#আশিয়ানা
#পর্ব_৫
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
জোজোর মাথায় রোদেলা তার ডান হাতখানা রেখে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। নির্বিকার গলায় বলল, ‘ তোকে কী আমি খেতে দেই না? রুটির জন্য একজন লোকের লুঙ্গি ধরে টানলি কেন? লোকটা কেমন দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল, আমার ভয় লাগছে। ভাবছি, আমাকে যদি সামনে পায়, না জানি আবার গলা চেপে ধরবে কি না। সব তোর জন্য। মামির ভয়ে পালাচ্ছিলাম আর তুই রুটি ছিনতাই করতে চলে গেলি।’
রোদেলার কথাগুলো যেন জোজো বুঝতে পারছে। নিমিষে নিজেকে গুটিয়ে নিল সে, মানুষের মত নড়েচড়ে বসল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রোদেলার মুখপানে তাকাল। রোদেলা হুট করে রুদ্ধশ্বাস ফেলল। আব্দুল লতিফের বিশাল দিঘির ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল সে। হাঁটুতে থুতনি ভর দিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর হাতের বাটন ফোনটি হঠাৎ বেজে উঠল। রোদেলা কল রিসিভ করার পরপর ওপাশ থেকে উমাইয়া প্রফুল্ল গলায় বলল,
‘ রোদু, রোদু! গাজীপুর আসার জন্য প্রস্তুত হো। ভাওয়ালে তোর এডমিশন হয়েছে।’
বিস্ময়ে চমকে উঠল রোদেলা। মুখটা নিচু করে ফেলল। রোদেলার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলে মাখামাখি হল তার ফর্সা গাল। রোদেলা তার বাম হাতখানা ঠোঁট ছোঁয়াল। দূর্বল গলায় বলল,
‘ সত্যি? তুই ঠাট্টা করছিস না তো?’
উমাইয়া কানের সাথে ফোনটা চেপে ভীষণ আদুরে গলায় বলল,
‘ সত্য বলছি রোদু! দু-দিনের ভেতর ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাজীপুরের জন্য চলে আয়।’
রোদেলা বাড়ি এলো তখন প্রায় সন্ধ্যা নিকটে। সুলতানা তার ছেলে রাফসানকে পড়তে বসিয়েছেন। রাফসান সিক্সে উঠেছে। মাসুম বিল্লাহ ঘরের উল্টো দিকে বসে ব্যবসায়ীক হিসেব নিকেশে মশগুল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে রোদেলা। মাসুম বিল্লাহ’র ঠিক সামনে বসে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘ মামা, একটা কথা বলার ছিল।’
মাসুম কাগজপত্রে চোখ স্থির রেখে বললেন,
‘ বল মা, কী বলবি?’
‘ মামা, তুমি তো জানো গাজীপুর গিয়ে পড়াশোনা করা আমার স্বপ্ন। গাজীপুর ভাওয়াল কলেজ ভীষণ ভাল। আমার সেখানে এডমিশন হয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই।’
মাসুম হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ। খুবই আনন্দের খবর। কিন্তু তোকে আমি একা ওতোদূর কিভাবে পাঠাব? তোর মা মারা যাওয়ার সময় আমি কথা দিয়েছি, তোর সব সময় খেয়াল রাখব। গাজীপুর চলে গেলে, আমি তো তোকে রোজ দেখতেও পাব না। একা একটি মেয়ে বাড়ি থেকে দূরে থাকা কষ্টকর।’
রোদেলা হতাশ, অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ওখানে একা থাকব না মামা। উমাইয়া ওদের সাথে থাকব।’
মাসুম গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ উমাইয়া গাজীপুর কোথায় যেন থাকে?’
