প্রেমসুধা #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ২২

0
87

#প্রেমসুধা
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২২

বাড়ী ফিরতে আজ ভালোই দেড়ী হলো তৌসিফের। মাঝখানে খাবারের ব্রেকে কল দিলো তার একমাত্র বউকে। হায় আফসোস! এই বউটা যদি কল ধরতো তাহলে অন্তত তৌসিফ একটু শান্তি পেতো।কিন্তু ঐ যে ওর ভল্লুকী বউ, সে হলো মহা ত্যাড়া। নিশ্চিত সকালের ঘটনা কেন্দ্র করে তৌসিফের কল ধরে নি। বাচ্চাদের জন্য যেমন চিপ্স, চকলেট নিয়ে বাড়ী ফেরে মানুষ তৌসিফ ও আজ বাড়ী ফিরলো হাতে চাট্ঠা পাট্ঠা নিয়ে। বউ এগুলো দেখলেই খুশি হবে। কলিং বেলটা বাজতেই আজ সোহা খুললো। ওকে দেখা মাত্র ই ভীষণ বিরক্ত বোধ করলো তৌসিফ। এতদিন তো বউটা দরজা খুলতো। খুলেই মুখ ঝামটা মা’রতো। আজও তৌসিফ প্রস্তুত ছিলো যা সোহা’কে দেখে ভেঙে গেলো। মুখে তা প্রকাশ না করে সাইড কেটে ভেতরে ঢুকলো তৌসিফ। এদিক ওদিক তাকালেও দেখা মিললো না ওর বউ এর। টিভিতেও ড্রামা চলছে যা পৌষ দেখে না তা জানে তৌসিফ। রাত ও হয়েছে তাহলে কি বউটা ঘুমিয়ে গেলো? ভেবে তৌসিফ রুমে চলে গেলো। পেছন থেকে ডাক দিলো সোহা,

— কথা ছিলো।

— নট নাও।

পেছনে ফেরার প্রয়োজনীয়তা বোঁধ করলো না তৌসিফ। গটগট পায়ে রুমে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো অন্ধকার রুম। কেমন গুমোট লাগছে। তৌসিফের যেন দম বন্ধ লাগলো হঠাৎ। দরজা, জানালা সব বন্ধ করে রেখেছে। এসি তো দূর ফ্যানটাও বন্ধ করা। গলার বাটন খুলতে খুলতে তৌসিফ ডাকলো,

— পৌষরাত? মাই হানি, ক্যান আই হ্যাব জুস?

না, এত আদুরে ডাকের উত্তর এলো না৷ ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে লাইন অন করলো তৌসিফ। চমকালো হঠাৎ। সকালে যেভাবে কাঁথা নিয়ে শুয়ে ছিলো ঠিক সেভাবেই পৌষ ঘুমাচ্ছে। অবস্থান বদলালেও বদলায় নি ভঙ্গি। একদম পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। তৌসিফ বুঝলো না কিন্তু ওর ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো হুট করে। তারাতাড়ি পৌষ’র পাশে বসেই কাঁথার উপর হাত দিয়ে ডাকলো,

— পৌষরাত?

উত্তর এলো না। তৌসিফ ভালোই বিচলিত হচ্ছে। তার মন মানছে না। টেনে পৌষ’র মাথা থেকে কাঁথা সরাতেই দেখা মিললো মূর্ছে যাওয়া এক খানা মুখ। তৌসিফ জানে না ওর হলো কিন্তু শুধু এটা মনে হলো ওর অস্থির লাগছে। মাত্রারিক্ত বুকটা ওঠানামা করছে। পৌষ’র গালে হাত দিলেই আরেক দফা চমকালো। অসম্ভব গরম। একে একে কপালে, গলায় হাত ছোঁয়ালো। জ্বরে গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। আতঙ্কিত হলো তৌসিফ মুহুর্তেই। ঝট করে কাঁথা সম্পূর্ণ টা সরালো। চিৎকার করে ডাকলো,

— বুয়া! বুয়া!

