#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন
পর্ব ৮
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
“খুব সুন্দর একটা রাজপুত্রের বউ বানাবো তোমাকে ত্রিশামনি সেজন্য”
পান্না কেমন জানি একটা উপহাসের স্বরে কথাটা বললো। ত্রিশা বোকা হলেও ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এখানে কোনো একটা ষড়যন্ত্র আছে, যা ববিতা আর পান্নার মুখভঙ্গিই জানান দিচ্ছিলো।
পান্না ত্রিশাকে মেইক আপ করিয়ে উঁচু হাইহিল পড়িয়ে বিভিন্ন এংগেলে ছবি তুলতে লাগলো।
ছবি উঠাতে গিয়ে ত্রিশা খুবই লজ্জা পাচ্ছিলো। কারন পান্না ত্রিশার শরীরের বিভিন্ন অংশের ছবি তুলছিলো। কখনো বুকের, কখনো হাতের, আবার কখনো পায়ের আবার পশ্চাদ্দেশেরও। আবার হাঁটার ছবিও সামনে ও পেছনে থেকে ভিডিও করলো।
ত্রিশা মনে মনে ভাবলো, এটা কোনো ধরনের বেহায়ামী? মানাও করার সাহস পেলো না। কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পেলো না।
পান্না একগাল হেসে বলতে লাগলো,
” ছেলে আমেরিকায় থাকে, ওখানকারি সিটিজেন, আমার নিজের বড় বোনের ছেলে। আমেরিকায় ওরা কোটিপতি, বিরাট ধনি, নিজেদের প্রাইভেট হেলিকপ্টারও আছে, বলতে গেলে ডলারের উপর ঘুমায়, খুবই আধুনিক, ফ্রি মিক্সিং ফ্যামিলি ”
পান্না এই বলেই নিজের আই ফোনে একে একে ওদের প্রাইভেট কারের ভান্ডার, হেলিকপ্টার, বাংলো বাড়ি আর আভিজাত্য ও প্রতিপত্তির ছবি দেখাতে লাগলো, তারপর দেখালো একটা ছেলের ছবি।
একটা বীচে দাঁড়ানো ছেলেটা , শ্বেতবর্ণ, বয়স বুঝা যায় না। পড়নে হাফপ্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। হাতের আঙ্গুল গুলো ছড়িয়ে এমনভাবে রেখেছে যেনো বাঘ থাবা দিচ্ছে। ছেলেটার হাত পায়ের ভঙ্গিমা এমন যেনো সে একটা অটিস্টিক।
সংকোচ ভেঙ্গেই ত্রিশা বলে উঠলো, ” উনি কি অটিস্টিক?”
পান্না হাসতে হাসতে বললো,
” কি যে বলো? অটিস্টিক হবে কেনো, শুধু হাত পা আর মাথাটা একটু বেশি নড়ে আর কথা বলতেই সামান্য আটকে যায়! অপছন্দ হওয়ার কোনোই কারন নেই”
এবারে ত্রিশার সবকিছুই বোধগম্য হলো। দুনিয়ার সবকিছু যেনো তড়িতাহত হলো একথা শুনে আর ছবিটা দেখে।
মাথার মধ্যে কে জানি গর্জে উঠলো।
সে বড় স্বপ্ন দেখেছে যে বুয়েটে পড়বে। অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে রবি ভাইয়ার মতো। আর কিনা তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, তাও এক অটিস্টিক ছেলের সাথে?
