#আশিয়ানা
#পর্ব_৮
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
‘ ভার্সিটির আজ প্রথম দিন। তুই শাড়ি পরে যাবি?’
‘ কেন? শাড়িতে কী সমস্যা?’
জুবিয়া বিরক্তিকর দৃষ্টিতে রোদেলার উপর কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর গায়ের টি-শার্ট টা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে বিছানা ছেড়ে উঠে রোদেলার সামনে এসে দাঁড়াল। জুবিয়া হালকা আকাশী রঙের টি-শার্ট ও কালো রঙের স্কার্ট পরে আছে, গলায় ঝুলছে ফিনফিনে জর্জেটের ওড়না। চুলগুলো বাঁধার জন্য চুলের কাঠির সঙ্গে চুলগুলো পেঁচিয়ে গেঁথে ফেলল। জুবিয়া রোদেলার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ পাঁচ মিনিট সময় শাড়ি চেঞ্জ করে আয়।’
রোদেলা মৃদু গলায় বলল,
‘ কোন কামিজ পড়ব?’
জুবিয়া বলল,
‘ শাড়ি আর কামিজ ছাড়া জীবনে পরছিস কী? গতমাসে আমি কয়েকটা নতুন টপস কিনেছিলাম। তুই অপেক্ষা কর, ওগুলোর মধ্যে তোর যেটা পছন্দ হবে। সেটাই আজ পরবি।’
জুবিয়া আলমারি থেকে বেশ কয়েকটি টপস নিয়ে এলো। বিছানার উপর রেখে রোদেলাকে সেগুলো থেকে পছন্দ করতে বলে পাশে দাঁড়াল। রোদেলা ভ্রু উঁচু করে কাপড়গুলো দেখে শুকনো গলায় বলল,
‘ এইসব ড্রেস আমি পরতে পারব না। কী রকম দেখতে? ছিহ, এই পোশাক পরে বাহিরে বের হলে রাস্তায় লোক আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে। এর চেয়ে ভাল, আমি কামিজ পরেই যাব।’
জুবিয়া গজগজ করে বলল,
‘ তুই এখনো গ্রাম্যই রয়ে গেলি। যা ইচ্ছে কর। তোর পোশাক, তোর চয়েজ। ভার্সিটির ভেতর কেউ যদি তোর কথা জিজ্ঞেস করে, আমি তো বাবা বলে দিব, তোকে আমি চিনি না। বড় আপা সেজে ভার্সিটি যাবি, সিনিয়ররা প্রচুর হাসবে মজা নিবে।’
রোদেলার মাথায় এলো না, পোশাকের সাথে হাসিঠাট্টার কী আছে? শরীরের সাথে ল্যাপ্টে থাকা পোশাক বা শরীরের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখা যায় এমন পোশাক পরিধান করা তার পছন্দ নয়। সেখানে লোক কী জন্য হাসবে? লোকের জন্য কেনো তাকে নিজের পছন্দ পরিবর্তন করতে হবে? রোদেলা তার জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। জুবিয়া রুম ফাঁকা পেয়ে রেডি হয়ে তাত্ক্ষণিক রেডি হয়ে যায়।
রোদেলা চকিতে তাকিয়ে নির্মূল কণ্ঠে বলল,
‘ উমাইয়া কোথায়? ওঁকে সকাল থেকে দেখছি না।’
জুবিয়া জুতা পরা শুরু করেছে। একপলক রোদেলার অভিমুখে তাকাল। তারপর শানিতকণ্ঠে বলল,
‘ উমাইয়া সপ্তাহে চারদিন কাজ করে। সন্ধ্যার পর ফিরে আসবে। আমিও আজ নতুন জব খোঁজার জন্য যেতাম। শুধু তোর জন্য ভার্সিটি মুখো হবো।’
রোদেলা অবাক জিজ্ঞেস করল,
‘ কেনো? আমার জন্য কেনো?’
রুমের দরজায় তালা লাগাচ্ছে জুবিয়া। রোদেলার বোকাবোকা প্রশ্নে সে খানিক নির্বাক চেয়ে রইল। ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
‘ তুই এখানে নতুন। একা ভার্সিটি যেতে পারবি? চিনবি তুই?’
রোদেলা ডানেবামে মাথা নাড়লো। বলল,
‘ একা? যদি হারিয়ে যাই?’