ডেকেই পৌষ’কে নিজের বুকে টেনে নিলো। জ্ঞান নেই পৌষ’র। তৌসিফের মনে হচ্ছে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। এই বুকের মধ্যে থাকা পাখিটা তো চুপ থাকার নয়, সে এক চঞ্চল প্রাণ। সে তো বোবা পাখি নয় সে হচ্ছে তৌসিফের তোতা পাখি। তোতাপাখিটা চুপ করে পরে আছে তৌসিফের বুকে। ঢোক গিললো তৌসিফ। পৌষ’কে আরেকটু বুকে চেপে ধরলো। তখনই বুয়া দরজা খুলে ঢুকলো। পেছনে সোহা আর মিনু ও এসে দাঁড়িয়েছে। বুয়া মামা বলে ডাক দিতেই তৌসিফ ধমকে উঠলো,

— ও ও কখন থেকে এখানে পরে আছে? কেউ কেন দেখো নি? বলি নি ওকে দেখে রাখতে? টাকা দিয়ে কেন রেখেছি যদি একটা মানুষের ই খেয়াল রাখতে না পারো!

বুয়া সহ পেছনে থাকা মিনু ভয় পেয়ে গেলেও সোহা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

— সারাক্ষণ লাফালাফি করে। শান্ত ছিলো ভালো কথা।

আর কিছু বলার আগেই তৌসিফ হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

— একটা কথা বললে বাড়ী ছাড়া করব আমি।

আচমকা কথাতে সোহা চুপ হয়ে গেলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। মিনু তখনও দাঁড়িয়ে। তৌসিফ বুয়াকে অস্থির গলায় বললো,

— ডক্টর ফোন করো। এখনই আসতে বলো।

বুয়া ছুটে গেলো। তৌসিফ পৌষ’র গালে আলতো চাপড় মা’রলো। অস্থির অথচ চঞ্চল গলায় ডাকতে লাগলো,

— হানি? হানি প্লিজ ওপেন ইউর আইস। এই পৌষরাত, তাকাও না। কি হয়েছে তোমার? আমার তোতাপাখি টা কেন কথা বলছে না? পৌষরাত? দয়াকরে তাকাও না। আমাকে বকো। একটুও রাগ করব না। প্লিজ পৌষরাত। একবার তাকাও।

পৌষ তাকালো না। তৌসিফ আরেকটু বুকের গভীরে নিলো ওকে। পৌষ’র মুখটা ঠেকলো ওর গলাতে। উষ্ণতা অনুভব করলো তৌসিফ। গলদেশ টা যেন পুড়ে যাচ্ছে। না জানি কখন থেকে এভাবে পরে আছে। বুয়া দৌড়ে এসে বললো,

— ডাক্তার আসছে মামা।

— পানি আনো বুয়া। ওর মাথা অনেক গরম।

বুয়া যাওয়ার আগেই মিনু দৌড়ে গেলো। তৌসিফ রুমাল ভিজিয়ে ধরলো পৌষ’র কপালে। একবারের জন্য ও বুক থেকে সরালো না। ডক্টর আসতেই তৌসিফ বললো,

— সকাল থেকে শুয়ে আছে। জলদি দেখুন।

ডক্টর চেক করার জন্য বললো,

— বালিশে শুয়িয়ে দিন স্যার।

— কি? না না৷ আমার কাছেই থাকবে। এভাবেই চেক করুন।

এক পলকের জন্য বুক থেকে সরালো না তৌসিফ। ডক্টর চেক করে মেডিসিন দিয়ে তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বললো,

— একটু ফ্রেশ করিয়ে দিন। জ্বর নেমে যাবে এখনই। মাথায় পানি দিয়ে পারলে গোসল করান। খায়িয়ে বাকি মেডিসিন গুলো দিন। সকাল সকাল একদম ফিট হয়ে যাবে।