পান্না ত্রিশার ছবিগুলো পাঠানো শেষ করে, ত্রিশাকে দেখালো,
” দেখো, তোমার সবগুলো ছবিতেই বড় আপা লাভ রি-এক্ট দিয়েছে। লিখেছে, মেয়ের ফিগার ও ফেস কাটিং তার ভীষণ ই পছন্দ হয়েছে।”
পান্না খুশিতে আটখানা হয়ে বলে উঠলো,
” তোমার ছবি দেখে মনে হচ্ছে একদম বাঙ্গালি কণ্যার বিদেশী ভার্সন, তবে চুলগুলো বহুদিন কাটো না মনে হয়, একদম এবড়ো থেবড়ো ভাবে বড় হয়েছে, ববি আন্টি তুমি ওকে কালই আমার পার্লারে পাঠিয়ে দিও তো, আমি ভালো একটা কাট দিয়ে রিবন্ডিং করে সোজা করে দিবো। ”
ত্রিশা আর কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। না পান্নাকে না ববিতাকে।
পান্না ওকে ছেড়ে দিতেই দ্রুত চলে গেলো দোতলায়, মায়ের কক্ষে।
সেখানে একান্তে সময় কাটাচ্ছিলো কনকচাপা আর জহির।
তার মধ্যেই ত্রিশা এসে রুমে ঢুকে গেলো। রুক্ষ স্বরে ডাকলো,
” মা, মা, এদিকে আসো মা, কথা আছে”
কনকচাপা এই অবস্থায় মেয়েকে দেখে বিব্রত হয়ে গেলো। সে কিছু বলার আগেই জহির অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলো।
” একদম বেয়াদব হইছে তোমার মেয়ে কনক, ওরে আদব কায়দা কিছুই শিখাও নাই তুমি। বাবা -মা একটু রেস্ট করছে আর সেখানে আসছে ডিস্টার্ব করতে, এক্কেবারে বেহায়া মেয়ে”
কনকচাপা একটু সামনে এগিয়ে আসতেই ত্রিশা চেঁচিয়ে বললো,
” আমাকে না জানিয়েই কোন সাহসে তুমি অটিস্টিক একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো আগে এটার জবাব দাও?”
কনকচাপা কিছু বলতেই যাবে ঠিক তখনি জহির এসে ত্রিশাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে পাশে ফেলে দিলো।
জহির গর্জে বলে উঠলো,
” তোর সাহস তো কম না, তুই আমার সামনে উঁচু গলায় কথা বলিস? এমন সম্বন্ধ তুই বাপের জন্মে পাবি? কত বড়লোক ছেলেটা, আর আমারিকার ফ্রি ভিসা পাবি তো, সেটা তোর পছন্দ হবে কেন? তুই নিজে যেমন ফকিন্নির জন্মা, তেমনি তোর পছন্দও ফকিন্নির মতো, ফকিন্নির ঘরের ফকিন্নি এখন এই বাড়ি থেকে বের করে দিলে তো ডাস্টবিনের খাবার খাবি…”
জহির আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখন কনকচাপা এসে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
” আহা! ছোটো মেয়ে আমার!”
বলে ত্রিশাকে তুলে উঠালো।
জহির আবার চেঁচিয়ে বললো,
” তোমার মেয়েকে বুঝাও কনক, ও এখনো আর ছোটো নেই, তোমার লাই পেয়ে ও বেশি আস্কারা পেয়ে গেছে। ওকে ভালো করে বুঝাও ও যেনো বিয়েতে রাজী হয়, শুধু ওরা এংগেইজ করে রাখবে, বিয়ে পরে হবে”
বলে জহির শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
উঁচু হাইহিল পড়ে থাকাতে জহিরের ধাক্কা খেয়ে ত্রিশার পা মচকে গেলো। কনকচাপা ধরে ধরে ওকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
অশ্রুজলে চোখের কাজল ভিজে ত্রিশার মুখ একাকার হয়ে গেলো।
কনকচাপা মেয়ের পায়ে মালিশ করতে করতে বলতে লাগলো,
” তুই চুপ থাক মা, কিছুই বলিস না, তবে তোর এ বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেবো না”
জীবনে এই প্রথম মা তার অভয় দিয়ে কিছু বলেছে। ত্রিশা এই ভেবে স্বান্তনা পেলো।
.
.
