আশিয়ানা #পর্ব_৯ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
64

#আশিয়ানা
#পর্ব_৯
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
টুংটাং রিক্সার বেল। শাঁ শাঁ করে বাস ও ট্রাক ছুটে চলার শব্দ। ঠান্ডা শীতেল বাতাস, রাতের শহরের টিমটিমে আলোয় ভাবনার সুতো বোনে তূর্ণ। স্টিফেনের হঠাৎ ডাকে সে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল তূর্ণর। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল স্টিফেনের দিকে। স্টিফেন নির্বিকার ভঙ্গিমায় গাড়িতে উঠে বসল। তূর্ণ বিড়ম্বনা করল না। উচ্চকিত গলায় শুধাল,

‘ তুমি ফুল নিয়েছ?’

স্টিফেন সাদা গোলাপের তোড়া তূর্ণর দিকে এগিয়ে দিল। তূর্ণর ঠোঁটে মৃদু হাসি৷ ফুলের তোড়াটা হাতের উপর রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। তারপর ঠোঁটের কোণে ফুলের তোড়া নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ পছন্দ হবে তো আপনার?’

স্টিফেন আগেপিছে না ভেবে বলে বসল,

‘ স্যার, আমরা চলে আসছি। এই বিল্ডিংয়ের দুইতলায়-ই স্পাইসি চিকেন শপ।’

তূর্ণ নড়েচড়ে উঠল। গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে শপের
বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে নিল। কিছুক্ষণ নীরব বসে থাকল সে। তারপর ছোট্ট একটা চিরকুট ফুলের তোড়াটার মাঝখানে রেখে স্টিফেনের দিকে এগিয়ে দিল। চেহারায় বিনয়ের আধিক্য নিয়ে বলল,

‘ স্টিফেন, সাবধানে ফুলের তোড়াটা নিয়ে তার আসল মালকিনের হাতে পৌঁছে দাও। খেয়াল রেখ ভুল হাতে যেন না পরে।’

পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো স্টিফেন। বিরসমুখে জানালো,
‘ স্যার। ম্যাম এখানে নেই। দুদিন আগে তিনি জব ছেড়ে দিয়েছেন।’

তূর্ণ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ ম্যামের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায়? নাম্বার বা বাড়ির এড্রেস?’

স্টিফেন গাড়িতে ঢুকে বলল,
‘ আমি জিজ্ঞেস করেছি, শপের মালিক বলেন নি। আপনার কথাও বলেছি, মহিলা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন৷ বিশ্বাস করেন নি, মাহাবুব তূর্ণ! একজন সাধারণ পার্ট টাইমারের নাম্বার চাইবে? সেখানে মানুষজন অনেক ছিল। এজন্য আমি কথা আর বাড়াই নি।’

তূর্ণ দৃঢ় গলায় বলল,
‘ একজন ভালো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের খোঁজ নাও। এবং যতদ্রুত তাকে জুবিয়াকে খুঁজে বের করতে বলো।’

‘ কিন্তু স্যার..?’

‘ কিন্তু কি?’

‘ ওনাকে খোঁজার কী দরকার স্যার? প্রতিদিনই তো কত মেয়ের সাথে আপনার পরিচয় হয়। তাঁকেই কেন খুঁজতে হবে?’

‘ প্রয়োজন রয়েছে স্টিফেন। তুমি বুঝবে না।’ বলে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল তূর্ণ।

স্টিফেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্ল্যাটে তূর্ণ একাই ঢুকবে। কলিংবেল বাজার পরপর সাদাফ এসে দরজা খুলে দেয়। অকস্মাৎ তূর্ণ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে একপলক, দু’পলক তার নিজ ফ্ল্যাটের নকশা দেখে নিল। ড্রয়িংরুম থেকে শুরু করে রুম ও বারান্দা সবখানে গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলছে সাদাফ। এতএত চারাগাছ দেখে তূর্ণর কেবলই মনে হচ্ছে, নার্সারিতে যত গাছ ছিল সবই তুলে নিয়ে আসছে সাদাফ। তূর্ণর কাছে এখন তার ফ্ল্যাট নার্সারি মনে হচ্ছে। তূর্ণ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ড্রয়িংরুম থেকে সোজা সাদাফের রুমে আসলো। সাদাফ গুনগুন করে গান গাইছে। গোলাপ গাছের টবে পানি দিতে লাগল সাদাফ।

তূর্ণ বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
‘ জঙ্গল বানানোর জন্য আমার বাড়িটাই তোর চোখে পড়ল? তোর নিজের বাড়ি ছিল না?’