‘ শফিপুর মামা।’
‘ ওরা দুইজন ওখানে ব্যাচেলরের মত থাকে। তুই গেলে তিনজন পূর্ণ হবি। সবই তোদের প্ল্যান। ঠিক আছে, তোর খুশিতে আমি কখনো বাঁধা হবো না।’
কথাটি বলে মাসুম রোদেলার মাথায় তার হাতটি রাখলেন। তারপর বললেন, ‘ তোর মায়ের ইচ্ছে ছিল, তোর কোনো ইচ্ছে যেন অপূর্ণ না থাকে। আমি নিজে গিয়ে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব। আর সব সময় আমাকে কল দিয়ে খোঁজ খবর দিতে হবে।’
রোদেলা বলল,
‘ দিনে দশবার কল দিয়ে খোঁজ খবর দিব।’
সুলতানা খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠল। বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ মেয়ে মানুষের ঘরের বাইরে যাওয়ার কি প্রয়োজন? এই মেয়েকে যেহারে মাথায় চড়াচ্ছ, কোনদিন যেন তোমার উঁচু নাক ভুঁচা করে দেয়।’
মাসুম বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ আমার ভাগ্নীর ব্যাপারে তুমি কোনো কথা বলবা না। আমার অধীর বিশ্বাস রয়েছে রোদের উপর। আমার বিশ্বাস ওঁ একদিন অনেক বড় হবে। অনেক নাম কামাবে। লোকজন ওঁর নাম শুনেই ওঁকে চিনবে।’
সুলতানা মুখ বাঁকা করে ভেঙচিয়ে ছেলের হাত ধরে অন্য রুমে টেনে নিয়ে গেল। মাসুম সেদিকে লক্ষ্য করল না৷ রোদেলার উদ্দেশ্য বলল,
‘ নতুন জায়গায় যাবি। অনেক খরচাপাতি হবে। তোর একমাসের জন্য মোট কতটাকা প্রয়োজন, হিসাব করে আমাকে বলিস। আমি একটা এমাউন্ট আলাদা করে রাখব।’
______________
সোফায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছে সাদাফ। কিছুক্ষণ পর চ্যানেল চেঞ্জ করল, সময় টিভিতে লাইভ খবরটি দেখতে পেল সে। বিস্ময়ে অকস্মাৎ আপেলের টুকরো সাদাফের গলায় আঁটকে গেল। কয়েকবার কেশে গলা পরিস্কার করে নিল। তূর্ণর গাড়ি চতুর্দিকে লোকজন ভির করে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির মধ্যে দুইহাতে মুখমণ্ডল ঢেকে বসে আছে তূর্ণ। প্রতিটা টিভি চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, ‘ এআই ব্যান্ড এর সিঙ্গার মাহাবুব তূর্ণ বাংলাদেশে এসে ছদ্মবেশে শপিংমল ঘুরছেন। এভাবে লুকিয়ে দেশে আসার পিছনে কারণ কী?’ সাদাফ হম্বিতম্বি করে তার ফোনটা হাতে নিল, কল করল সেহরিশের ফোনে। ফোন চার্জে বসিয়ে মায়ের রুমে বসে গল্প করছে সেহরিশ। মিনিট পাঁচেক পর প্যান্টের পকেটে বাম হাতটি গুঁজে রুমে আসলো সে। খাটের উপর বসার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা আবারও বেজে উঠল। আয়েসি ভঙ্গিতে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে শুয়ে পরল তারপর কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে সাদাফ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
‘ কোথায় তুই? নিউজ দেখেছিস? টিভি অন কর।’
‘ নিউজে কী দেখব?’
‘ তূর্ণ কে দেখবি।’
সেহরিশ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ হোয়াট?’
নিউজ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল সেহরিশ। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলল,
‘ স্টুপিট। তুই ওঁকে একা বাহিরে যেতে দিয়েছিস কেন?’
সাদাফ কী ভেবে বলল,
‘ আমাকে রুমে লক করে গিয়েছে। ফারেন দরজা খুলে দিয়েছে আমার। তুই জলদি আয়।’
সেহরিশ কড়া গলায় বলল,
‘ বোকার মত কথা বলছিস কেন? আমি সিরাজগঞ্জ থেকে শফিপুর জলদি কিভাবে যাব?’
সেহরিশ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘ এই ছেলেকে নিয়ে কী করব? আমি আসছি। তুই দেখ ওঁকে ওখান থেকে বের করতে পারিস কি না।’
চারিদিক থেকে মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচির গাড়ির হর্ণ শব্দ কানে বাজছে। মানুষের ভিড়, তাদের ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি তে গাড়ি হেলছেদলছে। শপিংমলের সামনে তুমুল ভিড়। সাধারণ মানুষের সামনে গিজগিজ করছে একদোল সাংবাদিক। চারিদিকে জ্বলজ্বল করছে ক্যামেরা ও স্মার্ট ফোনের টর্চ। সমস্ত ক্যামেরার ফোকাসড তূর্ণর গাড়ির উপর। শত শত ভক্তরা গাড়ির গ্লাসের ছবি তুলতে ব্যস্ত। তারা পারছে না, জানালার গ্লাস ভেঙে তূর্ণ কে গাড়ি থেকে নামাতে। তূর্ণ নিথর হয়ে বসে আছে। এসব নিজ চোখে দেখে তার মাথা ধরে এলো। এত এত শহরে গিয়েছে এমন ভক্ত তার চোখে পরেনি। ভয়ঙ্কর আতঙ্ক বুকে নিয়ে সিটের সঙ্গে মিশে রইল।