জুবিয়া বলল,
‘ এজন্যই আমি তোর সাথে যাচ্ছি। যেন তোকে সব চিনিয়ে দিতে পারি। যদিও তুই যে বোকা একদিনে চিনবি বলে মনে হচ্ছে না।’
দুই তলার সিঁড়ি ভেঙে নিচ তলায় নামলো। দারওয়ান মাবুর চাচা ওদের আসতে দেখে কেঁচি গেইট খুলে দিলেন। রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে ডানে-বামে তাকাল জুবিয়া। একটা খালি রিক্সা আসছে দেখে জুবিয়া রিক্সাওয়ালাকে ডাকল।
বলল, ‘ মামা, বাজার পর্যন্ত যাবেন?’
‘ হো, যামু। ওঠেন।’
জুবিয়া রিক্সায় উঠে বসল। একহাতে রিকশার হুট টেনে নামিয়ে দিল। রোদেলা রিক্সায় উঠতে যাবে তখনই তার মনে পড়ল জোজোর কথা। তারপর উচ্চকিত গলায় বলল,
‘ জুবি, তুই ঘরের চাবিটা একটু দে আমায়। জোজোকে খাবার দেওয়ার কথা ভুলে গেছি।’
জুবিয়া নিষেধ করে। এইটুকু সময়ের জন্য যেতে হবে না। বলার পরেও চাবি নিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌঁড়ে গেল সে। রিক্সাওয়ালা বার দুয়েক জুবিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল। জুবিয়া ক্ষীণ সুরে বলল, ‘ এক্ষুণি চলে আসবে। পাঁচ মিনিট।’
___________
শহর থেকে গাড়ি গ্রামের সীমানাতে ঢুকতে রাস্তার দুধারে সারি সারি আম, জাম, কাঠাল, লিচু, নারিকেল, সুপারি গাছ উঁকি মারে আকাশে। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি গাছের এমন দৃশ্য চোখে পড়ল সাদাফের। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে সিটের উপর রাখে সে।
জানালার গ্লাস নামিয়ে নিমগ্ন হয়ে প্রকৃতিতে ডুব দিল। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবির মতন গ্রামের দৃশ্যগুলো দেখতে লাগল সাদাফ। হাজারো প্রকৃতির ফুল গ্রামের আনাচে-কানাচে, ঝোপে-ঝাড়ে শোভাবর্ধন করে রয়েছে, আপন মহিমায় অসংখ্য প্রজাতির গাছ আর লতাপাতা। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় হাজারের কাছাকাছি প্রজাতির পাখি। দূর কোথা থেকে অনবরত কানে বাজছে পাখির কিচির-মিচিরের শব্দ।
হঠাৎই গাড়ির ব্রেক কষলো ওমান। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক কৃষক। তাকে দেখেই গাড়ি থামিয়েছে ওমান। গাড়ির দরজা খুলে সে দ্রুত বের হলো, ওমানের ইংলিশে বলা কথাগুলো কৃষক লোকটা বুঝতে পারছিলেন না। ওমান লোকটাকে সাদাফের সামনে নিয়ে আসলো।
সাদাফের সঙ্গে কথা বলার পর তিনি জানতে পারলেন, ওনারা শহর থেকে এসেছে ভালো নার্সারির খোঁজে। এরপূর্বে দুটো জায়গায় গিয়েছে সেখানে ভালো ফুলগাছ পায়নি। কৃষক বৃদ্ধ লোকটা শাহাদাত আঙুল দিয়ে দুটো রাস্তার মধ্যে ভেদাভেদ করে বললেন,
‘ ডান দিকের রাস্তা ধরে সোজা যাইবা, বাবা। কিছুদূর গেলেই মুজিব মিয়ার নার্সারি দেখতে পাইবা। অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ আছে ভাইয়ের বাগানে।’
নার্সারির সামনে এসে গাড়ি থামাল ওমান। শরীর জুড়ে কালো পোশাক, চোখে কালো রঙের সানগ্লাস বলিষ্ঠ দেহ, যার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে সাদাফ। গাড়ির শব্দ শুনে রাস্তায় এলেন মুজিব মিয়া। ওমান ইংলিশে কথা বলতে লাগল তার সাথে। মুজিব মিয়া মূর্খ মানুষ, ওনার সে আমলে পড়াশোনা করার তেমন সুযোগ পাননি তিনি। ইংরেজি বুঝা তার জন্য অসম্ভব। সখ ও অবিজ্ঞতা থেকে তিনি বিশাল জায়গা জুড়ে নার্সারি বানিয়েছেন। আল্লাহর রহমত রয়েছে তাইতো তিনি সফলতা অর্জন করেছেন। মুজিব মিয়া ওমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ তুমি একটু খাঁড়াও বাবা। আমার এইহানে একটা মাইয়া কাম করে৷ ওয় খুব ভালা ইংরেজি জানে। আমি ওরে ডাইকা নিয়া আইতাছি।’
সাদাফ গাড়ি থেকে নামলো। মৃদু গলায় বলল,
‘ কাউকে ডাকতে হবে না চাচা। আমি বাংলা জানি।’
সাদাফ একা। নার্সারির একপাশ থেকে ঘোরা শুরু করে। যে গাছ পছন্দ হবে সেগুলোই তূর্ণর বাড়ির জন্য নিয়ে যাবে। গ্রামের সাধারণ মানুষ অনেকেরই সাদাফকে চেনার কথা না। তারা সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করে। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে সেসবে তাদের জানা নেই। চিনতে না পারার কারণে অবশ্য সাদাফ কিছু মনে করেনি। নিঃসংকোচে গাছ বাছাই করতে লাগল। নার্সারির ঠিক মাঝখানে গোলাপের চারাগাছ, কচুপাতা রঙের গোলজামা পরিহিত একজন মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা গাছগুলোর ডাল ও পাতা কেটে ছাঁটাই করছে। সাদাফ দুইহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে পিছনে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক বাদে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
‘ আপনি এটা কী করছেন?’
