা বাঁশ দেয়ার জন্য। পৌষ’র এহেন চকচকা চোখ তৌসিফ আজ অবদি দেখেছে বলে মনে পরলো না৷ মেয়েটার চোখে শুধু পানি, দুষ্টামি অথবা রাগের দেখা মিলতো। আজ তার কেন এত কৌতুহল? হওয়ার অবশ্য কথা কিন্তু তৌসিফের মনে হচ্ছে ভিন্ন কিছু। পৌষ’র এই একাগ্রতা শুধু মাত্র তৌসিফের সাথে সোহা’র কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই এটা জানার জন্য। নারী যেমন ই না কেন তার স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীকে সহ্য করবে না। প্রকৃতি তাদের সহ্য করার ক্ষমতা বেশি দিলেও তা ক্ষেত্র বিশেষে। স্বামী যতই খারাপ হোক না কিন্তু চরিত্রহীন মানতে নরাজ নারী৷
তৌসিফের কেন জানি ভালো লাগলো ব্যাপারটা। পৌষ’র উৎসুচক মুখটা দেখে মৃদুস্বরে হেসে বললো,

— হানি…..

— আপনার হানির কাঁথা পুড়ি। মুদ্দায় ফিরুন।

খটখটা গলায় পৌষ কথা বলতেই তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। শুধালো,

— আমার বাবাকে চিনো?

— নামে৷

— হু। তুমি ছোট ছিলে যখন মা’রা গিয়েছেন। হাফ প্যান্ট পরতা।

রাগে দাঁত কটমট করলো পৌষ। এসব শুনতে চায় নি ও। তবুও ধৈর্য ধরলো। মুখে শুধু বললো,

— আপনি এখনও পরেন। সেসব বাদ দিন৷

তৌসিফ একটু হেসে বললো,

— বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো। আমরা কেউ জানতাম না পৌষরাত। কিন্তু বাবা যখন মা’রা গেলেন তার আগে শুধু আমাকে বলেছিলেন এই কথা। তার দ্বিতীয় পক্ষে একজন মেয়ে আছে। বড় ভাই বা মেঝো ভাই কেউ ওকে স্বীকার করলো না। অবশ্য বাবা ওর নামে যথেষ্ট সম্পদ ও রেখেছেন। ভাই রা এতে আপত্তি করে নি কিন্তু তারা কেউ সোহা’র দায়িত্ব নিতে নারাজ।

— বোনকে কাজের মেয়ের পরিচয়ে কেন রেখেছেন?

— আমি রাখি নি। আমি কখনো বলি নি কাজের মেয়ে। ভাবীরা ছড়িয়েছে এই কথা। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও লাভ নেই পৌষরাত। আমার দুই ভাই আগে। আপা আগে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে সোহা’কে নিয়ে কিছু বললে। বড় ভাইকে ওয়াদা দিয়েছিলাম সোহা’র বংশীয় সত্যি কাউকে জানাব না। আজ তা ভাঙতে হলো তোমার জন্য।

— তাই বলে আপনার গায়ে লাগে না যখন সবাই আপনার চরিত্রে আঙুল তুলে? আপন সৎ বোন নিয়ে কথা এসব নোংরা কথা বলে?

— আমার সামনে আজ পর্যন্ত কেউ বলে নি। ভাসা কথায় কান দেই না আমি।

— সব জেনেও আপনার ভাইয়া কেন চুপ করে থাকে? তাদের বংশের নাম নীচু হয় না এতে?