সাদাফ চকিতে তাকিয়ে বলল,
‘ আমার বাড়ি? সে তো অনেক দূর৷ আমার একা একা সেখানে ভালো লাগবে না৷ তাই তোর বাড়িটাকে আমার থাকার মতো বানিয়ে ফেললাম। কতগুলো গাছ রয়েছে দেখ, শ্বাস নিতে এখন আর সমস্যা হবে না। চারদিকে শুধু অক্সিজেন আর অক্সিজেন।’

বিরক্তিতে কপালের চামড়া খানিক ভাজ ফেলল তূর্ণ। সূক্ষ্ম নয়নে তাকিয়ে নিরর্থক প্রশ্ন করল,

‘ রাতে ডিনারে কী রয়েছে? আমার ক্ষুধা লাগছে।’

সাদাফ পুরো শরীরে তূর্ণর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দৃষ্টি তূর্ণর উপর স্থির রেখে গাল ভরে হেসে বলল,

‘ গাছের পাতা খেয়ে নে।’

তূর্ণ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ তার একটি কথা মনে পড়ে যায়৷ সাদাফের উদ্দেশ্য গমগম গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিল তূর্ণ,

‘ সেহরিশ কোথায়?’

সাদাফ বারান্দায় আসলো খোলা আকাশ দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে । থমথমে নিকশ কালো আকাশ। খানিকটা হিম হিম বাতাসও বইছে। রাস্তায় কোনো রিকশা, সিএনজি বা ট্রাক গেলেই ঘেউ ঘেউ করে এক সাথে হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠছে পাঁচ ছয়টি লাওয়ারিশ কুকুর। বারান্দার গ্রিল ধরে সাদাফ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এক নিবেশে। ঘন কালো আকাশের বুকে হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকে উঠে। সশব্দে বজ্রধ্বনি ও শোনা গেল। সাদাফ তূর্ণর প্রশ্নের জবাব দিল না। তূর্ণ আবারও প্রশ্ন করল। সাদাফ রোমন্থন গলায় বলল,

‘ তোর চেহারা দেখে বোর হচ্ছিল তাই ওর নিজ ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে।’

তূর্ণ তড়িঘড়ি করে নিজ রুমে ছুটে এলো। আলমারির কাভার্ড থেকে ব্লেজার বের করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বের হতে লাগল। সাদাফ বিচলিত হলো, তূর্ণ আবারও কোনো উলট পালট কাজ না করে বসে চিন্তা ভাবনা করে তূর্ণর পিছন পিছন সাদাফও বেরিয়ে পড়ল।

___________

মেঘনা সিটি শহরে সেহরিশের বিশাল বাড়ি। সেহরিশ নিজের জন্য কফি বানানোর উদ্দেশ্য হিশেলের দিকে এগিয়ে গেল। আচমকা কলিংবেলটার আওয়াজ শুনে চকিত তাকাল। দরজা খুলে অবাক হলো সেহরিশ। তূর্ণ হঠাৎ সেহরিশের হাত থেকে কফিমগটা নিজ হাতে নিয়ে বলল,

‘ ওহ, আমার জন্য? থ্যাংক ইয়্যু।’

সেহরিশ চোয়ালদ্বয় শক্ত করে দরজা বন্ধ করে, তূর্ণর অভিমুখে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,
‘ তোকে আমার ফ্ল্যাটে আসার অনুমতি কে দিয়েছে?’

কথার মাঝে আবারও কলিংবেলের শব্দ কানে এলো। চোখ-মুখ কুঁচকে দরজা খুলল সেহরিশ। সাদাফ ঠোঁট জোড়া চেপে তির্যক চোখজোড়া শান্ত রেখে দুহাত পকেটে রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ তূর্ণ আসছে?’