উমাইয়া ঘুরে তাকাল। অপরিচিত একজন পুরুষকে দাঁড়ানো দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বিব্রতবোধ কাটিয়ে উঠে বলল,
‘ গাছের মরা পাতা ও নতুন ডাল-পাতা ছাঁটাই করছি।’
সাদাফ কৌতূহল মেটাতে শুধাল,
‘ কেনো? ছাঁটাই করে লাভ কী?’
উমাইয়া গাছগুলো হাতের ইশারায় সাদাফকে দেখালো। তারপর বলল,
‘ গাছের সুস্বাস্থ্যের জন্য কয়েকমাস পরপর ছাঁটাই করা প্রয়োজন। কয়েকটা ডাল কেটে ফেলার পর সেই জায়গায় নতুন ডাল গজায়। এবং ছাঁটাই করার ফলে গাছে ফুলও সুন্দর ফোটে।’
সাদাফ প্রসন্ন গলায় বলল,
‘ আপনি গাছপালা নিয়ে খুব সচেতন দেখছি। গাছপালা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন।’
উমাইয়া গাছের গুঁড়িতে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
‘ মোটামুটি ধারণা আছে। বাকিটা পেয়েছি মুজিব চাচার থেকে৷ তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন গাছের যত্ন নেওয়ার কৌশল।’
সাদাফ এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
‘ আপনাদের নার্সারি আমি ঘুরে দেখছিলাম। খুবই সুন্দর পরিবেশ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।’
উমাইয়া এক নজর তাকিয়ে সাদাফকে দেখল। ক্ষীণ গলায় বলল,
‘ আপনি নিশ্চয় গাছ কিনতে আসছেন? কী গাছ নিতে চান?’
সাদাফ শালিন কণ্ঠে বলল,
‘ ড্রয়িংরুম ও ব্যালকণি সাজানোর জন্য যেসব গাছ উপযোগী।’
উমাইয়া সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে বলল,
‘ এইদিকে চলুন। আপনার প্রয়োজনীয় সব গাছ ওইদিকে পাবেন।’
এত বড় নার্সারিতে কোনদিকের সরু পথ দিয়ে এসেছিল বেমালুম ভুলে গিয়েছে সাদাফ। অসহায় দৃষ্টিতে উমাইয়ার দিকে তাকাল। উমাইয়া আকর্ণ হেসে বলল,
‘ সমস্যা নেই। আমি আপনাকে বাহিরের পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। চলুন।’
সাদাফ হালকা হেসে বলল,
‘ ধন্যবাদ।’
সাদাফ উমাইয়ার পিছু পিছু হাঁটছে। উমাইয়া ভীষণ কথা বলে। কথা বলতে যেন জিরোয় না সে। তার এই স্বভাবটাই সাদাফের ভালো লাগল। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো সে।
উমাইয়া বলল,
‘ চলাচল করার সময় দুই ধারে লক্ষ্য রাখা উচিৎ। তাতে খুব সহজেই মনে রাখা যায় আমরা কোন পথ দিয়ে এসেছিলাম। প্রথম যেদিন আমি এখানে জব নেই। সেদিন আমিও হারিয়ে যাই। একমাস লাগছিল আমার। নার্সারির কোথায় কী রয়েছে মুখস্থ করতে। এখন আমি চোখ বন্ধ করেও হাঁটতে পারব।’
সাদাফ মাথা নত করে ফেলল। বলল,
‘ আপনি খুব সুন্দর করে ও নম্র ভাষায় কথা বলেন। আপনার প্রতিটা কথাই অদ্ভুতভাবে মুগ্ধ করছে আমায়।’
চলবে….