— নাম নীচু হবে যদি শুনে যে বাবা’র অবৈধ সন্তান আছে।

মৃদু কেঁপে উঠলো পৌষ। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। তৌসিফ আচমকা পৌষ’কে নিজের দিকে টেনে নিলো। আচমকা এমনটা ঘটাতে চকমকানো সুযোগটা ও পেলো না পৌষ। তৌসিফ ওর চোখে আসা চুলগুলো যত্ন সহকারে কানের পিছনে গুজে দিতে নিলেই দেহ বাঁকিয়ে গেলো পৌষ’র। জানা নেই কেন এই লোকের স্পর্শ গায়ে লাগলেই কেমন জানি অনুভূতি হয় পৌষ’র। মনে হয় তারা সারা অঙ্গ আন্দোলিত হয়। বুকের মাঝে থাকা গভীর হৃদে পানির ঝলাৎ ঝলাৎ শব্দ হয়। তৌসিফ দুই হাতে পৌষ’র গাল সহ কান দুটো ও নিজের তালুর ভাজে নিয়ে নিলো। চোখে চোখ রেখেও নামিয়ে নিলো পৌষ। তৌসিফ গাঢ় কণ্ঠে বললো,

— তাকাও।

পৌষ সাহস যোগাতে অক্ষম হলো। কেন জানি হঠাৎ ই তার ভয় কাজ করছে। তৌসিফ ওর চোখে চোখ রাখার জন্য থুতনিটা তুলে ধরলো। পৌষ’র চোখ টলমল করছে। তৌসিফ এর কারণ জানে। এই অতিরিক্ত লাফঝাপ করা, চঞ্চল মনা প্রাণগুলো অতি আবেগী হয়। পৌষ’র মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আরেকটা সত্যি শুনবে পৌষরাত।

এবার কাজ হলো। সত্যি শুনার জন্য তাকালো পৌষ। তৌসিফ ওর থুতনির দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে মুখটা আগালো। আলগোছে একটা চুমু দিলো ওর থুতিনিতে। পৌষ গললো এতেই। হাত বাড়িয়ে তৌসিফের কলারটা চেপে ধরলো ও। তৌসিফ মুখটা সরিয়ে নিয়ে বললো,

— তুমি কারো পাপ না পৌষরাত।

ফট করে চোখ মেললো পৌষরাত। অতি আগ্রহ ওর চোখে মুখে। তৌসিফ বললো,

— বড় ভাই ওয়াদা করিয়েছিলো আমাকে যাতে সোহা’র সত্যি কাউকে না বলি। সোহা’র মা’কে বাবা বিয়ে করেন নি। কোন এক অতীত আছে এর যা আপাতত না জানলেও চলবে তোমার। তবে হ্যাঁ ভাইয়া পুরোপুরি অস্বীকার করেন। কিন্তু আমি ছোট ছেলে হয়ে বাবা’র কথা অস্বীকার করতে পারি নি।

পৌষ ভাঙা গলায় বললো,

— আপনার বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছি আমি জারজ।

— তুমি জারজ না পৌষরাত। তুমি শরৎ ফুপির মেয়ে। কিন্তু শরৎ ফুপি হয়তো……

“ফুপি” শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকায় পৌষ। শরৎ তার মায়ের নাম। তৌসিফ ওকে আরেকটু নিজের কাছে টেনে বললো,

— দাদা চারটা বিয়ে করেছিলো।

— জানি।

— সবচেয়ে ছোট বউয়ের ই এক মেয়ের নাম শরৎ। শরৎ তালুকতার।

পৌষ’র মাথা ঘুরে উঠলো। এত এত প্যাঁচ তার ছোট সাদামাটা মস্তিষ্কে ঢুকছে না। তবুও জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে জারজ সন্তান কেন বললো?

— ভাইরা সৎ কারো সাথেই সম্পর্ক রাখে নি। রাগের মাথায় হয়তো শরৎ ফুপিকে জারজ বলেছে। শুধু মাত্র সেই সম্পর্কের জেড়ে ই তুমি আজ আমার ঘরণী।

এত এত অতীত একসাথে শুনে ধাক্কাগুলো সামলাতে পারলো না পৌষ। আচমকা ঢলে পরলো বিছানায়। তৌসিফ দুই হাতে আগলে নিয়ে বালিশে মাথাটা রাখলো। এক হাতে গালে আলতো চাপড় মে’রে ডাকলো চিন্তিত কণ্ঠে,

— পৌষরাত? পৌষরাত?