ত্রিশাকে পৌঁছে দিয়ে আহনাফের বাসায় যেতে রাত আটটা বেজে গেলো। তার আগে সে ভেজা শরীরেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছে গলির চা দোকানে বসে।
বাসায় ঢুকতেই মা তার কান টেনে ধরলো।
আহনাফের মা শায়লা আক্তার ও বাবা আশফিক আলী দুজনেই এলাকার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আশফিক আলী অবশ্য স্কুলের হেড টিচার। ওদের পরিবারের এলাকাতে বেশ সুনাম। হেড মাস্টার বলে সবাই তাকে ভীষণই সম্মান করে। আর আহনাফের মতো সুশিক্ষিত ও মেধাবী ছেলেকে সবাই সমীহ করে।
শায়লা কান ধরতেই আহনাফ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বললো,
” মা, ছাড়ো, লাগছে খুব! আমি কি এখনো প্রাথমিকে পড়ি যে, কান ধরো?”
শায়লা ছেড়ে দিয়েই প্রশ্ন করল,
“এত দেরি কেনো, সেটা বল? কই ছিলি? আর ফোন রিসিভ করিসনি কেনো সারাদিন?”
আহনাফ আধাভেজা শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
” আগে কাপড়টা ছাড়তে দাও তো মা, পরে বলছি?
শায়লা আহনাফকে লাঞ্চের জন্য দেওয়া টিফিন বাটি খুলতে খুলতে রেগেমেগে বললো,
” বৃষ্টিতে ভিজে গেছিস, সেদিকেউ তোর কোনো খেয়াল নেই, শার্ট ভিজে আবার শুকিয়েও গেছে, তাও বাসায় আসিসনি, টিফিন দিয়ে দিয়েছিলাম, দুপুরে খাওয়ার জন্য তাও খাসনি, কল দিয়ে পাওয়া যায় না তোকে, তোকে নিয়ে আমি আর পারছি না, বৃষ্টি হয়েছে বলে আজ আটটায় আসলি আর বৃষ্টি না হলে তো দশটা বাজিয়ে দিস..”
শায়লা আরো কিছু বলতে যাবে তখনি আহনাফ মা’কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
” এক টানে এত কথা বলো কিভাবে মা? একটু থামো, বিশ্রাম দাও নিজেকে!”
শায়লা একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্ঠা করলো।
আহনাফ শান্ত স্বরে বললো,
” মা, তোমরা আমাকে বলেছো, পড়াশুনা করে ঢাবিতে ভর্তি হও, হলাম, ঢাবিতে গণিতের মতো কাঠখোট্টা সাবজেক্ট পেলাম, তারপরো পড়লাম, তারপর বললে ক্যাডার হও, নিজের অতি আদরের রাজনীতি ছেড়ে একবারেই ক্যাডার হলাম, সরকারি চাকরী নিলাম, আর এখন একটু বন্ধুদের সাথে ঘুরছি, তাতেও তোমাদের বাঁধা?”
শায়লাকে বিচলিত দেখালো, সে বললো,
” এখন তোমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার বয়স নয়, বিয়ে করে বউ ঘরে আনার বয়স”
আহনাফ মায়ের কথাকে সমর্থন জানিয়ে বললো,
” কিন্তু, আমি কিছুদিন সময় চাই মা”
শায়লা বেজার মুখে বললো,
” তোর বাবার হার্টে পঁচিশ পার্সেন্ট ব্লক। বাইপাস করা হয়েছে দুবার, আর বাঁচবেই বা কতোদিন? একটা মাত্র ছেলে তুই, একটা বউ দেখার বড়ই সাধ তার, তার সে সাধ টা পূরণ করে মরতে দে অন্তত:”
আহনাফ কিছু বলতেই যাবে ঠিক তখনি ওর একমাত্র ছোটো বোন অহনা এসে বললো,
” কি আর বিয়ে করবে মা? প্রেম করেই কূল কিনারা পাচ্ছে না!”