— টেস্ট করা উচিত আই থিংক।

— প্রয়োজন দেখছি না৷

— স্টিল। আই নিড টু নো।

— ইয়াহ্। শিওর। আম টুমরো এট ক্লিনিক।

— হুম।

ডক্টর বিদায় নিতেই বুয়া মেডিসিন আনাতে গেলো। তৌসিফ আস্তে ধীরে ডাকলো,

— পৌষরাত? হানি, একটু উঠতে হবে।

ওকে ধরেই তৌসিফ নিলো ওয়াশরুমে। ইনজেকশন দেয়াতেই ঘেমে উঠেছে একদম। তৌসিফ সোজা হুমকি দিয়েছে এখনই বৌ’কে জ্বর ছাড়াতে হবে। ডক্টর না চাইতে ও ইনজেকশন টা পুশ করেছেন। ওয়াশরুমে কোলে করে ওকে নিলো তৌসিফ। সাইডে বসিয়ে শুরুতেই বেসিনে নিয়ে মাথায় পানি দিলো। পরণে থাকা জামাটা অতি স্বাভাবিক ভাবে খুলে একদম শাওয়ারের নিচে নিলো ওকে। ঠান্ডা পানিতে লাফিয়ে উঠতে চাইলো পৌষ লাভ অবশ্য হলো না৷ তৌসিফের বাহু থেকে ছাড়া পেলো না। একদম শাওয়ার করিয়ে ওকে ছাড়লো তৌসিফ। মাথায় একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে আরেকটা প্যাঁচালো গায়ে। বাকিটা সাহায্য করতে নিলেই অনেকটা দূর্বল কণ্ঠে পৌষ বলে উঠলো,

— পারব।

— আমি করছি।

— প্লিজ। পারব। কাপড় দিন।

তৌসিফ বের হয়ে একটা গোল ওয়ান পিস নিলো সাথে শর্ট প্যান্ট। পৌষ’কে না দিয়ে নিজেই ওয়ান পিসটা ওকে পরিয়ে দিলো। পৌষ বাকিটা করতেই ওকে নিয়ে এসে খাটে বসিয়ে নিজে তারাহুরো করে ফ্রেশ হয়ে এলো তৌসিফ। এই প্রথম! জীবনে এই প্রথম সে এত তারাতাড়ি শাওয়ার নিলো। কোন মতে মুখে একটু ফেইস ওয়াশ আর শরীরে জেল দিয়ে শাওয়ার কম্পিলিট করেছে। শুধু মাত্র পৌষ’র জন্য ই এই ত্যাগ। নাইট স্কিন কেয়ার তার করা হলো না।
পৌষ’র কাছে এসেই দেখলো ও বসে আছে। তৌসিফ ঝট করে ওর মাথা মুছে দিলো। হাতের টাওয়ালটা ছুঁয়ে সাইডে ফেলেই পৌষ’র কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে থুতনিতে এক চুমু খেয়ে বললো,

— ভয় পেয়েছিলাম।

— ঘুমাব।

— উহু। আগে খাবে।

বুয়া ততক্ষণে খাবার নিয়ে এসেছে। তৌসিফ খাবার ওর মুখে তুলে দিতেই পৌষ বললো,

— বমি পাচ্ছে।

— করো।

— খাব না।

— ঔষধ আছে।

বলে জোর করে মুখে দিলো। তৌসিফ বুঝলো ও সত্যি ই খাবে না। কোন মতে চেপে ধরে একটা ডিম খায়িয়ে দুধটা খাওয়ালো। ঔষধ খায়িয়ে বালিশে শুয়িয়ে দিয়ে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিলো। পৌষ’র চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরতেই তৌসিফ চট করে মুছে দিলো। পৌষ’র একদম কাছে এসে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতেই কেঁদে উঠলো পৌষ। তৌসিফ সাথে সাথে আরেকটু বুকে চেপে নিলো। আদুরে গলায় বললো,

— হানি, একটু পরই সুস্থ হয়ে যাবে। ঝাল করে পাস্তা রান্না করব আমার তোতাপাখির জন্য। কথা বলো না পৌষরাত। আমার খারাপ লাগছে।

কাঁদতে কাঁদতে ই পৌষ ভাঙা গলায় বলে উঠলো,

— আমি অনেক কেঁদেছি। আমার শরীর অনেক ব্যথা করেছে। কোমড়ের ব্যথায় মনে হচ্ছিলো আমি ম’রে যাব। ম’রে গেলে ভালো হতো। আমার মা-বাবার কাছে চলে যেতাম। কেউ দেখে নি আমাকে। আমার কেউ নেই। পৌষ এতিম। পৌষ’কে কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। পৌষ কেন ম’রে যাচ্ছে না? আমি কত কাঁদলাম কেউ এলো না। কেউ না। আমি অনেক কেঁদেছি। চাচির বোন বলে আমার মুখ বেশি চলে তাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ না।

তৌসিফের বাম চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পরলো। জীবনে শেষ বার কবে পানি পরেছিলো? তৌসিফের মনে পরছে না। পরবেও না কারণ সে কাঁদে না। পৌষ’কে বুকে শক্ত করে রেখে শুধু বললো,

— ভালোবাসি হানি। আমি তোমাকে ভালেবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি আমার তোতাপাখি কে।

#চলবে…..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here