পৌষ চোখ খুললো না। তৌসিফ অস্থির হলো এবার। এতগুলো অতীত একসাথে মেয়েটাকে না বললেও হতো। তবে কেন জানি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলো। বলতে বলতে সবটাই বলে দিলো নাহয় পৌষ বারংবার নিজেকে ছোট করে দেখতো। জারজ ভেবে তৌসিফ সহ সকল থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতো।

___________________

রাতের বেলায় ই বউ নিয়ে বাড়ীতে পা রাখলো হেমন্ত। যেমন জোঁকের মতো বেঝে ভাই-বোন গুলো সাথে গিয়েছিলো তেমন ভাবেই ফিরলো। এদের হই হুল্লোড় দেখে মনে হচ্ছে হেমন্তের চলন আজ। সেখান থেকেই বুঝি প্রথম বউ নিয়ে বাড়ী ফিরলো। কমতি অবশ্য একজনের আর তা হলো পৌষ। না জানি কেমন আছে মেয়েটা। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে কি না তাও জানা নেই। বাড়ীর বড়রাও শ্রেয়া’কে দেখে যেন মাথায় তুলে ফেললো। বাড়ীর একমাত্র বউ সে আপাতত মা চাচীদের পরে। অতি আদরের কি না। ইনি,মিনি ঘুমে লেটকে আছে। চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য ওদের চাচির কাছে দিয়ে দিতেই চাচি তারাতাড়ি দুটোকে রুমে রেখে এলেন৷ এই কুট্টি চুনোপুঁটি দুটো সারাক্ষণ বড় দামড়া ভাই,বোনের সাথে পাল্লা দিয়ে সব জায়গায় যাবে। মুখের জড়তা কাটে নি অথচ এরা ধেই ধেই নেচে বেড়াবে ভাই, বোনের সাথে।

রাতে যেহেতু শশুর বাড়ী থেকে খেয়ে এসেছে তাই এখন ওরা কেউ ই খাবে না। হেমন্ত হাজার না করলেও শাশুড়ী শুনে নি। অগত্যা তাদের খেয়ে দেয়ে এত রাতে বাড়ী ফিরা। বাপ-চাচাদের সামনে বউ নিয়ে রুমে যেতে পারছে না হেমন্ত। ডাক দিতেও কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করছে। চৈত্র সবার সামনে একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে তার সদ্য হওয়া পুরুষ কণ্ঠে বললো,

— ভাবী রুমে যেতে বলেছে হেমু ভাই। তোমার নাকি মেডিসিন আছে।

ভাইয়ের এহেন ডাহা মিথ্যা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না হেমন্ত। শ্রেয়া উঠে যেতে যেতে মুচকি হাসলো। সে নিজেও ক্লান্ত।
.
রুমে ঢুকতেই দ্রুত হাতে দরজা কপাট লাগিয়ে শ্রেয়ার মাথার হিজাবটা খুলে দিলো হেমন্ত। মেয়েটার নিশ্চিত এতক্ষণ অসস্তি লেগেছে৷ হাজার খারাপ লাগলেও সে মুখ ফুটে বলে না৷ এটা ওর বহু পুরাতন স্বভাব যা হাজার বলে কয়ে হেমন্ত ঠিক করতে পারে নি। বোরকা খুলতেই ওয়াশরুমে ঢুকে শ্রেয়া। হেমন্ত যত তারাতাড়ি পারলো সব গুছালো। শ্রেয়া একটু অতিরিক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওর জানা এখন এই মেয়ে পোশাক বদলাবে অথচ সবেই ঐ বাসা থেকে বদলে এসেছে। খুঁত খুঁতে না হলেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিয়ে যথেষ্ট কড়া বলা চলে।

ওর জন্য একটা গোল ফ্রক আর প্রয়োজনীয় সব নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে হেমন্ত,

— শ্রেয়ু? তোমার কাপড়গুলো।

দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে নিলো শ্রেয়া। কাপড় বদলে বাইরে আসতেই হেমন্ত ও ফ্রেশ হলো। বের হতেই রুমের বাইরে পা রাখলো। কিচেনে ঢুকে গরম এক গ্লাস দুধ নিয়ে ফিরত এলো। শ্রেয়া তখন হাত পা গুটিয়ে বসেছে। হেমন্ত দুধ ওর মুখের সামনে নিয়ে বললো,

— এক টানে শেষ করো।

— পরে খাই?