সেহরিশ হকচকিত গলায় বলল,
‘ তোরা দুইটা আমার বাড়ি থেকে এক্ষণ যা।’

বজ্রবিদ্যুৎ-সহ আকাশ কাঁপিয়ে ভারী বৃষ্টিপাত আরম্ভ হলো৷ তূর্ণ আয়েসি ভঙ্গিতে হাতপা ছড়িয়ে বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সেহরিশ কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলল,

‘ যাচ্ছিস না কেনো?’

সাদাফ বিষ্ময় নিয়ে বলল,
‘ বৃষ্টি হচ্ছে। কিভাবে যাব? বৃষ্টি থামুক চলে যাব।’

সেহরিশ ত্রস্তপায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মেঘেদের তর্জন-গর্জন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ার শব্দ, বৃষ্টির জল ছিটকে বারান্দার মেঝে চিপচিপে হয়ে আছে। সেহরিশের চুলগুলো কপোলদ্বয়ে অগোছালো ভাবে পরে আছে। প্রচণ্ড বাতাসে মৃদু নড়ে উঠল তা। বারান্দার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াল সেহরিশ। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশ সরে দাঁড়াল। রাস্তার মোড়ের ল্যাম্পপোস্টের বাতিটা একবার নিভছে তো আবার জ্বলছে। আবছা আলোয় মোড়ের পাশে আম গাছের নিচে একজন মহিলাকে স্পষ্ট দেখল সেহরিশ। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মহিলা গাছের নিচ ঘুরতে লাগল। সে একজায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে না। গাছের ডালের ফাঁকফোকড় দিয়ে যখনই বৃষ্টি পরছে তখনই সেখান থেকে সরে অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে পরছে। সেহরিশ তার চক্ষুদ্বয়গুলো নিষ্পলকভাবে মেলে ধরলো নাম-না-জানা অচেনা মানুষটার উপর। সাদাফ এসে তার ঠিক পাশেই দাঁড়াল। সেহরিশের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল।

সাদাফ বলল,
‘ ওভাবে কী দেখছিস?’

সেহরিশ বলল,
‘ গাছের নিচে ওই মহিলাকে দেখছিস? মনে হয় বৃষ্টির জন্য ওখানে আটকে পরেছেন। ভিজে যাবেন বলে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন।’

সেহরিশ ব্যালকণি ত্যাগ করে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়ে গেল। উচ্চকিত গলায় জাবেদকে ডাকলো, জাবেদের হাতে একখানা ছাতা গুঁজে দিল সেহরিশ। প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ বাড়ির সামনের আম গাছটার নিচে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ওনাকে এই ছাতাটা দিয়ে আসো। এবং উনাকে বলো, যদি তিনি চান তবে বাড়ির নিচ তলার বন্ধ রুমে বসে, বৃষ্টি যতক্ষণ না থামছে, ততক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেন।’

নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেহরিশের মুখশ্রীতে তাকিয়ে সাদাফ বলল,
‘ ওনাকে মহিলা মনে হচ্ছে না। আনুমানিক ২০/২২ বয়সী কোনো যুবতী এর বেশি হবে না।’

সেহরিশ মৃদুস্বরে বলল,
‘ বয়সে কী আসবে যাবে? সে একজন নারী। এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট, অসহায় ব্যক্তিকে সাহায্য করা।’

মুষলধারে বৃষ্টি পরছে। জাবেদের মুখপানে নিবিড়ভাবে তাকাল রোদেলা। জাবেদ শাহাদাত আঙুল দিয়ে তিনতলায় রেলিঙের পাশে দাঁড়ানো সেহরিশকে দেখিয়ে রোদেলার উদ্দেশ্য বলল,

‘ উনি আমার স্যার। আপনি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন দেখে তিনি আপনার জন্য এ-ই ছাতাটা পাঠিয়েছেন। এবং স্যার বলেছেন আপনি যদি চান তবে স্যারের বাড়ির নিচতলার ঘরে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে পারেন।’

রোদেলা কিঞ্চিৎ অবাক হলো, বারান্দার উপর দৃষ্টি ছুড়ে তাকাল রোদেলা। প্রশস্ত হেসে মৃদুস্বরে বলল,
‘ এই বৃষ্টিতে আপনারা আমাকে নিয়ে চিন্তা করে সাহায্য করলেন। এতটুকুই অনেকজন করে না। আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। যদি কোনোদিন সম্ভব হয়৷ এই উপকারের প্রতিদান ঠিক দিব।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here