বডিগার্ড স্টিফেন তূর্ণর পিছন পিছন ঘুরছিল। মলে এসে সাধারণ মানুষের মত ঘোরাঘুরি করবে বলে স্টিফেনকে মলের রেস্টরুমে বসিয়ে সে খুশিমনে ঘুরতে লাগল। মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ থাকার পরও একজন ভক্ত তূর্ণকে চিনতে পারে। এবং সে সবার মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠে। মলের ভেতর অধিকাংশ মানুষ ছিল এআই ব্যান্ডের ফ্যান। মেয়েটির কথা শুনে তারা তূর্ণর দিকে লক্ষ্য করে। এবং হাতের জিনিসপত্র ফেলে তূর্ণর দিকে এগিয়ে আসে। তূর্ণ আঁতকে উঠে পিছন দিকে দৌঁড় লাগাল। কোনোক্রমে শপিংমল থেকে বেরিয়ে পার্কিং প্লেসে ছুটে এসে গাড়িতে উঠে বসে ডোর লক করে দেয়। তূর্ণর পিছু নিয়ে ফ্যানরাও পার্কিং প্লেসে এসে জায়গা ভরাট করে ফেলল। তূর্ণ নিজে ড্রাইভিং জানে না, ড্রাইভিং করে এখানে নিয়ে এসেছিল স্টেফিন। আর সে তাকেই রেস্টরুমে বসিয়ে আসছে। তূর্ণ রাগে, ক্ষোভে স্টিয়ারিংয়ে কয়েকটা গুষি মারল। নিমিষে চারদিকে লোকজন ভরে গেল। মিডিয়ার লোকও খবর পেয়ে এসে গেছে। এবং বর্তমানে ব্রেকিং নিউজে রয়েছে তূর্ণ। সেহরিশ তার গলা চিপে মেরেই ফেলবে। ফোনের ব্যাটারি লো, সেহরিশ, সাদাফকে কল দিতে নিয়ে ফোনটি বন্ধ হয়ে গেল। তূর্ণর রাগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। হঠাৎই এই ভিড়ের ভেতর এক কণ্ঠস্বর তূর্ণর কানে গিয়ে লাগল। গাড়ির দরজায় দাঁড়ানো একজন মানবী মৃদু গলায় বলল,
‘ লক খুলুন, জলদি।’
তূর্ণ জানে না, সে কেন দরজা খুলে দিল। মানবী ড্রাইভিং সিটে বসতে নিয়ে তূর্ণকে পাশের ফ্রন্ট সিটে গিয়ে বসতে ইশারা করল। তূর্ণর মতো লম্বা বলিষ্ঠ দেহের পুরুষের গাড়ির ভেতর বসে এক সিট থেকে অন্য সিটে যাওয়া কষ্টদায়ক। তূর্ণ নতজানু হয়ে বসে রইল। মানবী কোনো কিছুর পরোয়া না করে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ির সামনে থেকে মানুষ গুলো সরে যেতে লাগল। এক নিমিষে ভিড়ের ভেতর থেকে তূর্ণকে বের করে নিয়ে আসলো সে। তূর্ণ উঠে সোজা হয়ে বসল। পিছনের সিট থেকে পানির বোতল নিয়ে শুকনো গলা খানি ভিজিয়ে নিল। এতক্ষণে সে মানবীকে খেয়াল করল। রাস্তার সাইডে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলো খানিক বাদে বাদে গাড়ির জানালা ভেদ করে মানবীর অভিমুখে উপচে পরছে। ফর্সা মুখ, পাতলা ঠোঁট, খাঁড়া নাকের মেয়েটির উপর দৃষ্টি স্থির রেখে গোপনে মৃদু হাসল তূর্ণ। ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ আপনি কে? আপনি যেভাবে আমাকে বাঁচালেন, কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব।’
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
‘ আমার নাম জুবিয়া।’ কপালে ভাজ ফেলে জানালার বাহিরে উঁকি দিল সে। তারপর ব্যস্ত গলায় বলল,
‘ কেউ পিছু নেয়নি। আপনি এখন সেফলি বাড়ি যেতে পারবেন।’
তূর্ণ বলল,
‘ আমি ড্রাইভ করতে জানি না। আপনি যদি কষ্ট করে আমার ফ্ল্যাট পর্যন্ত যান। তাহলে অনেক উপকার হবে।’
জুবিয়া কথা বাড়াল না। একবার শুধু তার থেকে এড্রেস জেনে নিল। বিশাল বাড়ির সামনে এসে জুবিয়া দরজা খুললো। নামবে। সেসময় আগে তূর্ণ বলল,
‘ আপনি আমার উপকার করেছেন। আমারও আপনার জন্য কিছু করা প্রয়োজন। আপনার সাথে পরে যোগাযোগ করতে পারব, এমন কোনো নাম্বার যদি থাকে তাহলে…’
তূর্ণ সম্পূর্ণ কথা গুছিয়ে বলতে পারল না। তার পূর্বে জুবিয়া তার পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে তূর্ণর হাতে ধরিয়ে দিল। তাড়া দিয়ে বলল,
‘ চিকেন শপ। আমি সেখানে পার্টটাইমার। আমার নাম বললেই সবাই দেখিয়ে দিবে।’
তূর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ চিকেন শপ?’
চলবে….