— উহু। এখনই।

শ্রেয়া দুই চুমুক খেয়ে বললো,

— বাকিটুকু পরে খাই?

— এখন গন্ধ লাগছে না যতটুকু পারো খেতে থাকো প্রেয়ু। কিছুদিন পর যদি গন্ধ লাগা শুরু হয় তখন তো খেতে পারবে না।

অগত্যা সবটুকু গিলে খালি গ্লাস ফেরত দিলো হেমন্ত’কে। ওর ঠোঁটের উপরে লাগা দুধ টুকু হাত দিয়ে মুছে কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— গুড ওয়াইফ।

— ব্যাড হাসবেন্ড।

হেমন্ত লাইট অফ করে বিছানায় আসতে আসতে বললো,

— দাঁড়াও দেখাচ্ছি কিভাবে ব্যাড হাসবেন্ড হতে হয়।

শ্রেয়া হাসলো। হেমন্ত অতি নরম হাতে তাকে নিজের কাছে টানতেই জোরে শ্বাস টানলো শ্রেয়া। মুগ্ধ হওয়া চোখে তাকিয়ে দেখলো তার স্বামী’কে। চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। হেমন্ত একটু হেসে বললো,

— কি দেখো?

— আপনাকে।

— সারাজীবন দেখতে পাবে।

— মন যে ভরে না।

হেমন্ত ওর চোখের পাতায় চুমু খেলো। হাত দুটো ধরে বললো,

— ভালোবাসি।

_____________________

তৌসিফের সম্পূর্ণ ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পৌষ জ্ঞান ফিরার পর থেকেই এটা ওটা বলে যাচ্ছে। একটু খাওয়াতেই শক্তি পেয়েছে সে। আয়রন ডেফিসিয়েন্সি হওয়াতে এমনি সময়ই ওর মাথা ঘুরে। মেয়েটার স্নায়ু দূর্বল অথচ এর আচরণ বাঘা বাইন মাছের মতো। কাকে যে খাবে কাকে ছাড়বে নিজেও জানে না। তৌসিফ কপালে হাত দিয়ে ডলতেই পৌষ কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— এই যে কথা শুনেন না কেন?

— হানি, কথা শুনো৷

— আগে আমার কথা শুনুন৷ ওকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দিন৷ না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তৌসিফ বললো,

— ও বাঁশি বাজাবে না পৌষরাত।

— কি সমস্যা আপনার হ্যাঁ? আর হ্যাঁ মিনু…..

— শুউউউ।

পৌষ একটু থামতেই তৌসিফ বললো,

— মিনু আমার বোন না৷

— কিহ!

— ওর বয়স দেখে মনে হয় ও আমার বোন?

— আপানার খানদান’কে বিশ্বাস নেই। কোন জায়গায় কাকে পয়দা করে রেখে লুকিয়ে রেখেছে কে জানে।

— মিনু’কে সোহা এনেছে। এতিম একটা মেয়ে। সোহা ই পেলে বড় করেছে। ওর মা থাকে গ্রামে।

ভ্রুঁ কুঁচকায় পৌষ। এত কাহিনি শুনে সে বিরক্ত। খটখটে মেজাজে বললো,

— আমি ওকে সহ্য করব না।

— আচ্ছা করো না।

— এএএই মামাতো ভাই।

বি’স্ফোরিত চোখে তাকালো তৌসিফ। এই মেয়ে নতুন শব্দ কোথা থেকে বের করলো? শেষ পর্যন্ত কি না ওকে ভাই ডাকে? মামাতো ভাই?

#চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here