আহনাফ বোনের কথায় রেগে গিয়ে বললো,
” কি বলিস সব আবোল তাবোল? ”
অহনা হেসে হেসে বললো,
” আবোল তাবোল বলিনা মা, একদমই না, প্রমাণ ছাড়া আমি কিছুই বলি না, গতকাল যে পাঞ্জাবি পড়ে গেলি, আসলি আরেক পাঞ্জাবি পড়ে আর সেই পাঞ্জাবিতে লিপস্টিকের দাগ আর একটা কোঁকড়ানো চুল পাওয়া গেলো, আর আজ আবারও সেই রকমই একটা কোঁকড়ানো চুল চুল শার্টের বোতামে লেগে আছে, সেটা কি কেউ খেয়াল করেছে?”
আহনাফ এ কথা শুনে অহনার একটা চুলের বেনী টেনে ধরে বললো,
” এত গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না শার্লক হোমসের ভাতিজী, মিসির আলীর নানী জনাবা অহনা”
অহনা কান্নারত স্বরে বলে উঠলো,
” ভাইয়া চুল ছাড়ো, মা বাঁচাও আমাকে, ভাইয়াকে মারো”
আহনাফ বোনকে কানে কানে বললো,
” আর যেনো ভুলেও গোয়েন্দাগিরি করিস, তাহলে চুল কেটেই দেবো আর ব্যোমকেশ বক্সির লগে তোর বিয়ে দিয়ে দেবো”
আহনাফ ছেড়ে দিলে অহনা দৌড়ে পালালো।
আহনাফ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে, সত্যি সত্যিই ত্রিশার মাথা একটা লম্বা, কোঁকড়া চুল ওর সাদা শার্টের বোতামের সাথে লেগে আছে। আহনাফ অতি যত্নে চুলটায় হাত বুলিয়ে সেটা একটা কাগজে মুডে ড্রঅয়ারে রেখে দিলো।
ওদিকে শায়লা দু ভাই বোনের এই ধরনের খুঁনসুটি দেখে দেখে ঝালাপালা হয়ে গেছে। তাই এসব দেখা বাদ দিয়ে এবার সে গেলো আহনাফের জন্য খাবার বাড়তে।
” ছেলেটা তার একদমই শুকিয়ে গিয়েছে। জিম করা পেটানো শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে”
এদিকে আহনাফ লকারে রাখা তার ফোনটা বের করে দেখলো প্রায় পাঁচশ টা মেসেজ করেছে কেউ তাকে। এত মেসেজে ফোনের ইনবক্স ফুল। আর ম্যাসেঞ্জারেও কয়েকটা আইডি থেকে অসংখ্য মেসেজ।
আহনাফ ভাবলো, ” এই ডিস্টার্বিং পারসন টাকে এবার দেখে নিতেই হবে। এর ডিস্টার্ব এর জন্যই ফোন বাড়িতে রেখে যেতে হয় প্রতিদিন”
মেসেজ পড়ে আহনাফের বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে, এই আইডি ওকে সারাদিনই ফলো করে, কোথায় যায় কি করে সবই এর জানা। আশ্চর্য! এ এটাও জানে যে, ত্রিশাকে সে বাইকে করে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।
.
.
পরের দিন সকালে ত্রিশার আর কলেজে যাওয়া হলো না। পায়ের ব্যথায় সে সারারাত আর ঘুমাতে পারেনি। আর বৃষ্টিতে ভেজার কারনে জ্বর এসে গিয়েছিলো শরীরে।
আহনাফ গোটা ম্যাথ ক্লাশ জুড়ে ত্রিশাকে ফিল করেছে। একটা মেয়ে একদম শেষ বেঞ্চিতে বসে মাথাটা নিচু করে গোটা ক্লাশ জুড়েই মনোযোগ দিয়ে অংক কষে।
সেই একটা মনোহরীনি মেয়ের জন্য আজ গোটা ক্লাশ টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
(চলবে)